রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্মিলিত খতমে নবুয়ত পরিষদের গতকালের মহাসম্মেলনে বিপুলসংখ্যক আলেম-ওলামা ও ধর্মপ্রাণ মুুসল্লি যোগ দেন। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আলেম-ওলামা ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা ভোর থেকেই সম্মেলনস্থলে আসতে শুরু করেন। দুপুরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পরিপূর্ণ হয়ে যায়।
সম্মেলনে কাদিয়ানিদের (আহমদিয়া সম্প্রদায়) রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম সংখ্যালঘু ঘোষণার দাবিতে ‘আন্তর্জাতিক খতমে নবুয়ত মহাসম্মেলন’ থেকে বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেন সম্মিলিত খতমে নবুয়ত পরিষদের সদস্যসচিব মাওলানা মহিউদ্দিন রাব্বানী। তিনি আগামী বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত একটি সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করেন। এ সময়ের মধ্যে দাবি বাস্তবায়িত না হলে আরও ‘কঠিন থেকে কঠিন’ কর্মসূচির হুঁশিয়ারি দেন। ঘোষণা অনুসারে, কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণার দাবিতে তিনটি ধাপে কর্মসূচি পালন করা হবে। এর মধ্যে আগামী ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত সর্বস্তরের আলেম-ওলামা ও তৌহিদি জনতার অংশগ্রহণে দেশব্যাপী গণস্বাক্ষর সংগ্রহ, আগামী মে ও জুন মাসজুড়ে দেশের প্রতিটি জেলায় দায়িত্বরত জেলা প্রশাসক (ডিসি) বরাবর স্মারকলিপি পেশ এবং জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাস সারা দেশে প্রতিটি বিভাগে পর্যায়ক্রমে বিভাগীয় খতমে নবুয়ত মহাসম্মেলনের আয়োজন করা হবে।
এদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ক্ষমতায় গেলে সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস’ পুনর্বহাল করা হবে। সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমাদের নেতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের সংবিধানে প্রথমবারের মতো ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ সংযোজন করেছিলেন। সেটা এখনো বহাল আছে। অনেকেই এটা সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, পারেনি। যেটা বহাল নেই; রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান যেটা সংযোজন করেছিলেন মহান আল্লাহর প্রতি আস্থা এবং বিশ্বাস সংবিধানের প্রস্তাবনায় ছিল এবং রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে ছিল, অনুচ্ছেদ ৮-এর মধ্যে। সেটা তুলে দেওয়া হয়েছে আপনারা জানেন। আপনারা কি চান আমরা সেটা পুনর্বহাল করি? ইনশাল্লাহ আমরা সেটা পুনর্বহাল করব।
সম্মেলনে ৬ দফা ঘোষণা : ইসলামের মৌলিক আকিদা ‘খতমে নবুয়ত’ সংরক্ষণ এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে কাদিয়ানিদের ‘সংখ্যালঘু অমুসলিম’ ঘোষণার দাবি জানিয়ে দেশবিদেশের শীর্ষস্থানীয় ওলামা-মাশায়েখের উপস্থিতিতে মহাসম্মেলন থেকে সর্বসম্মতভাবে ছয় দফা দাবিসংবলিত একটি ঘোষণাপত্র পেশ করা হয়। খতমে নবুয়ত পরিষদের মাওলানা মাহফুজুল হক এই ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। ছয় দাবি হলো অমুসলিম ঘোষণা, ইসলামি পরিভাষা ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা, উপাসনালয় ও নিদর্শন, বিবাহ সম্পূর্ণ হারাম, জানাজা ও উত্তরাধিকার এবং প্রচারণায় নিষেধাজ্ঞা।
সম্মেলনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম বলেন, দীর্ঘ ৫৩ বছর ধরে বারবার দেশের আলেম সমাজ ও মুসলমানরা রাজপথে আন্দোলন করলেও বিগত কোনো সরকারই কাদিয়ানিদের সরকারিভাবে অমুসলিম ঘোষণা করেনি।
পাকিস্তান উলামায়ে জমিয়তের সভাপতি মাওলানা ফজলুর রহমান বলেন, খতমে নবুয়তের আকিদা সমগ্র উম্মতে মুসলিমার যৌথ ইস্যু, কোনো দেশের সীমাবদ্ধ বিষয় নয়। রসুল (সা.)-এর পরে আর কোনো নবী আসবে না- এ বিশ্বাসের ওপর মুসলমানদের দৃঢ় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত। হেফাজতে ইসলামের আমির মহিবুল্লাহ বাবুনগরী বলেন, পৃথিবীর বহু মুসলিম রাষ্ট্র যেমন পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া এবং আরও অনেক দেশ কাদিয়ানি সম্প্রদায়কে রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষণা করেছে। মুসলমানদের আকিদা রক্ষার্থে বাংলাদেশেও একই সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি। তাহরীকে খতমে নবুয়ত বাংলাদেশের আমির আল্লামা মুফতি ড. সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ এনায়েতুল্লাহ আব্বাসী বলেন, মুসলমানদের মৌলিক দাবি সংবিধানে প্রতিফলিত না হলে সেটি মানা হবে না। সম্মিলিত খতমে নবুয়ত পরিষদের আহ্বায়ক আবদুল হামিদ পীর (মধুপুর) বলেন, ‘আমার শেষ কথা নবীর পরে কোনো নবী নেই; হেদায়াতের বিপরীতে কোনো নতুন পথ নেই; আর বাতিলের সঙ্গে কোনো আপস নেই।’ জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব মুফতি আবদুল মালেক বলেন, ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি ইমানি বিষয়কে কেন্দ্র করে আজ সবাই একত্র হয়েছি। কিছু মানুষ এই বিষয়েও অস্পষ্টতা সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে, কেউ কেউ নিজেই ধোঁকার মধ্যে পড়ে অন্যদের ধোঁকা দিচ্ছে।’
সম্মেলনে আরও বক্তব্য দেন জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি মাওলানা রফিকুল ইসলাম, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক প্রমুখ। এ ছাড়া পাকিস্তানের ইসলামি চিন্তাবিদ মাওলানা ইলিয়াস গুম্মান, পাকিস্তানের বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার মহাসচিব মাওলানা হানিফ জালন্দরি, পাকিস্তানের ইউসুফ বিন্নুরি টাউন মাদ্রাসার নায়েবে মুহতামিম আহমাদ ইউসুফ বিন্নুরি; ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দের মুহতামিম মুফতি আবুল কাসেম নোমানি, জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সভাপতি মাওলানা মাহমুদ মাদানী, ইন্টারন্যাশনাল খতমে নবুয়ত মুভমেন্ট, সৌদি আরবের নায়েবে আমির শায়খ আবদুর রউফ মাক্কি, মিসরের আল-আজহার ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক শায়খ মুসআব নাবিল ইবরাহিমও এই সম্মেলনে অংশ নেন।
দেশের শীর্ষস্থানীয় ওলামাদের মধ্যে সম্মেলনে যোগ দেন দারুল উলুম হাটহাজারীর অধ্যক্ষ মাওলানা খলিল আহমাদ কুরাইশী, আল হাইয়াতুল উলিয়া ও বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাওলানা মাহমুদুল হাসান প্রমুখ।