রাজধানীর ইস্কাটনে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট (বিয়াম) ফাউন্ডেশনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় রহস্য দেখা দিয়েছে। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি এই আগুনে দগ্ধ হয়ে দুজনের মৃত্যু হয়। ফায়ার সার্ভিস তাৎক্ষণিকভাবে জানায়, এসি বিস্ফোরণে তাদের মৃত্যু হয়েছে। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) বলছে, বিয়ামের গুরুত্বপূর্ণ নথি পোড়াতে পরিকল্পিতভাবে আগুন দেওয়া হয়। ওই আগুন দেওয়ার ঘটনায় জড়িত দুজন গ্রেপ্তার হয়েছেন। তারা ঘটনায় সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করেছেন। তবে এর উদ্দেশ্য বের করতে তদন্ত চলছে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, বিয়ামের অফিসে গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র পুড়িয়ে দিতে পেট্রোল ঢেলে আগুন দেওয়া হয়। ওই আগুনে পুড়ে দুজনের মৃত্যু হয়। আর আগুন লাগিয়ে নথিপত্র পুড়িয়ে ফেলার কাজের জন্য দুষ্কৃতকারীদের সঙ্গে চুক্তি হয় ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা। ঘটনাটি তদন্তের সিসিটিভি ফুটেজ জব্দ করা হয়েছে। ফুটেজে মাস্ক পরা একজনকে দেখা যায়। সেই ছবিটি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের (এআই) মাধ্যমে মাস্ক ছাড়া ছবি চাওয়া হয়। সেখানে সম্ভাব্য ১০ জনের ছবি দেওয়া হয়। ওই সব ছবি বিয়ামের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দেখানো হলে তারা একজনকে শনাক্ত করেন। গত ২৫ জুলাই কুড়িগ্রাম ও ঢাকায় পৃথক অভিযান চালিয়ে বিয়ামের প্রশাসনিক কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম (৩৮) এবং তার ভাড়াটে সহযোগী আশরাফুল ইসলামকে (৩৬) গ্রেপ্তার করা হয়। জানতে চাইলে পিবিআইপ্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোস্তফা কামাল এই প্রতিবেদককে জানান, ওই ঘটনায় কারা কারা জড়িত তাদের বের করার চেষ্টা করছেন। গুরুত্বপূর্ণ নথিতে অর্থ আত্মসাতের কোনো ঘটনা আড়াল করার চেষ্টা ছিল কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে এবং ব্যাংকে টাকা স্থানান্তরেরও তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। পিবিআই জানায়, গত ২৭ ফেব্রুয়ারি রাত ৩টা ২০ মিনিটে বিয়াম ভবনে ৫০৪ নম্বর কক্ষে বিস্ফোরণ ঘটে।
বিস্ফোরণে ৫০৪ নম্বর কক্ষে রাখা সমিতির দলিলপত্রাদি, নামজারিসংক্রান্ত কাগজপত্র, ব্যাংক হিসাব, চেক বই, জমি ক্রয়সংক্রান্ত ৪টি চুক্তিপত্র, ইলেকট্রিক সামগ্রী, আসবাব কক্ষের এসিসহ অন্যান্য মালামাল পুড়ে ভস্মীভূত হয়। এ সময় অফিস সহায়ক আবদুল মালেক ঘটনাস্থলেই মারা যান এবং সমিতির সেক্রেটারির গাড়িচালক ফারুক গুরুতর আহত হন। পরে তাকে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয় এবং সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। এ ঘটনায় বিসিএস (প্রশাসন) কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সাধারণ সম্পাদক অবসরপ্রাপ্ত সচিব মশিউর রহমান অজ্ঞাত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে রাজধানীর হাতিরঝিল থানায় মামলা করেন। হাতিরঝিল থানার পুলিশ দুই মাস মামলাটি তদন্ত করে। ৬ মে পিবিআই এসআইঅ্যান্ডও (উত্তর) মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করে এবং এসআই মোহাম্মদ গোলাম মওলাকে তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ করা হয়। পিবিআইয়ের বিশেষ টিম মামলার ঘটনার তারিখ ও সময় এবং সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণে জানতে পারে ২৭ ফেব্রুয়ারি রাত আড়াইটায় মাথায় মাস্কিং ক্যাপ, মুখে মাস্ক, হাতে হ্যান্ড গ্লাভস, পায়ে স্যান্ডেল পরা ৩০-৩৫ বছর বয়সি এক যুবক বিয়াম ভবন মাঠের পশ্চিম দিক থেকে এসে সিঁড়ি দিয়ে ভবনের পঞ্চম তলায় চলে যান এবং সিসি ক্যামেরা বন্ধ করে দেন। পিবিআইয়ের টিম এআইর মাধ্যমে আসামির ছবি শনাক্ত করে। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার, সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে পিবিআইয়ের একাধিক টিম আত্মগোপনে থাকা আশরাফুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আশরাফুল ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন এবং তার দেওয়া তথ্যে বিয়ামের প্রশাসনিক কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলামকে ভাটারা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, আশরাফুল পিবিআইকে জানান জাহিদুল ইসলাম তার পূর্বপরিচিত এবং এলাকার ভাই।
জাহিদুল তাকে গত বছরের শুরুতে ঢাকায় এনে মগবাজার থ্রি-স্টার হোটেলে একটানা পাঁচ-ছয় মাস রাখেন। জাহিদুল ইসলামের সূত্র ধরে তিনি প্রায়ই বিয়ামে যাতায়াত করতেন এবং ওই অফিসের কাজে কয়েকজনের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি হয়। জাহিদুল সমিতির মূল নথিপত্র স্থায়ীভাবে ধ্বংসের জন্য আশরাফুল, অফিস সহায়ক মালেক ও গাড়িচালক ফারুক মিলে পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা মোতাবেক কাজ শেষে তাদের ১০-১২ লাখ টাকা দেওয়ার মৌখিক চুক্তি হয়।
জাহিদুল পরিকল্পনা মোতাবেক একদিন আশরাফুলকে কিছু টাকা দিয়ে বিয়ামের পঞ্চম তলার সিসি ক্যামেরা বন্ধ করতে বলেন। জাহিদের দেওয়া টাকায় আশরাফুল মাস্ক, মাস্কিং ক্যাপ, হ্যান্ড গ্লাভস ও ফুল স্লিপ শার্ট কেনেন। ঘটনার দিন আশরাফুল মাথায় মাস্কিং ক্যাপ, মুখে মাস্ক এবং হ্যান্ড গ্লাভস পরে বিয়াম ভবনের পঞ্চম তলায় উঠে ক্যামেরা বন্ধ করে দেন। ৫০৪ নম্বর কক্ষে প্রবেশ করে গাড়িচালক মালেক বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাগজে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেন। আশরাফুল পঞ্চম তলা থেকে তৃতীয়তলা নামতেই বিকট বিস্ফোরণের শব্দ হয়। ঘটনাস্থলেই অফিস সহায়ক মালেক মারা যান। জাহিদ গাড়ি নিয়ে আশরাফুলের সহযোগিতায় গুরুতর আহতাবস্থায় ড্রাইভার ফারুককে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি করান। পরে জাহিদের কথামতো আশরাফুল পরদিন রংপুর চলে যান।