প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে কাজে যেন কচ্ছপগতি। অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরেও সেভাবে গতি আসেনি প্রশাসনে। বরং কাজের গতি আরও কমেছে। সচিবালয়ে প্রবেশ কড়াকড়ির কারণে কমেছে তদবিরবাজদের আনাগোনাও। উপদেষ্টা ও সচিবের দপ্তরের সামনে ভিড়ও কমেছে। কাজের গতি কম থাকায় অনেক কর্মকর্তা সচিবালয়কে ‘প্রাণহীন’ বলছেন। গণ অভ্যুত্থানের পর জনপ্রত্যাশা অনুযায়ী প্রশাসন এগোচ্ছে না বলে মনে করেন জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক আমলারা। বিগত কয়েক কর্মদিবসে সচিবালয় ঘুরে দেখা গেছে, সরকারি কর্মকর্তাদের পাশাপাশি সেবাপ্রার্থীর ভিড় না থাকায় সচিবালয় যেন নিষ্প্রাণ। আগের মতো নেই গাড়ি ও মানুষের ভিড়। সচিবালয়ে আগের চেয়ে প্রবেশাধিকারের পাস কমানো হয়েছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পে টেন্ডার, রদবদলসহ বিভিন্ন তদবির করতে আসা মানুষের সংখ্যাও কমেছে। বিভিন্ন উপদেষ্টা ও সচিবের দপ্তর ঘুরে দেখা গেছে, দপ্তরগুলোর সামনে মানুষের ভিড় একেবারেই নেই। অথচ এক বছর আগেও রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গসহ নিজ নিজ নির্বাচনি এলাকার মানুষের ভিড় লেগে থাকত মন্ত্রী সচিবদের দপ্তরে।
সচিবালয়ে কাজ করা কর্মকর্তারা সবাই এখন রুটিন দায়িত্ব পালন করছেন। নিজ নিজ দপ্তরে চুপচাপ থাকছেন। আবার কাজ শেষে চুপচাপ চলে যান। কর্মপরিবেশ নিয়ে কেউ কারও সঙ্গে খুব একটা কথাও বলেন না। ব্যাচমেট সহকর্মীদের সঙ্গেও কোনো আলোচনা নেই বললেই চলে। তবে আগামী জাতীয় নির্বাচন কোন দিকে যাচ্ছে সেদিকে নজর রাখছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সচিবালয়ে কিছু মানুষের আনাগোনা দেখা গেছে হাতে গোনা কয়েকটি মন্ত্রণালয়ে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ছাড়া অন্যত্র খুব একটা ভিড় দেখা যায়নি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে রদবদল নিয়েও কর্মকর্তাদের ভিড় নেই বললে চলে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পুলিশের বদলি নিয়ে কর্মকর্তাদের আনাগোনা দেখা গেছে। পছন্দের প্রতিষ্ঠানে যেতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রতিদিনই ধরনা দিচ্ছেন শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা। ঢাকা বা বড় শহরের হাসপাতাল বা কলেজে বদলি হতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়েও কমবেশি যাতায়াত আছে চিকিৎসকদের। তবে অন্য মন্ত্রণালয়গুলোতে যেন জনশূন্য পরিস্থিতি। সাধারণত, মন্ত্রণালয়গুলোতে তদবিরবাজ ও সেবাপ্রার্থীর চাপ কমলে কাজের গতি বাড়ার কথা। অথচ সেটি বাড়েনি। কর্মকর্তারা বলছেন, কাজের পরিধি অনেক কাটছাঁট হয়েছে ফলে কিছু কাজও কমেছে। রুটিনের বাইরে অনেক কাজ কমেছে। ফলে প্রশাসনে কাঙ্ক্ষিত গতি সেভাবে আসেনি। কর্মকর্তারা জানান, সংশ্লিষ্ট শাখার বা উইংয়ের কর্মকর্তারা রুটিন কাজগুলো করে দিন পার করছেন। অতিউৎসাহী বা আগ্রহ নিয়ে কোনো বাড়তি কাজ বা বাড়তি আইডিয়া নিয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না কেউ। ঝিমিয়ে পড়া প্রশাসনে সরকারি কাজের গতি বাড়াতে কিছু উদ্যোগও নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। অনেক গুরুত্বপূর্ণ ফাইল পড়ে থাকা, কাজকর্মে ঢিলেমি ভাব, অগ্রাধিকার ও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নেও কালক্ষেপণ নিয়ে কয়েকটি বৈঠকও করেছেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা। সরকারের ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো জানায়, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিষয়টি নজরে আসে। এ নিয়ে উপদেষ্টাদের মধ্যেও আলোচনাও হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা কিছু পরামর্শসহ দিকনির্দেশনাও দেন। এরপর চলতি বছরের প্রথম দুই-তিন মাস কাজের গতি আসা শুরু হলেও আবার ঝিমিয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে সচিবালয়ে শিক্ষার্থীদের হুটহাট প্রবেশ করে কর্মপরিবেশ নিয়ে অনেকেই অস্বস্তিতে রয়েছে বলেও জানিয়েছেন। সরকারি কাজে বিলম্ব পরিহার করে গতি ফেরাতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, মন্ত্রণালয়ের অধীন এবং মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের পাঁচটি নির্দেশনা দিয়েছে। কিন্তু সেটি কেবল নির্দেশনাতেই যেন রয়ে গেছে! সচিবালয়ে কাজের গতি নিয়ে অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব ও জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রশাসনে কাজের গতি এতটাই কমেছে যা ধারণার বাইরে। এমন শ্লথ গতি আগে কখনো হয়েছে কিনা জানা নেই। গতি কমার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো দক্ষ কর্মকর্তাকে সঠিক জায়গায় পদায়ন করতে না পারা। দক্ষ, নিরপেক্ষ এবং যোগ্য আমলাদের বাছাই করে গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করা সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া ওপরের পর্যায়ে ঘন ঘন সিদ্ধান্ত বদল এবং সিদ্ধান্তহীনতাও একটা কারণ।
মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া আরও বলেন, বিভিন্ন মবের কারণেও প্রশাসনে কাজের প্রভাব পড়েছে। কোনো কর্মকর্তা সাহসী উদ্যোগ নিচ্ছে না। কোনো রকম রুটিন দায়িত্ব পালন করে সময় কাটাচ্ছে।