প্রশাসনে বড় পরিবর্তন এনেছে অন্তর্বর্তী সরকার। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমানকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম জেলার ডিসিসহ তিনজন ডিসিকেও পরিবর্তন করা হয়েছে। গতকাল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে এ-সংক্রান্ত পৃথক প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। ‘অ্যান্টি প্রশাসন’ খ্যাতি পাওয়া মোখলেস উর রহমানকে সরিয়ে দেওয়ায় সর্বস্তরের কর্মকর্তার মধ্যে স্বস্তি দেখা গেছে। একজন আরেকজনকে ফোন করে জানান ‘আমাদের মোখলেস ভাইকে সরিয়েছে।’ আড়ালে জুনিয়র কর্মকর্তারা তাকে ‘মোখলেস ভাই’ বলে ডাকতেন। সাবেক কর্মকর্তারা জানান, এই কর্মকর্তা অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছেন, একই সঙ্গে প্রশাসনের ক্ষতিও করেছেন বেশি।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এই মোখলেস উর রহমানকে সরিয়ে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে বদলি করা হয়েছে। আর জনপ্রশাসনে সচিবের রুটিন দায়িত্ব পালন করবেন ওই মন্ত্রণালয়ের ১৮ ব্যাচের অতিরিক্ত সচিব ড. আবু শাহীন মো. আসাদুজ্জামান।
গত বছরের ২৮ আগস্ট জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরীকে সরিয়ে অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোখলেস উর রহমানকে দুই বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। মোখলেস উর রহমান বিসিএস প্রশাসন ৮২ ব্যাচের কর্মকর্তা। তিনি জনপ্রশাসন সচিবের দায়িত্ব পাওয়ার পর প্রশাসনে নজিরবিহীন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। পদায়ন ও পদোন্নতিতে বঞ্চিতদের অবমূল্যায়নের অভিযোগ ওঠে। সচিব, সংস্থাপ্রধান ও জেলা প্রশাসক নিয়োগ নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। টাকাপয়সার লেনদেনে অভিযোগও ওঠে। বিভিন্ন পদে নিয়োগকে কেন্দ্র করেও আর্থিক লেনদেনের অভিযোগও ওঠে তার বিরুদ্ধে।
গত ডিসেম্বরে সচিবালয়ে এক অনুষ্ঠানে মোখলেস উর রহমান বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী সরকারের পতনের পর সরকারি কর্মকর্তাদের স্যার ডাকার নিয়ম আর নেই। সরকারি কর্মকর্তাদের ভাই ও আপা ডাকা যাবে। এরপর থেকে ব্যঙ্গ করে জুনিয়র কর্মকর্তাদের অনেকেই আড়ালে নিজেদের কথোপকথনে মোখলেস ভাই বলতেন।
মোখলেস উর রহমানের ব্যাচমেট জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘মোখলেস উর রহমানকে আরও আগেই সরকারের সরানো উচিত ছিল। বিশেষ করে যখন তার নামে ডিসি নিয়োগে লেনদেনের অভিযোগ উঠল। এরপর এই ব্যক্তির নামে মামলা হলো তবু সরকার তাকে বহাল রাখল। সরকারের প্রশাসনের পিরামিড ভেঙে ফেলেছেন। সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় দপ্তর বা কর্মকর্তা কারও কোথাও সেতুবন্ধন করতে পারেনি বরং বিভেদ তৈরি করেছে। ভালো দক্ষ সচিব বা অন্য কর্মকর্তা বাছাই করা তার দায়িত্ব সে এসব বিষয়ে কিছুই করতে পারেনি।’ ১৯৮২ ব্যাচ এবং ওই সময়ে আরও দুই-একটি ব্যাচের কর্মকর্তা জানান, চাকরিজীবনের শুরু থেকেই নানান অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে এই কর্মকর্তার নামে। মুক্তাগাছার ইউএনও থাকার সময় এই মোখলেস সে সময় রাত ১টার সময় ভোটের ফলাফল পাল্টে দিয়ে সমালোচনা তৈরি করেছিলেন। সেই সময় পাস করা ব্যক্তিকে ফেল দেখিয়েছিলেন। তার একাধিক সমসাময়িক কর্মকর্তা বলেন, মৌলভিবাজারে ডিসি এবং চট্টগ্রামে কমিশনার থাকার সময়ও নানা দুর্নীতিতে সমালোচনা হয়েছে। এরপর অতিরিক্ত সচিব থাকা অবস্থায় ২০১৫ সালে মোখলেস উর রহমানকে অবসরে পাঠিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানান, সচিব হতে পারেননি এসব অজুহাতে নিজেকে মেধাবী আখ্যা দিয়ে বিশেষ মহলের সঙ্গে যোগাযোগ করে দুই বছরের সচিব পদ বাগিয়ে নেন। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স ইন পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ডিগ্রি অর্জন করেন। এই কর্মকর্তাকে কেউ হার্ভার্ড থেকে পড়াশোনা করা এসব বললেই খুশিতে উৎফুল্ল থাকতেন সব সময়ই। গতকাল বদলির অর্ডার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সচিবালয়সহ অন্যান্য দপ্তরের কর্মকর্তারাও খোঁজ নিতে শুরু করেন অর্ডার সত্যি কিনা। মাঠ প্রশাসনের অন্তত ২০ জন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয়। বেশির ভাগ কর্মকর্তাই এই সচিবের বিদায়ে স্বস্তি প্রকাশ করেন। অনেকে বলেন, অনেকটাই রাহুমুক্ত হলো জনপ্রশাসন। প্রশাসনের একাধিক যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব বলেন, প্রশাসনের শৃঙ্খলা, চেইন অব কমান্ড ভেঙে ফেলতে অনেক ভূমিকা রয়েছে তার। মুখে মুখে কথার ফুলঝুরি থাকলেও কাজকর্মের মধ্যে ছিল না। কর্মকর্তারা বলেন, তিনি কয়েকজন কর্মকর্তার হাতে পুরো জনপ্রশাসন বন্দি করে ফেলেছিলেন। বিগত সময়ের যারা ডিসি, এডিসি, কমিশনার ছিলেন তাদের সঙ্গে দেখা হলে খুব খারাপ ব্যবহার করতেন। অনেক সিনিয়র কর্মকর্তাকে জুনিয়রদের সামনে বকাঝকা করেছেন যা শিষ্টাচারবহির্ভূত বলেও জানান কর্মকর্তারা। তবে এখন দল বা দলীয় প্রভাব না দেখে দক্ষ ও ভালো কর্মকর্তাদের পদায়ন করার কথাও বলেন অনেকে।
এদিকে গতকাল পৃথক প্রজ্ঞাপনে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য মো. রুহুল আমীনকে (সচিব) বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
চট্টগ্রামসহ দেশের তিন জেলায় নতুন জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগ দিয়েছে সরকার। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নওগাঁর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবদুল আউয়ালকে চট্টগ্রামের ডিসি হিসেবে বদলি করা হয়েছে। আর স্বাস্থ্যশিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের উপসচিব মোহাম্মদ আনোয়ার হোসাইনকে নরসিংদী এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের উপসচিব মনিরা হককে নওগাঁর ডিসি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে চট্টগ্রামের ডিসি ফরিদা খানমকে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব এবং নরসিংদীর ডিসি মোহাম্মদ রাশেদ হোসেন চৌধুরীকে স্থানীয় সরকার বিভাগের উপসচিব হিসেবে বদলি করা হয়েছে। এর আগে ১৫ সেপ্টেম্বর আরও তিন জেলার ডিসিকে প্রত্যাহার করা হয়। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে মাঠ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ এই পদে সামনে আরও পরিবর্তন করা হবে বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো জানিয়েছে। তবে চট্টগ্রামের ডিসিকে মাত্র ১ বছরে কেন তুলে আনা হলো প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে সে আলোচনা চলছে।