সারা দেশে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। ফেনীতে নতুন নতুন গ্রাম প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এরই মধ্যে নোয়াখালীতে ৪০ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
ফেনী : ফেনীতে বৃষ্টি ও নদীর পানি কমলেও ভোগান্তি বেড়েছে। পরশুরাম ও ফুলগাজীর বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। তবে নতুন করে তলিয়ে গেছে ফেনী সদর ও ছাগলনাইয়া উপজেলার অর্ধশতাধিকের বেশি গ্রাম। ফলে চার উপজেলায় ভোগান্তিতে পড়েছেন কয়েক লাখ মানুষ। দুর্গত এলাকায় এখনো বিদ্যুৎ সংযোগ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন রয়েছে। যান চলাচলে ঘটছে ব্যাঘাত। ফেনী-ফুলগাজী ও ফেনী-ছাগলনাইয়া আঞ্চলিক সড়কের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হওয়ায় ছোট আকারের যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। জেলার ৮২টি আশ্রয় কেন্দ্রে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত ৯ হাজার ২০০ বাসিন্দা অবস্থান করছেন। গতকাল রাত পর্যন্ত পরশুরাম ও ফুলগাজী উপজেলায় বন্যাকবলিত এলাকা থেকে অন্তঃসত্ত্বা নারী, অসুস্থসহ ১৮ জনকে সেনাবাহিনী ও স্বেচ্ছাসেবকরা উদ্ধার করেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যানুযায়ী, গত সোমবার থেকে ভারী বর্ষণের কারণে শুক্রবার পর্যন্ত ফেনীর ফুলগাজী ও পরশুরামে মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ২১টি স্থান ভেঙে যায়। এতে ফুলগাজী, পরশুরাম, ছাগলনাইয়া, ফেনী সদর উপজেলার অন্তত শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বুধবার থেকে বৃষ্টি কমতে শুরু করায় সকাল থেকে পরশুরাম উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে থাকে। তবে বন্যার পানি নিম্নাঞ্চল ফুলগাজী গড়িয়ে ছাগলনাইয়া ও ফেনী সদর উপজেলায় ঢুকতে শুরু করে।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত ফেনী-ছাগলনাইয়া সড়কের রেজুমিয়া থেকে পৌরসভা পর্যন্ত অংশে এক থেকে দুই ফুট ওপর দিয়ে গড়িয়ে যেতে দেখা গেছে। এতে নতুনভাবে ছাগলনাইয়া উপজেলার পাঠাননগর, রাধানগর, শুভপুর ও ছাগলনাইয়া পৌরসভার অন্তত ২০টি গ্রাম প্লাবিত হয়ে পানিগুলো ফেনী সদর উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে ঢুকে পড়ছে। বৃহস্পতিবার রাতে পর্যন্ত বাঁধভাঙা পানি ঢুকে ফেনী সদর উপজেলার কাজিরবাগ, মোটবী, ছনুয়া, ফাজিলপুর ইউনিয়নের অন্তত ৩০টি গ্রাম নতুনভাবে প্লাবিত করেছে।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, বন্যায় ফেনীর পরশুরাম, ছাগলনাইয়া, ফেনী সদর ও দাগনভূঞা উপজেলার অন্তত ১০৯টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বন্যার্তদের প্রয়োজনীয় সহায়তা নিশ্চিতে জেলা প্রশাসন কাজ করছে।
ফেনীর আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মজিবুর রহমান বলেন, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় ৫৮ দশমিক ৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। ক্রমান্বয়ে বৃষ্টিপাত কমছে। তাই শুক্রবার থেকে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতির সম্ভাবনা রয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড ফেনীর নির্বাহী প্রকৌশলী আকতার হোসেন মজুমদার বলেন, মুহুরী নদীর পানি ১ দশমিক ৯৩ মিটার বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফুলগাজী এলাকার বন্যাকবলিত গ্রামগুলোতে পানির অবস্থা অপরিবর্তিত রয়েছে। পানির চাপ কমে যাওয়ায় নতুন করে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভাঙার আশঙ্কা নেই। পানি কমে গেলেই ভাঙনকবলিত স্থানগুলো মেরামত করা হবে। ফেনী জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, জেলায় বন্যাকবলিত চার উপজেলার মধ্যে পরশুরামে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছে। ফুলগাজীতেও কিছুটা ভালোর দিকে রয়েছে। তবে বৃহস্পতিবার বন্যার পানি ছাগলনাইয়ার প্রধান সড়ক গড়িয়ে বিভিন্ন নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।
নোয়াখালী : নোয়াখালীতে টানা তিন দিনের বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতায় নিম্নাঞ্চলের সদর, কবিরহাট, কোম্পানীগঞ্জ ও সুবর্ণচরের ৪টি উপজেলায় ৪০ হাজার পরিবার পানিবন্দি রয়েছে। টানা বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতার কারণে ১ হাজার ২৫৩টি সরকারি প্রাথমিক স্কুলসহ মোট ১৮০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। পাশাপাশি অসংখ্য মৎস্য খামারের ভেসে গেছে মাছ। বেগমগঞ্জ অনন্তপুরে ৯০ একরবিশিষ্ট আরএমএ মৎস্য খামার পানিতে ভেসে গেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন খামারের মালিক। আরএমএ মৎস্য খামারের মালিক ভিপি পলাশ জানান, বৃষ্টিতে আমার খামারের অসংখ্য মাছ পানিতে ভেসে গেছে। তবে জেলা শহর মাইজদীতে বিভিন্ন সড়কে শুক্রবার বৃষ্টি না থাকায় কমতে শুরু করেছে। এদিকে টানা বৃষ্টিতে নোয়াখালী সদর, কোম্পানীগঞ্জ, বেগমগঞ্জ, কবিরহাট, সুবর্ণচরে বেশি জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। মুষলধারে অব্যাহত বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা পরিস্থিতি অবনতি হয়েছে। অনেকের বসতঘরে পানি ঢুকেছে। এ চারটি উপজেলার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার মুছাপুর, রামপুর ও চর এলাহী ইউনিয়নের ছোট ফেনী নদী ও বামনী নদীর তীরবর্তী এলাকা বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে। মুছারপুর ইউনিয়নের বেশির ভাগ সড়ক ডুবে গেছে। জলমগ্ন হয়ে পড়েছে অনেক বাড়িঘর ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এতে লোকজন সীমাহীন ভোগান্তির মধ্যে পড়েছে। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার ইসরাত নাছিমা জানান, টানা বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতার কারণে ১ হাজার ২৫৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয় শনিবার পর্যন্ত বন্ধ রাখা হয়েছে।
নোয়াখালী জেলা প্রশাসক খন্দকার ইশতিয়াক আহমেদ বলেন, জলাবদ্ধতা ও বন্যা মোকাবিলায় জেলা প্রশাসনের সার্বিক প্রস্তুতি রয়েছে। কুড়িগ্রাম : উজান থেকে নেমে আসা ঢলে তিস্তা নদীর পানি দ্রুত বাড়তে শুরু করেছে। পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদীসমূহের পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগামী দুই দিন এ নদীগুলোর পানি সমতল বৃদ্ধি পেতে পারে। কুড়িগ্রামের পাউবো নিয়ন্ত্রণ কক্ষের প্রতিবেদন বলছে, তিস্তার পানি রংপুরের কাউনিয়া পয়েন্টে ২২ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার মাত্র ৫০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ধরলা, দুধকুমার ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানিও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে সেগুলো এখনো বিপৎসীমার অনেকটাই নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
কলাপাড়া (পটুয়াখালী) : ভারী বৃষ্টিপাতে পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় শত শত গ্রাম পানিতে তলিয়ে আছে। নষ্ট হয়ে গেছে বর্ষাকালীনসহ নানান ধরনের সবজির খেত। ভেসে গেছে ঘেরের মাছ। গত দুই সপ্তাহ ধরে আকাশ কালো মেঘে ঢাকা এবং ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে সূর্যের দেখা মেলেনি। স্থানীয়দের সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়ে কৃষক রোপা আমন চাষাবাদে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। জলাবদ্ধতায় শত শত পরিবার এখনো পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। অতিরিক্ত বৃষ্টির অনেক ঘের কিংবা পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। অনেক জাল দিয়ে আটকিয়ে মাছ রক্ষার চেষ্টাও করছে। এ ছাড়াও বর্ষাকালীন সবজির খেতে পানি জমে শসা, চিচিঙ্গা, ঢেঁড়শ, করলা, কাঁচা মরিচসহ নানান সবজির খেত পচে গেছে। অধিকাংশ গ্রামবাসীর অভিযোগ, উপজেলার অধিকাংশ ইউনিয়নে বিভিন্ন খালের বাঁধ আটকে রেখে প্রভাবশালী মহল মাছ শিকার করছে। এ বাঁধ অপসারণ না করলে অতি শিগগিরই এ জলাবদ্ধতা নিরসন হবে না বলে তারা জানিয়েছেন।
নীলগঞ্জ ইউনিয়নের কুমিরমারা গ্রামে মো. সুলতান জানান, তার অধিকাংশ সবজির খেত নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে। অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকার কারণে তার অনেক ক্ষতি হবে বলে তিনি জানান।
কৃষক মো. খলিলুর রহমান জানান, বিভিন্ন স্থানের খালে বাঁধ থাকায় পানি নিষ্কাশন হচ্ছে না। তিনি বাঁধ অপসারণে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রবিউল ইসলাম জানান, কৃষকদের স্বার্থে জলাবদ্ধতা নিরসনে উপজেলার সব খালের বাঁধ পর্যায়ক্রমে অপসারণ করা হবে।