রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতালের পাশে ভাঙারি ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে হত্যায় চারজনকে আটক করেছে র্যাব ও পুলিশ। ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে বহিষ্কার করা হয়েছে যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের চার নেতাকে। নৃশংস এ হত্যার প্রতিবাদে গতকাল রাতে ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে হয়েছে বিক্ষোভ।
ব্যবসায়ী সোহাগকে হত্যায় জড়িত গ্রেপ্তার চারজনের মধ্যে মাহমুদুল হাসান মহিন ও তারেক রহমান রবিনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ এবং অন্য দুজনকে গ্রেপ্তার করেন র্যাব-১০ এর সদস্যরা। গতকাল এ তথ্য জানান ডিএমপির ডিসি (মিডিয়া) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান। তিনি বলেন, গত বৃহস্পতিবার পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালের পাশে সন্ত্রাসীরা ভাঙারি ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে কুপিয়ে ও পাথর দিয়ে মাথায় আঘাত করে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এ ঘটনায় নিহতের বড় বোন মঞ্জুয়ারা বেগম বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশ ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে এবং রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে এজাহারনামীয় আসামি মহিন ও রবিনকে গ্রেপ্তার করে। এ সময় রবিনের কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল উদ্ধার করা হয়। প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব এবং পূর্বশত্রুতার জের ধরে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত অন্যদের ধরতে অভিযান চলছে। তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার সোহাগের নিথর দেহ টেনেহিঁচড়ে সড়কে এনে শত শত মানুষের সামনে চলে উন্মত্ততা। সন্ত্রাসীদের আতঙ্কে কেউ এগিয়ে আসেনি। ঘটনাস্থলের একটি সিসি ক্যামেরার ফুটেজ এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এ ঘটনায় নেটিজেনদের মাঝে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়। একজন বলছেন, চাঁদা না পেয়ে পাথর দিয়ে নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যার ঘটনাটি আইয়ামে জাহেলিয়ার যুগকেও হার মানিয়েছে। জড়িত যেই হোক তাদের দ্রুত গ্রেপ্তার করতে হবে। ভিডিওতে দেখা যায়, নিথর দেহ টেনেহিঁচড়ে নিয়ে আসা লোকদের মধ্যে একজন মোবাইলে কথা বলছিল। ওই সময় আরেকজন সোহাগের রক্তাক্ত মুখের ওপর কিলঘুসি দিতে থাকে। অন্য এক তরুণ দৌড়ে এসে পড়ে থাকা নিথর দেহের বুকের ওপর লাফাচ্ছিল! মানুষজনও দেখছিল এমন ভয়ংকর দৃশ্য। একজন নয়, একাধিক যুবক মৃত ব্যক্তির নাক-মুখ এবং বুকের ওপর পাথর দিয়ে আঘাত করতে থাকে। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র বলছে, নিহত সোহাগ মিটফোর্ড এলাকায় ভাঙারি ব্যবসার সঙ্গে পুরোনো বৈদ্যুতিক ক্যাবল কেনাবেচা করতেন। ওই এলাকায় বিদ্যুতের তামার তার ও সাদা তারের ব্যবসার একটা সিন্ডিকেট রয়েছে। সাবেক সরকারের আমলে এর নিয়ন্ত্রণ ছিল সোহাগের কাছে। ওর কাছ থেকে ওই সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া ছিল মহিন ও টিটু। তারা ওই অবৈধ বাণিজ্যের ৫০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ চেয়েছিল। তা না হলে নিয়মিত চাঁদা দেওয়ার দাবি জানিয়েছিল তারা। এরই জেরেই দ্বন্দ্ব শুরু হয়। সেই দ্বন্দ্বে ঘটে নৃশংস হত্যাকাণ্ড। স্থানীয়রা বলছেন, নিহত সোহাগ ও হামলায় নেতৃত্ব দেওয়া মহিন, টিটুসহ জড়িত অন্যরাও ৩০ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত।
চারজন বহিষ্কার : গতকাল সন্ধ্যায় পৃথক বিজ্ঞপ্তিতে যুবদল, ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দল পুরান ঢাকার এ হত্যার ঘটনায় চারজনকে সংগঠন থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কারের কথা জানিয়েছে। তারা হলেন যুবদলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সাবেক জলবায়ুবিষয়ক সহসম্পাদক রজ্জব আলী (পিন্টু) ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক সাবাহ করিম (লাকি), চকবাজার থানা ছাত্রদলের সদস্যসচিব অপু দাস ও স্বেচ্ছাসেবক দলের কালু ওরফে স্বেচ্ছাসেবক কালু।
উত্তাল ক্যাম্পাস, নিন্দার ঝড় : হত্যার প্রতিবাদে গতকাল বিভিন্ন ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন শিক্ষার্থীরা। সন্ধ্যার পর বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে ক্যাম্পাসগুলো। রাতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের হল পাড়া থেকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়ে ভিসি চত্বরে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ হয় এবং পরবর্তী সময়ে মিছিলটি রাজু ভাস্কর্যের সামনে এসে শেষ হয়। ঢাবি ছাত্রদলও এ হত্যার নিন্দা জানিয়ে বিক্ষোভ করে। এদিকে রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন। রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে এ বিক্ষোভ সমাবেশ করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তারা বলেন, সোহাগকে যেভাবে পাথর দিয়ে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে, তা বর্বরতা ও মানবতার চরম লঙ্ঘন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিরো পয়েন্ট থেকে মিছিল বের করেন গত রাতে। মিছিলটি সোহরাওয়ার্দী মোড়, আলাওল হল ও এ এফ রহমান হল প্রদক্ষিণ করে আবার জিরো পয়েন্টে এসে সমাবেশের মাধ্যমে শেষ হয়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। এ সময় শিক্ষার্থীরা বিএনপি ও তার অঙ্গসংগঠনের বিরুদ্ধে স্লোগান দেন।
বিএনপি যা বলছে : গতকাল রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, মিটফোর্ডের ঘটনায় সিরিয়াস ব্যবস্থা নেওয়ার পরও বিএনপির ওপর দায় চাপানো অপরাজনীতি, নোংরা রাজনীতির চর্চা। বিএনপি ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠন কোনো অপরাধীকে কখনো প্রশ্রয় দেয় না, কোনোদিন দেবেও না। এক্ষেত্রে বিএনপির অবস্থান ‘জিরো টলারেন্স’। তিনি বলেন, ঘটনার ভিডিও ফুটেজে যুবদল, ছাত্রদল, স্বেচ্ছাসেবক দলের যাদের দেখা গেছে, তাদের মামলায় আসামি করা হয়েছে। তাদের সংগঠন থেকে আজীবন বহিষ্কার করা হয়েছে।
জামায়াতের নিন্দা : বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার এক বিবৃতিতে বলেন, প্রকাশ্য দিবালোকে মাথায় পাথর মেরে শত শত মানুষের সামনে এ হত্যার ঘটনা আইয়ামে জাহেলিয়াতকেও হার মানিয়েছে। এভাবে পাশবিক কায়দায় মানুষ হত্যা সভ্য সমাজে বিরল। ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি মো. জাহিদুল ইসলাম বলেছেন, এ কেমন নির্মমতা। হত্যার পর তার লাশের ওপর নৃত্য করা হয়েছে। এ দৃশ্য ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরকে স্মরণ করিয়ে দিল। গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি ও নির্বাহী সমন্বয়কারী আবুল হাসান রুবেল এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন- এটি অত্যন্ত নির্মম ও ভয়ংকর। গণ অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে এ নৃশংসতার রাজনীতি আর চলতে পারে না।