ঈসা (আ.)-কে আকাশে তুলে নেওয়ার কিছুকাল পরের ঘটনা। ইয়েমেনের রাজধানী ও প্রসিদ্ধ শহর সানা থেকে ছয় মাইল দূরের দারওয়ানে ছিল এক বাগান। (তাফসিরে ইবনু কাসির : ৪/৪০৬)
বিশাল বিস্তৃত জায়গাজুড়ে নানা জাতের এবং বিভিন্ন প্রকারের ফলবান বৃক্ষে সবুজ-শ্যামল ছিল সে বাগান। বাগানের মালিক ছিলেন আল্লাহ বিশ্বাসী। ছিলেন সৎ ও আল্লাহভীরু। তিনি ফল-ফসল কাটার সময় প্রতিবারই নিয়ম করে কিছু ফসল এলাকার গরিব-মিসকিনদের জন্য রেখে দিতেন। ফল-ফসল মাড়ানোর সময়ও যেসব দানা ভুসিতে থেকে যেত, তা ফকির-মিসকিনদের দিয়ে দিতেন। ফল-ফসল কাটার মৌসুম বা আহরণের সময় প্রথমে গরিব মানুষের মধ্যে বিলি করতেন তিনি।
স্থানীয় গরিব-মিসকিনরা সময় ধরে ধরে বাগানে আসতেন। উপকৃত হতেন। খুশি হতেন। আল্লাহ খুশি ছিলেন তাঁর প্রতি।
(তাফসিরে মাআরেফুল কোরআন, মুফতি মুহাম্মাদ শফি, অনুবাদ : মাওলানা মুহিউদ্দিন খান, পৃষ্ঠা-১৩৯৭)
বিশ্বাসী মানুষটি একদিন মারা গেলেন। বাগান ও ক্ষেতের উত্তরাধিকারী পেল তাঁর তিন ছেলে। ছেলেরা একজন আরেকজনকে বলল, আমরাই তো পোষ্যদার। সবার সন্তান-সন্তুতি আছে। পরিবার-পরিজন বেড়েছে। আমাদেরই তো সংসার চালাতে কষ্ট হয়। বাবার মতো ফকির-মিসকিনদের দান করলে সংসার চলবে কিভাবে। বাবার রেখে যাওয়া প্রথা বন্ধ করতে হবে। কেউ একজন বলল, তিনি বোকা ও বড় নির্বোধ ছিলেন। বিরাট সম্পদ ফকির-মিসকিনদের বিলিয়ে দিতেন। আমরা তাঁর মতো নির্বোধ নই।
তাদের মেজো ভাইটি ছিল পরিমিতিবোধসম্পন্ন। সে বলল, এ কাজ ঠিক হবে না। নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা আদায় করতে হবে। আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখতে হবে। গরিব-মিসকিনদের দান-সদকা করতে হবে। তারা তার কথা কানে নিল না। (তাফসিরে মাআরেফুল কোরআন, মাওলানা মুহাম্মাদ ইদরিস কান্ধলভি, অনুবাদ : মুফতি মুহাম্মাদ আব্দুল হালীম, খণ্ড-৮, পৃষ্ঠা-২৪৫)
মৌসুমে শস্যে ভরপুর হলো ফসলি জমিন। নানা ফলদে পরিপূর্ণ হলো বাগান। বাগানের ফল ও জমিনের শস্য কেটে আনার সময় বয়ে যায়। তারা পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিল, ফল পাড়া ও ফসল কাটার জন্য খুব ভোরে অন্ধকার থাকতে বাগানে পৌঁছতে হবে। ফকির-মিসকিনরা বাগানে পৌঁছার আগেই ফল ও ফসল নিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে। এর মধ্যে ফকির-মিসকিনরা ভিড় করলেও তাদের তাড়িয়ে দেওয়া হবে। জাকাতও দেওয়া হবে না। দান-সদকাও নয়। সর্বোপরি তারা আল্লাহকে ভয় করল না। ইনশাআল্লাহও বলল না। (কাসাসুল কোরআন, মাওলানা হিফজুর রহমান, অনুবাদ : আবদুস সাত্তার আইনী, খণ্ড-৭, পৃষ্ঠা-৫)
খুব ভোরে তারা ঘুম থেকে উঠল। বাড়ি ছাড়ল। চুপিসারে কথাবার্তা বলল। ধীর ও সন্তর্পণে বাগানের পথে চলল। যেন ফকির-মিসকিনরা টের না পায়। গন্তব্যে পৌঁছে ক্ষেত ও উদ্যান কিছুই পেল না। শুধু শূন্য ভূমি। ফল ও ফসলের চিহ্নও নেই কোথাও। বিবর্ণ কাটা ফসলের মতো। যেন এখানে কখনো ফল-ফসল বা ক্ষেত-উদ্যান ছিল না। একজন আরেকজনকে বলল, ‘আমরা অন্ধকারে ভুল গন্তব্যে এসেছি। পথ বদলাতে হবে। আমাদের বাগান তো অতি সজীব ও সবুজ-শ্যামল। বাগানের দিকে চলো।’ তারা একটু সামনে বাড়ল। কিছুটা হাঁটল এদিক-সেদিক। আশপাশ ও নিকটবর্তী জায়গা ভালো করে যাচাই করে বুঝতে পারল, গন্তব্যস্থল ঠিকই আছে। নেই শুধু ফল ও ফসল। বাগান ও ক্ষেত পুড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
তাদের অবাধ্যতা, অকৃতজ্ঞতা ও গরিব-মিসকিনের হক আদায় না করার সংকল্পের কারণে আল্লাহ বাগান ধ্বংস করে দিলেন। আল্লাহর নির্দেশে প্রচণ্ড ও উত্তপ্ত বাতাস যখন বাগান পুড়ে ভস্ম করে দিয়েছে, তখন তারা ছিল ঘুমে বিভোর। তারা বুঝতে পারল, তাদের কৃপণতা, কুপরামর্শ ও আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় না করার কারণে এ পরিণতি হয়েছে। তারা আফসোস ও আক্ষেপ করতে থাকল। পরস্পরকে দোষারূপ করল। মেজো ভাই সতর্কতার কথা স্মরণে আনল। তারা আল্লাহর কাছে তাওবা করল। পবিত্র কোরআনে ঘটনাটি ‘আসহাবুল জান্নাহ’ নামে উল্লেখ করা হয়েছে।
আল্লাহ বলেন, ‘আমি এদের (অর্থাৎ মক্কাবাসীদের) পরীক্ষা করেছি, যেমন আমি বাগানের মালিকদের পরীক্ষা করেছিলাম। যখন তারা কসম করে বলেছিল যে তারা সকালবেলায় অবশ্যই বাগানের ফল সংগ্রহ করে নেবে। তারা ‘ইনশাআল্লাহ’ বলেনি। অতঃপর তোমার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে বাগানে এক বিপদ এসে পড়ল, যখন তারা ছিল নিদ্রিত। তারা বলল, ‘দুর্ভোগ আমাদের, আমরা ছিলাম সীমা লঙ্ঘনকারী, যার ফলে তা হয়ে গেল বিবর্ণ কাটা ফসলের মতো।
সকালে একে অপরকে ডেকে বলল, তোমরা যদি ফল সংগ্রহ করতে চাও তবে সকাল সকাল ক্ষেতে চলো।’ তারা চুপি চুপি কথা বলতে বলতে চলল। ‘আজ যেন সেখানে তোমাদের কাছে মিসকিনরা অবশ্যই ঢুকতে না পারে।’ তারা এক (অন্যায়) সিদ্ধান্তে সংকল্পবদ্ধ হয়ে সকাল করল। অতঃপর তারা যখন বাগানটি দেখল, তখন তারা বলল, ‘আমরা অবশ্যই পথ হারিয়ে ফেলেছি। (অতঃপর ব্যাপারটি বুঝতে পারার পর তারা বলে উঠল) বরং আমরা তো কপাল পোড়া।’
তাদের মধ্যকার সবচেয়ে ভালো লোকটি বলল, ‘আমি কি তোমাদের বলিনি যে তোমরা আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করছ না কেন?’ তারা বলল, ‘আমরা আমাদের প্রতিপালকের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করছি, আমরা সীমা লঙ্ঘনকারীই ছিলাম।’ অতঃপর তারা একে অপরের দিকে এগিয়ে গিয়ে পরস্পরের প্রতি দোষারোপ করতে লাগল। সম্ভবত আমাদের প্রতিপালক এর পরিবর্তে আমাদের উত্তম (বাগান) দেবেন, আমরা আমাদের প্রতিপালকের অভিমুখী হলাম।’ (সুরা : কলাম, আয়াত : ১৭-৩২)
এ ঘটনা কোথায় ঘটেছিল কোরআনে এর উল্লেখ নেই। বেশির ভাগ বক্তব্য হলো ঘটনাটি ইয়েমেনে ঘটেছিল। হাফেজ ইবনু কাসির (রহ.) প্রখ্যাত তাবেঈ সাইদ ইবনু জুবায়ের (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, ‘তারা দারওয়ান নামক জনপদের অধিবাসী ছিল। এটি সানা থেকে ছয় মাইল দূরে অবস্থিত। বর্তমানেও দারওয়ান জনপদটি সানা থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত। ওখানকার আলেমরা বলেন, ইয়েমেনে এ কথা প্রসিদ্ধ যে এটিই সেই জনপদ, যেখানকার ঘটনা পবিত্র কোরআনের সুরা কলামে বর্ণনা করা হয়েছে।’ (দেশ-দেশান্তর, মুফতি মুহাম্মাদ তকি উসমানি, অনুবাদ : আবদুস সাত্তার আইনী, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-৩১২)
কিছু মুফাসসির বলেন, ‘ওই ঘটনার লোকজন হাবশা অঞ্চলে বাস করত। তারা আহলে কিতাব ছিল। (সিরাত বিশ্বকোষ, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-২৬৮)
লেখক : আলেম ও সাংবাদিক