পাহাড়ি ঝরনার সৌন্দর্যই আমরা দেখি। বিমোহিত হই। কিন্তু তার কান্না কি কেউ শুনেছে কখনো? শোনার মানুষ নেই। এ নিয়েই দুটি কথা বলতে চাই। এখন বর্ষা। তাই রূপবতী পাহাড়ি ঝরনা। নৈসর্গিক সৌন্দর্য। নানা বৈচিত্র্যে ভরপুর ঝরনার আশপাশ। সবুজের বুক চিরে অবিরাম ঝরছে জলধারা। মিশে যাচ্ছে হ্রদ পাহাড়ের বুকে। ঝরনার জলকণাগুলো নীল আকাশে তৈরি করছে শুভ্র সাদা মেঘের ভেলা। এমন হৃদয় হরণ করা সৌন্দর্য আর বিস্ময়কর প্রাকৃতিক প্রাচুর্য শুধু রাঙামাটিতেই দৃশ্যমান। এ ঝরনার টানে প্রতিদিন দূরদূরান্ত থেকে ছুটে যান হাজারো পর্যটক। তারা সৌন্দর্য উপভোগ করলেও ঝরনার গোপন গুমরে কান্না শুনতে পান না কেউ। কারণ বর্ষায় ভরা যৌবন থাকলেও ঋতু বদলালেই, বদলে যায় ঝরনার চিত্র। ছয় ঋতুর মধ্যে বর্ষা পাহাড়ি ঝরনার জন্য আশীর্বাদ। বাকি পাঁচ ঋতুতে সে মøান। বলা যায়, থাকে না ঝরনার অস্তিত্বই। দুর্ভাগ্য হচ্ছে, কেন ঝরনার নিত্য এ মরণদশা, তা জানতে এগিয়ে আসেন না কেউ। প্রতিকারের পথও খোঁজেন না।
রাঙামাটি শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে বরকল উপজেলার সুবলং ইউনিয়ন। সেখানে আছে প্রায় ১০০টি পাহাড়ি ঝরনা। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় ঝরনাটির উচ্চতা প্রায় ৩০০ ফুট। তাই বেশি আকর্ষণীয় ও পরিচিত পর্যটকদের কাছে। এর নামকরণ করা হয় ‘গিরি নির্ঝর’ ঝরনা। এ ঝরনার জলধারার নিক্বণ ধ্বনিসহ অপরূপ দৃশ্য না দেখলে, কল্পনায়ও সে ছবি আঁকা অসম্ভব। ঝরনার জলরাশি সাঁই সাঁই করে ধেয়ে চলে ঝিরি আর কাপ্তাই হ্রদ প্রান্তে। বহু আগেই দেশ-বিদেশে এ ঝরনার ব্যাপক পরিচিতির বিস্তৃতি ঘটে। কিন্তু কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে এই ঝরনারও রূপ-সৌন্দর্য। বর্ষা শেষ হতে না হতেই মরে যায় ঝরনা। শুকিয়ে যায় পানির প্রবাহ। দেখে হতাশ হন পর্যটকরা। কিন্তু কেন এমন হচ্ছে? কেউ খুঁজে দেখেননি কখনো। কী দুর্ভাগ্য!
অভিযোগ, রাঙামাটিতে শুধু পাহাড়ি ঝরনা নয়, একই অবস্থা ছড়াগুলোরও। শুষ্ক মৌসুমে শুকিয়ে যায় ছড়া, ঝরনা ও হ্রদ। হুমকিতে আছে কর্ণফুলীর উৎপত্তিস্থল পাহাড়ি ঝরনাও। এত কিছু হলেও কেউ খবর রাখে না প্রকৃতির। ঝরনা পাড়ের বড় বড় গাছ কাটা। বনজঙ্গল উজাড়। নানা মানবিক অবিবেচক নির্যাতনে পানি ধরে রাখার ক্ষমতা হারিয়েছে পাহাড়। তাই তো মরে যাচ্ছে ঝরনা আর ছড়া।
এমন ঝরনা রয়েছে কাউখালী উপজেলার ঘাগড়া ইউনিয়নে। যা ঘাগড়া ঝরনা হিসেবে পরিচিত। রাঙামাটি শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে ঘাগড়া ইউনিয়ন। প্রধান সড়ক থেকে হেঁটে পাড়ি দিতে হবে আরও এক ঘণ্টার পাহাড়ি পথ। তারপর দেখা মিলবে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যময় ঘাগড়া ঝরনার। এ ঝরনার টানে রাঙামাটিতে প্রায়ই ভিড় থাকে পর্যটকদের। কিন্তু সে ঝরনাও এখন অস্তিত্বসংকটে। যেখানে মানুষের প্রবেশ, সেখানেই পরিবেশ নিধন! ঝরনার আশপাশে জুমচাষ। বনজঙ্গলে আগুন আর বৃক্ষ নিধনে সংকটে রয়েছে রাঙামাটির প্রায় সব ঝরনা। একই অবস্থা বিলাইছড়ি ঝরনার। এখন তারও মরণদশা। এটা প্রকৃতই পরিতাপের। ঝরনাগুলো সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। শুষ্ক মৌসুমে ঝরনার জলধারা শুকিয়ে গেলেও বর্ষায় নিজ রূপবৈচিত্র্যে ফিরে আসে গিরি নির্ঝর। বর্তমানে বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় ঝরনাগুলোতে সেই অপরূপ দৃশ্য এখন বজায় রয়েছে। বছরজুড়ে এ প্রবাহ ধরে রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রকৃতি ও পর্যটনসহ সংশ্লিষ্ট সব দায়িত্বশীল অংশীজনের কর্তব্য।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী