করোনা মহামারির সময় যখন কর্মহীন হয়ে পড়েছিল, তখন আলেমদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান তৈরির লক্ষ্যে শুরু হয়েছিল কওমী উদ্যোক্তা। একটি সামাজিক উদ্যোগ হিসেবে শুরু হলেও ধীরে ধীরে তা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে। কওমী উদ্যোক্তা এখন পর্যন্ত কয়েক হাজার আলেম উদ্যোক্তা তৈরি করেছে। প্রতিষ্ঠানটি তরুণ আলেমদের শুধু অনুপ্রেরণা দেয় না, তারা চেষ্টা করে হাতে-কলমে সহায়তা করতে।
ব্যবসার আইডিয়া, ট্রেনিং, বিভিন্ন সার্ভিস, ইনভেস্টমেন্টসহ সব কিছুতে উদ্যোক্তাদের সাহায্য করা হয় কওমী উদ্যোক্তার পক্ষ থেকে।
কওমী উদ্যোক্তার একটি সাম্প্রতিক উদ্যোগ হলো আলেমদের ‘হালাল ফান্ডিং’-এর পথ দেখানো। এ লক্ষ্যে তারা বিনিয়োগ ডট আইওর সঙ্গে কাজ করছে। বিনিয়োগ ডট আইও হচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম শরিয়াহ-সার্টিফায়েড অল্টারনেটিভ ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যাটফর্ম, যেখানে সাধারণ মানুষ শরিয়াহসম্মত চুক্তির আওতায় বিভিন্ন লাভজনক ব্যবসায় বিনিয়োগের জন্য সংযুক্ত হতে পারে।
প্ল্যাটফর্মটি সব প্রক্রিয়া এবং লেনদেন IFA Consultancy দ্বারা শরিয়াহ কমপ্লায়েন্ট হিসেবে সার্টিফায়েড, যারা বাহরাইনভিত্তিক AAOIFI-এর ইসলামিক ফাইন্যান্স স্ট্যান্ডার্ড অনুসরণ করে। কওমী উদ্যোক্তার ফাউন্ডার রোকন রাইয়ানকে তাঁদের সাম্প্রতিক উদ্যোগের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম। তিনি বলেন, ‘আমরা চাই, আলেমরা আত্মনির্ভর হোক, নিজ পায়ে দাঁড়াক। অনেক কওমী তরুণ ব্যবসা শুরু করতে চান, কিন্তু সঠিক দিকনির্দেশনা বা হালাল ফান্ড না থাকায় পিছিয়ে পড়েন। আবার এমন অনেক ইনভেস্টর আছেন, যাঁরা হালালভাবে ইনভেস্ট করতে চান, কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য প্ল্যাটফর্ম কিংবা উদ্যোক্তা খুঁজে পান না। আমরা দুই পক্ষ বিশ্বস্ত উদ্যোক্তা আর শরিয়াহ সচেতন ইনভেস্টরদের এক প্ল্যাটফর্মে আনার প্রয়োজনটা অনেক দিন ধরেই অনুভব করছিলাম। সেই থেকেই এই উদ্যোগ।’
কওমী উদ্যোক্তার কো-ফাউন্ডার মুমিনুল ইসলাম বলেন, ‘হালাল ফান্ডিংসংক্রান্ত তাঁদের এই উদ্যোগের কারণে আলেমরা এখন বুঝতে পারছেন ব্যবসা করা এবং ব্যবসা বড় করা তাঁদের জন্যও সম্ভব। শুধু সম্ভব না, বরং হালালভাবে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর একটা শক্ত রাস্তা এটি। পাশাপাশি তাঁরা কিভাবে ব্যবসা শুরু করতে হয়, কোন খরচটা কোথায় লাগবে, হিসাব কিভাবে রাখতে হয়, ডকুমেন্টেশন এবং কমপ্লায়েন্সের জায়গাগুলো কী কী—এসব হাতে-কলমে শেখার সুযোগ পাচ্ছেন। তাঁদের ভেতর থেকে আত্মবিশ্বাস তৈরি হচ্ছে, কওমি আলেমরাও ব্যবসায়ে সফল হতে পারেন।’
বিনিয়োগে মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিনিয়োগ ডট আইও কতটা নির্ভরযোগ্য? এমন প্রশ্নের উত্তরে রোকন রাইয়ান বলেন, আলহামদুলিল্লাহ, বিনিয়োগ ডট আইও ২০২১ সালে শুরু করার পর তাদের স্বচ্ছতা, রিপোর্টিং আর জবাবদিহির কারণে উদ্যোক্তা এবং বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একটা আস্থার জায়গা তৈরি করেছে। এ পর্যন্ত বিনিয়োগ ডট আইও ২৫০টিরও বেশি বিজনেসের সঙ্গে কাজ করে আট হাজার ২০০টির বেশি ইনভেস্টমেন্টের মাধ্যমে ৬৯ কোটির টাকার বেশি ফান্ড উদ্যোক্তাদের হাতে পৌঁছে দিয়েছে। তারা শুরু থেকেই দেশের স্বনামধন্য শরিয়াহ অ্যাডভাইজরি প্রতিষ্ঠান IFA Consultancy-এর শরিয়াহ বোর্ডের অধীনে কাজ করছে।
তিনি বিনিয়োগ ডট আইওর সঙ্গে নেওয়া যৌথ উদ্যোগে কওমী উদ্যোক্তার ভূমিকা সম্পর্কে বলেন, ‘কওমী উদ্যোক্তা এখানে শুধু একটা কমিউনিটি প্ল্যাটফর্ম না, বরং একজন বিশ্বাসযোগ্য গাইডের মতো পাশে দাঁড়ায়। আমরা এমনভাবে সহযোগিতা করি যেন একজন আলেম শুধু প্রজেক্ট সাবমিট না করে, বরং পুরো ফান্ডিং প্রসেসটা বুঝে নিজের প্রজেক্টটা ঠিকমতো উপস্থাপন করতে পারেন। আমাদের মূল চাওয়া একটাই, একজন উদ্যোক্তা যেন সত্ভাবে, আত্মবিশ্বাস নিয়ে ইনভেস্টরের সামনে দাঁড়াতে পারেন। আর ইনভেস্টমেন্ট পাওয়ার পর সেই আমানতের দায়িত্ব যেন সময়মতো, যথাযথভাবে পরিশোধ করতে পারেন—এই নীতিকেই আমরা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিই।’
রোকন রাইয়ানের প্রত্যাশার প্রতিফলন দেখা গেছে কওমী উদ্যোক্ততার উদ্যোগে। সম্প্রতি তারা ‘হালাল ফান্ডিং ও উদ্যোক্তার বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক একটি কর্মশালার আয়োজন করেছিল। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত কর্মশালায় ৬৫ জনেরও বেশি তরুণ আলেম অংশ নেন। যাঁদের অনেকেই ব্যবসা করছেন এবং তাঁরা ইনভেস্ট পেতে আগ্রহী।
কওমী উদ্যোক্তার প্রত্যাশা হলো, এমন একটা টেকসই ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যা উদ্যোক্তাদের বাস্তবে কাজে দেয়। যাতে একজন কওমী তরুণ উদ্যোক্তা শুধু ছোটখাটো ব্যবসা না করে, ইনভেস্টমেন্ট এবং ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল ফাইন্যান্সিং নিয়ে বড় পরিসরে কাজ করতে পারেন, কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারেন এবং নিজের পরিবার ও সমাজের দায়িত্ব নিতে পারেন। এই প্রত্যাশা পূরণে তারা বেশ কিছু উদ্যোগও গ্রহণ করেছে।
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন