মহানবী (সা.) মদিনায় হিজরত করার পর সেখানে যে ইসলামী রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন হয়েছিল, তা মূলত মক্কার ১৩ বছরব্যাপী প্রশিক্ষণমূলক কর্মযজ্ঞের যৌক্তিক পরিণতি ও ফল ছিল। তাই একটি সংগঠিত ও সভ্য সমাজ এবং রাষ্ট্রের জন্য জনসাধারণের নৈতিক শিক্ষা, চরিত্র গঠন ও আত্মিক পরিশুদ্ধি (তাজকিয়ায়ে নফস) মৌলিক শর্ত।
নৈতিক শিক্ষা ও আত্মিক পরিশুদ্ধির স্বাভাবিক ফল হচ্ছে রাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ ও সমতা, যা একটি উচ্চ লক্ষ্যের মাধ্যমে রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা অর্জনে কাজে লাগানো হয়। সেই উচ্চ লক্ষ্য হলো, আল্লাহর সন্তুষ্টি।
যখন এই লক্ষ্য অন্তরে জন্ম নেয়, তখন শত্রুকেও বন্ধু বানাতে বেশি সময় লাগে না। মহান আল্লাহ বলেন, ‘স্মরণ করো সেই সময়কে যখন তোমরা একে অন্যের শত্রু ছিলে, তখন তিনি (আল্লাহ) তোমাদের হৃদয়ে ভালোবাসা সৃষ্টি করে দিলেন এবং তাঁর অনুগ্রহে তোমরা ভাই ভাই হয়ে গেলে।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১০৩)
মুমিনদের এই দল ধারাবাহিকভাবে দুঃখ-কষ্ট ও বিপদের মধ্য দিয়ে হিজরতের কঠিন ধাপ অতিক্রম করে যখন মদিনায় পৌঁছল, তখন তারা কিছু মূলনীতি নির্ধারণ করে নেয়। সেই নীতিগুলো অনুসরণ করার ফলেই একটি ছোট্ট এলাকাভিত্তিক রাষ্ট্র মদিনা থেকে প্রসারিত হয়ে আরব উপদ্বীপ ছাড়িয়ে ইরাক, ইরান, সিরিয়া ও মিসর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে এবং মদিনাই হয় এই রাষ্ট্রের রাজধানী।
মদিনা রাষ্ট্রের মূলনীতি
মদিনার ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিগুলো ছিল নিম্নরূপ :
১. কোরআন ও সুন্নাহকে সর্বোচ্চ স্থান দেওয়া।
২. শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া।
৩. পক্ষপাতহীন বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।
৪. মৌলিক মানবাধিকার সবার জন্য সমভাবে নিশ্চিত করা।
৫. শাসকদের দায়িত্বপূর্ণ আচরণ এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করা।
৬. পরামর্শের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করা।
৭. নির্বাচিত ও মনোনীত নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য।
৮. নেতৃত্ব পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা পরিত্যাগ করা।
৯. রাষ্ট্রের উচ্চতর নৈতিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা। তা হলো আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বিন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানবজাতিকে মুক্তি দান করা।
১০. ভালো কাজে উৎসাহ ও মন্দ থেকে বিরত রাখার ব্যবস্থা তথা আমর বিল মারুফ ও নাহি আনিল মুনকার সমাজ ও রাষ্ট্রে সক্রিয় রাখা।
এই নীতিগুলোর বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়োজন নেই। কেননা প্রতিটি শিরোনামই নিজেই নিজের ব্যাখ্যা বহন করে। এটাই সেই ১০টি মূলনীতি, যা রাষ্ট্রের ভিত মজবুত করেছিল। মদিনার সমাজে প্রতিষ্ঠিত মুআখাত (ভ্রাতৃত্ব চুক্তি), মিসাক-এ-মদিনা (মদিনার সনদ), সুলহে হুদাইবিয়া (হুদাইবিয়ার সন্ধি) এবং বিভিন্ন সামরিক ও বেসামরিক অভিযান; সব শেষে মক্কার বিজয় সবকিছুকেই এই নীতির আলোকেই বিশ্লেষণ করা যায়। বস্তুত রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত ভিত্তিকে দৃঢ় করেছিল এই ১০টি নীতি।
মদিনা রাষ্ট্রের সাফল্য
উল্লিখিত মূলনীতির আলোকে রাষ্ট্র পরিচালনার ফলে মদিনার ইসলামী রাষ্ট্র অল্প সময়ে এমন অভাবনীয় সাফল্য লাভ করেছিল, যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। নিচে মদিনার ইসলামী রাষ্ট্রের কিছু অভাবনীয় সাফল্য তুলে ধরা হলো—
১. মদিনার ইসলামী শাসন ব্যবস্থা ছিল সব ধরনের অর্থহীন আড়ম্বর, ধ্বংসাত্মক প্রতারণা, ও ধনিক শ্রেণিভিত্তিক বিলাসিতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। এটা ছিল রাষ্ট্র পরিচালনার এমন এক আদর্শ কাঠামো, যা প্রকৃতপক্ষে জনগণের সম্পদে রূপান্তরিত হয়েছিল। কেননা তা আল্লাহর দ্বিন ও জনগণের অধিকারকে রাজনৈতিক ব্যবস্থার মূলভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছিল।
২. ইসলাম শাসন ব্যবস্থাকে ‘রাষ্ট্রীয় জনকল্যাণ’ হিসেবে চিহ্নিত করে এবং এতে এমন সারল্য সংযোজন করে যার ফলে সিংহাসন, রাজপ্রাসাদ, পাহারাদার, চাকরবাকর, উচ্চ বেতনের শাসক ও ঘুষখোর কর্মকর্তাদের বিলুপ্তি ঘটে। আর রাষ্ট্রের ওপর জনগণের সার্বিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
৩. ইসলাম রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে, ফলে বিচার সহজসাধ্য ও সুলভ হয়ে ওঠে। ন্যায়বিচারের মূল উদ্দেশ্য নির্ধারণ করে দুর্বলদের পক্ষে দাঁড়ানো এবং বিবদমান পক্ষদ্বয়ের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সমাধান নিশ্চিত করা; ক্ষতি বা ধ্বংস নয়। এ জন্য আমরা দেখি, রাষ্ট্রীয় আদালতে একজন অমুসলিমের বিপক্ষে বিচারে হেরে যাচ্ছেন একজন দায়িত্বরত খলিফা।
৪. ইসলামী রাষ্ট্র মানবাধিকার ও সমতার ঘোষণা দেয়, ন্যায্য কর আরোপ করে এবং এ উদ্দেশ্যে রাজস্ব বিভাগ প্রতিষ্ঠা করে ও কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেয়। ফলে রাষ্ট্রে আর্থিক ভারসাম্য, সমৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত হয়।
৫. ইসলাম সরকারি অর্থ ব্যয়ের জন্য আইন প্রণয়ন করে। এই আইনের অধীনে ধনীদের কাছ থেকে কর আদায় এবং দরিদ্রদের ওপর তা ব্যয় করা হয়। এতে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর হয়ে যায়।
৬. ইসলাম রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রশাসনিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করে। মদিনাকে রাজধানী করা হয়। বিভিন্ন অঞ্চলে শাসক নিযুক্ত করে প্রশাসনিক কার্যক্রমকে গতিশীল করা হয়। তবে এই নিয়োগের ভিত্তি ছিল নৈতিক চরিত্র, কাজের যোগ্যতা, জ্ঞান ও জনস্বার্থে কাজ করার সক্ষমতা।
৭. ইসলাম শুরাকে (পরামর্শ) শাসনব্যবস্থার আত্মা হিসেবে ঘোষণা দেয়। শাসনের মধ্যে কেন্দ্রীয় স্থিতি, শক্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার পর নির্দেশ দেওয়া যে রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম শুরা পদ্ধতির মাধ্যমে পরিচালিত হবে।
৮. ইসলামী রাষ্ট্র দেশ ও জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সেনাবাহিনী গঠন করে, যেখানে রাষ্ট্রপ্রধান নিজে যুদ্ধের ময়দানে অংশগ্রহণ করেন। তিনি অপরাধীদের দমন করতে বিরামহীন অভিযান পরিচালনা করেন। তবে যুদ্ধের ময়দানে পরিপূর্ণরূপে মানবিকতা বজায় রাখা হয়, বিজয়ের সময় ও বিজয়ের পর রক্তপাত রোধ করা হয় এবং শান্তিচুক্তির ক্ষেত্রে নতুন নীতিমালা প্রবর্তন করা হয়।
৯. ইসলামী রাষ্ট্রের শান্তি, শৃঙ্খলা, উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা দেখে শত্রুরাও মুগ্ধ হয় এবং তারা মিত্র হতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। রাষ্ট্র ও জনগণের স্বার্থ বিবেচনা করে রাষ্ট্রপ্রধান তা গ্রহণ অথবা বর্জন করেন।
১০. ইসলামী রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন রাজা, শাসক ও রাজ্যপ্রধানদের চিঠি লিখে এক আল্লাহর নামে একত্র হওয়ার আহবান জানায়। মূলত এটা ছিল বৈশ্বিক ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের এক আহবান, যা ঐশী নির্দেশনার আলোকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব মহানবী (সা.) করেছিলেন। এর মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করেছিলেন তিনি শুধু আরবের জন্য আসেননি, বরং তিনি সারা বিশ্বের জন্য কল্যাণের বার্তা নিয়ে এসেছেন।
আল্লাহ সবাইকে সঠিক জ্ঞান দান করুন। আমিন।