ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ‘নির্বাচনকালীন কর্তৃত্ব’ বাড়ানোসহ গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংস্কারে একগুচ্ছ প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
আরপিও সংশোধনের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, নির্বাচনে জোট করলেও নিজ দলের প্রতীকে (মার্কা) ভোট করতে হবে। ২০ অনুচ্ছেদে নতুন প্রস্তাবে বলা হয়েছে, একাধিক দল জোটগতভাবে/যৌথভাবে মনোনয়নের ক্ষেত্রে স্ব স্ব রাজনৈতিক দলের নির্ধারিত প্রতীক (প্রার্থীর দলের নিজস্ব প্রতীক) বরাদ্দ পাবে। অতীতে আওয়ামী লীগ, বিএনপির সঙ্গে জোট করে অন্য দলের প্রার্থীরা নৌকা বা ধানের শীষে ভোট করেছেন। বিদ্যমান আইন অনুযায়ী, জোট করার তিন দিনের মধ্যে কমিশনকে জানাতে হয় এবং অন্যের প্রতীক ব্যবহারের অনুমতি দিতে হয়। আরপিওর নতুন সংশোধনী এলে বড় দলের সঙ্গে জোট করলেও প্রার্থিতা প্রত্যাহারের পর যে দলের প্রার্থী ভোটে থাকবে তার নিজ দলের প্রতীকে ভোট করতে হবে।
অন্যদিকে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের মধ্যে মতবিরোধ হলে ইসির চাহিদা প্রাধান্য পাবে- এমন বিধান আরপিওতে যুক্ত করার কথা রয়েছে ইসির নতুন প্রস্তাবে। সেখানে আরও বলা হয়েছে, তফসিল ঘোষণার ৪৫ দিন আগেই প্রশাসন, পুলিশসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ইসির অধীনে চলে যাবে; সরকারি কর্মকর্তারা নির্দেশনা না মানলে শাস্তির ব্যবস্থা নিতে পারবে ইসি। এ ছাড়া দুই প্রার্থীর ভোট সমান হলে লটারির নিয়ম বিলোপ করে পুনঃভোটের আয়োজন, নির্বাচনি ব্যয় তদারকিতে কমিটি গঠন, দলের নির্বাচনি ব্যয় ও আয়-ব্যয়ের তথ্য ওয়েবসাইটে প্রকাশের বাধ্যবাধকতা আরোপ; প্রতীক বরাদ্দের আগেই মামলার নিষ্পত্তি; হলফনামায় অসত্য তথ্য দিলে ভোটের পরেও ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ; মিথ্যা অভিযোগ দিলে মামলা করার মতো বেশ কিছু প্রস্তাব ইসির বিবেচনায় রয়েছে।
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের শতাধিক সুপারিশ মিলিয়ে এসব প্রস্তাব এখন ইসির আলোচনায় রয়েছে। পরবর্তী কমিশন সভায় আরপিও সংশোধনের এসব প্রস্তাব চূড়ান্ত করার কথা। কমিশনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলে আরপিও সংশোধনের খসড়া উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে তোলা হবে। সেখানে অনুমোদন পেলে অধ্যাদেশ আকারে জারি করা হবে।
কর্তৃত্ব কোথায় বাড়বে : নির্বাচন কমিশনকে প্রাধান্য দিতে ‘কার্পণ্য বা কর্তব্যে অবহেলা’ করলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা চাইছে ইসি। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন আরপিওর ৫ অনুচ্ছেদে এ বিষয়ে নতুন দুটি দফা (৩ ও ৪) যুক্ত করার সুপারিশে করেছে। সরকার ও ইসির মধ্যে কোনো মতবিরোধ হলে ‘ইসির চাহিদাকে’ প্রাধান্য দেওয়ার বিষয়টিও আরপিওতে যুক্ত করার প্রস্তাব রয়েছে। এ ছাড়া কোনো কর্মকর্তা, কর্মচারী বা সরকারের কোনো বিভাগ কর্তব্যে অবহেলা করে থাকলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা/কর্মচারী বা বিভাগের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারবে ইসি। নির্বাচনের সময় ইসিকে সহায়তা করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে সরকারের সব নির্বাহী কর্তৃপক্ষের ওপর।
তত্ত্বাবধায়ক বা নির্বাচনকালীন সরকারের সময় সহায়তা পেতে ইসির তেমন বেগ পেতে হয় না। কিন্তু দলীয় সরকারের সময় ইসির চাহিদা কখনো কখনো সাড়া পায় না। এ নিয়ে অতীতে কোনো কোনো সিইসি উষ্মাও প্রকাশ করেছেন। নির্বাচনি কাজে বা ভোটের ফলাফলে প্রভাব খাটালে সরকারি কর্মকর্তাদের প্রত্যাহার করার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ইসি নির্দেশনাও দেয়। আরপিওর ৭ অনুচ্ছেদে দুটি নতুন অনুচ্ছেদ [৭(৭)(ঘ) ও ৭(৭)(ঙ)] যুক্ত করার প্রস্তাব রয়েছে। সেখানে বলা থাকবে, দায়ী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গৃহীত ব্যবস্থা চাকরি বই ও বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনে (এসিআর) উল্লেখ থাকতে হবে। সবশেষ গাইবান্ধা-৫ উপনির্বাচন পুরোপুরি বন্ধ করার পরও দায়ীদের বিরুদ্ধে ইসির সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি। নতুন বিধান যুক্ত হলে অনিয়মকারী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ায় এখতিয়ার বাড়বে ইসির। ‘নিরপেক্ষ ভোটের স্বার্থে’ নির্বাচনকালীন প্রশাসনের ওপর ইসির কর্তৃত্বের সময়ও বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। বলা হয়েছে, সংসদ ভেঙে যাওয়ার পর থেকে অথবা তফসিল ঘোষণার ৪৫ দিন আগে থেকে ফল ঘোষণার ১৫ দিন পর পর্যন্ত ইসির অনুমতি ছাড়া জেলা থেকে বিভাগীয় প্রশাসন-পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বদলি করা যাবে না। বিদ্যমান বিধানে তফসিল ঘোষণার পর থেকে এ কর্তৃত্বের সুযোগ রয়েছে। কোনো কর্মকর্তাকে বদলি বা প্রত্যাহার করার দরকার হলে ইসি এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তা করতে হবে। নির্দেশ পালনে বিলম্ব বা অনীহা দেখালে ইসি সংশ্লিষ্টদের বিষয়ে গোপনীয় অনুবেদন দেবে যা তাদের পদোন্নতি বা শাস্তির ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হবে। কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নির্বাচনপূর্ব সময়ে, নির্বাচনকালীন বা নির্বাচনের পরে কোনো অভিযোগ উঠলে তদন্ত করবে ইসি; তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন পেয়ে তা নিষ্পত্তি করা হবে। পাশাপাশি তদন্তে মিথ্যা, সাজানো বা ভিত্তিহীন অভিযোগ প্রমাণ হলে অভিযোগকারীকে সতর্ক করা হবে বা তার বিরুদ্ধে মামলা করবে ইসি।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার আবদুর রহমানেল মাছউদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আরপিও নিয়ে কমিশনে পর্যালোচনা চলছে। সংস্কার কমিশনের যেসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করা যায়, সবকিছু আমরা রাখতে রাজি আছি। ঐকমত্য কমিশনের যে রকম হলে ভালো হয়, তাদের মতামত প্রাধান্য দিচ্ছি আমরা।