একজন মুসলমান ব্যবসায়ীর কাছে লাভ-লোকসানের হিসাব যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ। ব্যবসা এমন এক মাধ্যম, যার মাধ্যমে মানুষে মানুষে সহযোগিতা গড়ে ওঠে, পারস্পরিক চাহিদা পূরণ হয় এবং সামাজিক ভারসাম্য বজায় থাকে। তাই ইসলাম ব্যবসাকে শুধু আইন-কানুন বা নিয়ম-নীতির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেনি, বরং এর প্রতিটি ধাপে নৈতিকতা, চরিত্র ও আত্মিক বিশুদ্ধতার প্রতিও জোর দিয়েছে।
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘তোমরা সৎকাজ ও তাকওয়ার ব্যাপারে একে অন্যকে সহযোগিতা কোরো, আর পাপ ও জুলুমের কাজে একে অন্যকে সহযোগিতা কোরো না।’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ২)
তাই ব্যবসা করার আগে আমাদের উচিত নিজের উদ্দেশ্য ঠিক করা। যদি কেউ হালালভাবে উপার্জন করে নিজের ও পরিবারের প্রয়োজন মেটাতে চায়, তাহলে আল্লাহ তার রিজিকে বরকত দেন এবং তার ব্যবসা সহজ করে দেন।
ইমাম গাজ্জালি (রহ.) বলেন, ‘ব্যবসা শুরু করার সময় উচিত, বিশুদ্ধ নিয়ত করা, আল্লাহর ওপর ভরসা করা এবং হারাম বা সন্দেহজনক পথ পরিহার করা। মানুষ যাতে কারো কাছে হাত না পাতে, সে জন্য নিজের উপার্জনের মাধ্যমে জীবিকা অর্জন করাই ভালো। এতে নিজের ঈমানও বজায় থাকে এবং পরিবার-পরিজনের হকও আদায় হয়।’ (ইহইয়াউ উলুমিদ্দিন : খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৮৪)
সততা একজন ব্যবসায়ীর শ্রেষ্ঠ গুণ আর সত্যবাদিতা ও বিশ্বস্ততা ইসলামে ব্যবসার মূলভিত্তি। একজন সৎ ব্যবসায়ী শুধু দুনিয়াতে সম্মানিত নয়, আখিরাতেও তার সম্মান অনেক উঁচু। এ বিষয়ে আবু সাঈদ আল-খুদরী (রা.) বর্ণনা করেন, নবী (সা.) বলেছেন : ‘সৎ ও বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী কিয়ামতের দিন নবী, সত্যবাদী ও শহীদদের সঙ্গে থাকবে।’ (তিরমিজি : ১২০৯)
হাকিম ইবনে হিজাম (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যতক্ষণ না ক্রেতা ও বিক্রেতা আলাদা হয়ে যায়, ততক্ষণ তাদের উভয়েরই লেনদেন বাতিল করার অধিকার থাকে। যদি তারা সত্য কথা বলে ও স্পষ্টভাবে সবকিছু জানায়, তাহলে তাদের লেনদেনে বরকত হবে। আর যদি তারা গোপন করে বা মিথ্যা বলে, তাহলে সেই লেনদেন থেকে বরকত উঠিয়ে নেওয়া হবে। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২০৭৯)
আল্লাহ তাআলা ঋণগ্রহীতার প্রতি সহানুভূতি দেখানোর নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘আর যদি ঋণগ্রহীতা কষ্টে থাকে, তাহলে তার সচ্ছল হওয়া পর্যন্ত তাকে অবকাশ দাও। আর যদি তোমরা ঋণ আদায় না করে তা মাফ করে দাও, তবে তা তোমাদের জন্য উত্তম, যদি তোমরা বুঝতে।’
(সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৮০)
ব্যবসায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নীতি হলো প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে ঈমানদাররা! তোমরা চুক্তি পূরণ করো।’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ১)
ইসলাম ব্যবসায় কিছু আচরণকে স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ করেছে। যেমন—প্রতারণা, জালিয়াতি, মিথ্যা কথা বলা, সুদের লেনদেন ইত্যাদি। জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ সুদ গ্রহণকারী, সুদ প্রদানকারী, সুদের সাক্ষী এবং সুদ লিখে রাখার কাজে নিয়োজিত সবার ওপর অভিশাপ করেছেন। তারা সবাই একই অপরাধে অংশীদার।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৫৯৮)
ইসলাম ক্রয়-বিক্রয়ে সব ধরনের প্রতারণা থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দিয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘ন্যায়সংগতভাবে ওজন করো এবং পাল্লায় কম দিয়ো না।’ (সুরা : আর-রহমান, আয়াত : ৯)
ব্যবসার মধ্যেও আল্লাহর হক আদায় করা জরুরি। বিশেষ করে নামাজের সময় তাৎক্ষণিকভাবে আল্লাহর ডাকে সাড়া দেওয়া একজন মুমিন ব্যবসায়ীর দায়িত্ব। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে ঈমানদাররা! যখন জুমার দিনে নামাজের জন্য আহবান করা হয়, তখন আল্লাহর স্মরণে ধাবিত হও এবং ক্রয়-বিক্রয় ত্যাগ করো। যদি তোমরা বুঝতে, তবে এটা তোমাদের জন্য শ্রেয়।’ (সুরা : জুমআ, আয়াত : ৯)
ব্যবসার লেনদেনে কখনো কখনো শয়তানি প্রভাব ও গুনাহ প্রবেশ করতে পারে। তাই তা থেকে আত্মাকে পরিশুদ্ধ করার উপায় হলো দান-সদকা করা। কায়েস ইবনে আবি গুরজা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘হে ব্যবসায়ীরা! শয়তান ও গুনাহ লেনদেনে অংশগ্রহণ করে, তাই তোমরা তোমাদের লেনদেনকে দান-খয়রাতের মাধ্যমে পরিপূর্ণ ও পরিশুদ্ধ করো।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ১২০৮)
কেননা দান-সদকায় ধন-সম্পদ কমে না, বরং বৃদ্ধি পায়।