জাকাত ইসলামের তৃতীয় স্তম্ভ। এর অপরিহার্যতা অস্বীকার করা কুফরি। জাকাতের আভিধানিক অর্থ পবিত্রতা ও বৃদ্ধি। জাকাত প্রদান করলে অবশিষ্ট সম্পদ পবিত্র হয় এবং সম্পদ বৃদ্ধি পায়, এজন্যই তাকে জাকাত বলে। পরিভাষায় জাকাত একটি আর্থিক ইবাদত যেখানে প্রতিটি সক্ষম মুসলিম তার সম্পদের ৪০ ভাগের ১ ভাগ বা শতকরা আড়াই ভাগ অসহায়-গরিব, দরিদ্র ও এতিমদের প্রদান করতে হয়।
যাদের ওপর জাকাত ফরজ
প্রাপ্তবয়স্ক, স্বাধীন, মুসলিম, যার কাছে নিসাব পরিমাণ সম্পদ আছে, যা মৌলিক প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত ও ঋণমুক্ত এবং সেই সম্পদের ওপর এক বছর অতিবাহিত হয়, তাহলে তার ওপর জাকাত ফরজ হবে।
জাকাতের নিসাব
জাকাত ফরজ হওয়ার নিসাবআল্লাহতায়ালা অসহায়-গরিব ও দরিদ্রদের জন্য বিত্তবান-ধনীদের নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদের ওপর জাকাত ফরজ করেছেন, যাকে নিসাব বলা হয়। যদি কেউ নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়, তাহলে তার ওপর জাকাত ফরজ হবে, অন্যথায় জাকাত ফরজ হবে না। জাকাতযোগ্য সম্পদ চার প্রকার- ১. সোনা ২. রুপা ৩. নগদ অর্থ ও ৪. ব্যবসায়িক পণ্যদ্রব্য। নিচে প্রতিটির পৃথক পৃথক নিসাবের বিবরণ তুলে ধরা হলো।
১. যদি কারও কাছে কেবল ‘সোনা’ থাকে, গহনা-জহরত আকারে হোক বা বর্তন, ব্যবহৃত হোক বা অব্যবহৃত এবং অন্য কোনো সম্পত্তি তথা রুপা, নগদ অর্থ বা ব্যবসায়িক পণ্যদ্রব্য না থাকে, তাহলে সোনা সাড়ে সাত তোলা (৮৭.৪৭৯ গ্রাম) না হওয়া পর্যন্ত জাকাত ফরজ হবে না, আর যদি সোনা সাড়ে সাত তোলা (৮৭.৪৭৯ গ্রাম) ওজনে পৌঁছায়, তাহলে জাকাত ফরজ হবে (বাদায়েউস্ সানাই : ২/১০৫, আছমারুল হিদায়াহ ২/৩৮৬)।
২. যদি কারও কাছে কেবল রুপা থাকে, গয়না-অলংকার আকারে হোক বা বর্তন, ব্যবহৃত হোক বা অব্যবহৃত এবং অন্য কোনো সম্পত্তি তথা স্বর্ণ, নগদ অর্থ, বা ব্যবসায়িক পণ্যদ্রব্য না থাকে, তাহলে রুপা সাড়ে বায়ান্ন তোলা (৬১২.৩৬ গ্রাম) না হওয়া পর্যন্ত জাকাত ফরজ হবে না, আর যদি রুপা সাড়ে বায়ান্ন তোলা (৬১২.৩৬ গ্রাম) ওজনে পৌঁছায়, তাহলে জাকাত ফরজ হবে (বাদায়েউস সানাই : ২/১০০, আছমারুল হিদায়াহ ২/৩৮৬)।
৩. যদি কারও কাছে কেবল নগদ অর্থ থাকে, স্বদেশের হোক বা অন্য দেশের, হাতে থাকুক বা ব্যাংকে, চেক হোক বা ড্রাফট, নোট হোক বা মুদ্রা , কাউকে ধার দেওয়া হোক অথবা বিনিয়োগ করা এবং অন্য কোনো সম্পত্তি তথা সোনা, রুপা বা ব্যবসায়িক পণ্যদ্রব্য না থাকে, তাহলে যতক্ষণ না নগদ অর্থ সাড়ে বায়ান্ন তোলা (৬১২.৩৬ গ্রাম) রুপা কেনার জন্য যথেষ্ট হবে, ততক্ষণ জাকাত ফরজ হবে না। যদি নগদ অর্থ সাড়ে বায়ান্ন তোলা (৬১২.৩৬ গ্রাম) রুপা কেনার জন্য যথেষ্ট হয়, তাহলে জাকাত ফরজ হবে (বাদায়েউস সানাই : ২/১০৩, আছমারুল হিদায়াহ ২/৩৮৬)।
৪. যদি কারও কাছে সোনা ও রুপা (যতটুকুই হোক না কেন) অথবা সোনা ও নগদ অর্থ অথবা সোনা ও পণ্যদ্রব্য অথবা রুপা ও নগদ অর্থ অথবা রুপা ও পণ্যদ্রব্য অথবা (তিনটিই) সোনা, রুপা ও নগদ অর্থ অথবা সোনা, রুপা ও পণ্যদ্রব্য অথবা (চারটিই) সোনা, রুপা, নগদ অর্থ ও পণ্যদ্রব্য থাকে, তাহলে এসব ক্ষেত্রে সব সম্পদের সমষ্টি মূল্য নির্ধারণ করা হবে। যদি সমষ্টি মূল্য সাড়ে বায়ান্ন তোলা (৬১২.৩৬ গ্রাম) রুপার মূল্যের সমান হয়, তাহলে জাকাত ফরজ হবে, অন্যথায় নয় (বাদায়েউস সানাই : ২/১০৫, ১০৬)।
মৌলিক প্রয়োজন
মৌলিক প্রয়োজন বা চাহিদা বলতে এমন প্রয়োজন বা চাহিদাকে বোঝায় যা জীবন ও সম্মানের সঙ্গে সম্পর্কিত অর্থাৎ যা পূরণ না হলে জীবন বা সম্মান হারানোর ঝুঁঁকি থাকে। যথা খাদ্য, পানীয়, পরিধানের পোশাক, থাকার জায়গা এবং শিল্প ও বাণিজ্যে জড়িত ব্যক্তিদের জন্য, তাদের পেশার সরঞ্জাম মৌলিক চাহিদার অন্তর্ভুক্ত (হেদায়াহ ১/১৮৯)।
প্রত্যেক ব্যক্তির চাহিদা ও আকাক্সক্ষা সাধারণত অন্য ব্যক্তির চাহিদা ও আকাক্সক্ষা থেকে ভিন্ন হয়ে থাকে। এজন্য মৌলিক প্রয়োজনীয় বস্তু যোগ-চাহিদা ও ব্যক্তি ভিন্ন হওয়ার কারণে পরিবর্তন হয়। যাদের বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়, তাদের জন্য টেলিফোন বা মোবাইল ফোন, যারা কম্পিউটারের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেন, তাদের জন্য কম্পিউটার ও যাদের দৃষ্টিশক্তি দুর্বল তাদের জন্য চশমা বা লেন্স মৌলিক প্রয়োজনের অন্তর্ভুক্ত। মৌলিক প্রয়োজনের নির্দিষ্ট কোনো সংখ্যা নেই, যেসব বস্তু কারও ব্যবহারে রয়েছে বা ব্যবহার করা প্রয়োজন এবং সেগুলো ব্যবসার জন্য নয়, তাহলে সেসব বস্তু মৌলিক প্রয়োজনের অন্তর্ভুক্ত (ফাতাওয়ায়ে শামী ৬/৩১২)।
লেখক : সিনিয়র শিক্ষক মদিনাতুল উলুম মাদরাসা বসুন্ধরা, ঢাকা
বিডি প্রতিদিন/এমআই