সব মানুষেরই কম-বেশি প্রতিপক্ষ বা প্রতিদ্বন্দ্বী থাকে। সহজ ভাষায়—সেই প্রতিপক্ষ কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে শত্রু মনে করা হয়। শত্রু দ্বারা যেকোনো সময় শারীরিক, মানসিক বা আর্থিক ক্ষতি সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কাজেই শত্রুর হাত থেকে রক্ষা পেতে সর্বদা সতর্ক থাকতে হয়।
শত্রুর সঙ্গে কিছু আচরণ শত্রুকে বন্ধু বানিয়ে দেয়, আবার কিছু আচরণ শত্রুকে চির শত্রুতে পরিণত করে। যেসব আচরণে শত্রু বন্ধু হয়—
(১) মন্দকে ভালো দ্বারা দূরীভূত করা : অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি চারিত্রিক শিক্ষা হলো—মন্দকে ভালো দ্বারা দূরীভূত করা। যা উত্কৃষ্ট তা দিয়ে নিকৃষ্টকে প্রতিহত করা। অর্থাৎ অন্যায়ের পরিবর্তে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা, জুলুমের পরিবর্তে ক্ষমা করা, ক্রোধের পরিবর্তে ধৈর্যধারণ করা, অভদ্রতার পরিবর্তে ভদ্রতা প্রদর্শন করা, মূর্খতা বা অশ্লীলতার পরিবর্তে শালীন আচরণ করা ইত্যাদি।
এসবের ফলে স্বভাবতই শত্রু বন্ধুতে রূপান্তরিত হবে। দূরে থাকা মানুষ কাছের হয়ে যেতে পারে এবং রক্তপিপাসু প্রেমপিপাসু হতে পারে। আল্লাহ বলেন, ‘ভালো ও মন্দ সমান হতে পারে না। উত্কৃষ্ট দ্বারা মন্দ প্রতিহত কর; তাহলে যাদের সঙ্গে তোমার শত্রুতা আছে, সে হয়ে যাবে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মতো।’ (সুরা হা-মিম সাজদা, আয়াত : ৩৪-৩৫)
(২) শত্রুকেও গালি না দেওয়া : কোনো মানুষ, প্রাণী বা কোনো কিছুকেই গালি দিতে নেই। এমনকি চিরশত্রু শয়তানকেও গালি দিয়ে লাভ নেই। অবশ্য এর অর্থ এই নয় যে শয়তান তাওবা করে ভালো হয়েছে। বরং শয়তান যেমন অভিশপ্ত ছিল, তেমনই আছে। তাকে গালি দিলেও সে সংশোধন হবে না, গালি না দিলেও সংশোধন হবে না।
কাজেই তাকে গালি দেওয়া মানে—অযথা নিজের মুখে অশালীন কথা বলা। এটি ঈমানদারের জন্য শোভনীয় নয়। মানুষের কাজ অভিশপ্ত শয়তান থেকে মহান আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করা। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা শয়তানকে গালি দিয়ো না। বরং তার অনিষ্ট থেকে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করো।’ (সহিহুল জামি, হাদিস : ৭৩১৮)
ঠিক তেমনি মানুষ শত্রুকেও গালমন্দ না করে বরং তার কল্যাণকামী হলে সে বন্ধু হলেও হতে পারে।
(৩) শত্রুর সঙ্গেও সম্পর্ক ছিন্ন না করা : কারো সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ করে মন কষাকষি হলে বা পরস্পরের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষভাব জন্ম নিলে মহান আল্লাহর সাধারণ ক্ষমা থেকে বঞ্চিত হতে হয়। শরয়ি কোনো কারণ ছাড়া কোনো মুসলমানের সঙ্গে তিন দিনের বেশি সম্পর্ক ছিন্ন করা কবিরা গুনাহ ও হারাম।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কোনো মুসলিমের জন্য হালাল নয় যে, সে তার অন্য কোনো মুসলিম ভাইয়ের সঙ্গে তিন দিনের বেশি সম্পর্ক ছিন্ন করবে। কেউ তা করলে সে মৃত্যুর পর জাহান্নামে প্রবেশ করবে।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৯১৪)
শত্রুর সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করলে একসময় সে বন্ধু হতেই পারে।
(৪) শত্রুকে ক্ষমা করতে শেখা : কেউ শত্রুকে ক্ষমা করতে চায় না। সুযোগ পেলে এক হাত দেখে নেওয়ার চেষ্টা করে। সব সময় প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ খুঁজতে থাকে। অথচ ক্ষমা করাকেই আল্লাহ পছন্দ করেন। আল্লাহ বলেন, ‘যে ক্ষমা করে দেয় ও আপস-নিষ্পত্তি করে তার পুরস্কার আল্লাহর কাছে আছে। নিশ্চয় তিনি জালিমদের পছন্দ করেন না।’ (সুরা শুরা, আয়াত : ৪০)
(৫) শত্রুর দোষ-ত্রুটি এড়িয়ে যাওয়া : শত্রুকে বন্ধু বানাতে হলে শত্রুর দোষ-ত্রুটি এড়িয়ে যেতে হবে। শত্রুর দোষ অন্বেষণ করার মাধ্যমে পরস্পরের মধ্যে শত্রুতা আরো বেড়ে যায়। আল্লাহ বলেন, ‘এবং তোমরা একে অপরের গোপনীয় বিষয় অনুসন্ধান করো না এবং একে অপরের পশ্চাতে নিন্দা (গিবত) করো না।’ (সুরা হুজরাত, আয়াত : ১২)
(৬) শত্রুর সঙ্গেও ভালো আচরণ : রাসুলুল্লাহ (সা.) দোস্ত-দুশমন সবার সঙ্গেই সুন্দর আচরণ করতেন। ইসলামের জাত শত্রু ইহুদিদের সঙ্গেও ছিল নবীজির সুন্দর আচার-ব্যবহার। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, একবার রাসুল (সা.)-এর ঘরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ইহুদিরা তাঁকে সালাম দেয়।
সালামে তারা বলল, ‘আস-সামু আলাইকুম ইয়া মুহাম্মাদ (হে মুহাম্মাদ, আপনার মরণ হোক)।’ রাসুল (সা.) শান্তভাবে বলেন, ‘ওয়ালাইকুম।’ (তোমাদের ওপর অবতীর্ণ হোক)। কিন্তু আয়েশা (রা.) এমন কথা সহ্য করতে পারলেন না। তিনি প্রত্যুত্তরে বলেন, ‘ওয়ালাইকুমুস সাম, ওয়া লা‘আনাকুমুল্লাহ, ওয়া গাদাবা আলাইকুম (তোমাদের মরণ আসুক, আল্লাহ তাআলা তোমাদের ওপর অভিসম্পাত করুন, তোমাদের ওপর ক্রোধান্বিত হোন)।’
রাসুল (সা.) বলেন, ‘রাখো, আয়েশা। সবার সঙ্গে সুন্দর ব্যবহার করা তোমার কর্তব্য। কঠোরতা ও অশ্লীলতা পরিহার করো।’
আয়েশা (রা.) বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল, তারা কী বলেছে, আপনি শোনেননি?’ রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমি কী বলেছি তুমি শোননি? আমিও তাদের কথার জবাব দিয়েছি। তাদের ব্যাপারে আমার দোয়া গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু আমার জন্য তাদের দোয়া গ্রহণ করা হয়নি।’
(৭) সবার জন্য কল্যাণ কামনা : দ্বিন মানেই হলো নসিহত বা কল্যাণকামিতা। সব মানুষের প্রতি নসিহত বা কল্যাকামিতা হলো, সঠিক পথ ও কল্যাণকর কাজের দিকনির্দেশনা দেওয়া, ধর্মীয় বিষয় শিক্ষা দেওয়া, দোষ-ত্রুটি গোপন রাখা, প্রয়োজন পূরণ করা, প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতা না করা, হিংসা পোষণ না করা বরং সবার প্রতি সহনশীলতা প্রদর্শন এবং সব কাজে সেবার মানসিকতা জাগ্রত করা। এটি নবী-রাসুলদের অন্যতম গুণ।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
বিডি প্রতিদিন/মুসা