সুষ্ঠু নির্বাচন করতে হলে নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষ ও শক্ত ভূমিকা নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন গণফোরাম, গণফ্রন্টসহ আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতারা। কোনোভাবে অনিয়ম ও অদৃশ্য শক্তির কাছে নতজানু হওয়া যাবে না বলেও সতর্ক করেছেন তারা। নির্বাচনকে সুষ্ঠু করতে বিভাগওয়ারি ভোট নেওয়া, জামানত কমানো, ভোট কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা রাখার জন্য সংলাপে সুপারিশ করেছে দলগুলো। এ ছাড়া নির্বাচনে কালোটাকার ব্যবহার বন্ধ করা, যৌথ বাহিনীর অভিযান করে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার করার দাবি জানানো হয়।
গতকাল আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে দ্বিতীয় দিনের সংলাপের প্রথম পর্বে অংশ নিয়ে রাজনৈতিক দলের নেতারা নির্বাচনে ইসির ভূমিকা নিয়ে নিজেদের প্রত্যাশা তুলে ধরেন। আলোচনায় সিইসি ও নির্বাচন কমিশনাররাও বলেছেন, আইন-বিধি প্রয়োগে কঠোর থাকবেন তারা। এক্ষেত্রে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন জানিয়ে ইসিও বলেছেন, কোনো চাপের কাছে কমিশন ‘নতজানু হবে না’।
গতকাল সকালে নির্বাচন ভবনের সম্মেলন কক্ষে সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত গণফোরাম, গণফ্রন্ট, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি-বিএসপি ও বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি আলোচনা সেরেছে ইসির সঙ্গে। অর্ধশতাধিক নিবন্ধিত দলের মধ্যে বৃহস্পতিবার ও শনিবার নিয়ে ২৪টি দলের সংলাপ হয়েছে। দ্বিতীয় দিনের সংলাপে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিনসহ অন্য চার নির্বাচন কমিশনার, ইসির সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন।
গণফোরামের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সুব্রত চৌধুরী অতীতের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, অনেক আশা ভরসা ছিল, ইসির ওপর সারা জাতির আস্থা থাকে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, অতীতে যারা দায়িত্ব পালন করেছেন দক্ষ ছিলেন হয়তো, তাদেরকে কাছ থেকে নিরপেক্ষতা পাইনি। তাদের সঙ্গে অদৃশ্য শক্তি ছিল। গণফ্রন্টের মহাসচিব আহমদ আলী শেখ বলেন, আজ অবধি ইসি অবিচারের শিকার হয়েছে। অবিচারগ্রস্ত ইসির অধীনে আমরা যারা নির্বাচন কমিশন তাদের অবস্থা শোচনীয়। আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য ইসির সক্ষমতা যা দরকার তা সুনিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এ এন এম সিরাজুল ইসলাম বলেছেন, আগামী নির্বাচন ভালো করার জন্য ইসির আন্তরিকতা রয়েছে। নির্বাচনকে সুষ্ঠু করতে বিভাগওয়ারি ভোট নেওয়া, জামানত কমানো, ভোট কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা রাখার সুপারিশ করেন তিনি।
ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের চেয়ারম্যান সৈয়দ বাহাদুর শাহ মোজাদ্দেদী ৯টি প্রস্তাব তুলে ধরে বলেন, গত ১৫ বছরে যে তিনটি নির্বাচন হয়, সবই বিতর্কিত। গোটা নির্বাচন ব্যবস্থা সংকটাপন্ন। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত, সারা দেশে একই দিনে নির্বাচন না করে চার ধাপে আয়োজন করার দাবি রেখেছেন তিনি। বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির প্রতিনিধি সংলাপে অংশ নিয়ে কালোটাকা রোধে ইসির দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান।
ইসলামী ঐক্যজোটের দুই পক্ষ : শুরুতে ইসির সংলাপে ইসলামী ঐক্যজোটের দুই পক্ষ হাজির হয়। গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সংলাপ শুরু হয়।
এতে ইসলামী ঐক্যজোটের দুই পক্ষের প্রতিনিধি আসায় কিছুটা হট্টগোল হয়। এ সময় সংলাপে অংশ নিতে আসা যাদের কাছে চিঠি নেই, তাদের সম্মেলন কক্ষ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য বলেন ইসি সচিব।
ইসির তিন বার্তা : নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, যারা পেশি শক্তি দেখাবে, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে- এটাই ইসির বার্তা। এ ব্যাপারে কোনো ব্যত্যয় হবে না। অপপ্রচার ছড়ালে তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে, কর্মকর্তারা পক্ষাপাতদুষ্ট হলে সে বা তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ তিনটি বার্তা ইসির।
পোস্টাল ভোট বিডি অ্যাপ ১৮ নভেম্বর উদ্বোধন করার কথা তুলে ধরে আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ জানান, বৈশ্বিকভাবে এটা সহজ পদ্ধতি নয়। এ অভিজ্ঞতাটা খুব সহজ নয়। সর্বশেষ ভারতে ৪ কোটি প্রবাসীর মধ্যে ১ লাখ ১৯ হাজার নিবন্ধন করেছিল। মালয়েশিয়ায় ১৮ লাখ প্রবাসীর মধ্যে নিবন্ধন করাতে পেরেছিল ৫৫ হাজার। আমাদের ধারণা, আমাদের সমমানের স্ট্যান্ডার্ডের মধ্যে সবাইকে ছাড়িয়ে যাব।
নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, আমরা নতজানু হব না। আমরা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যা যা করার দরকার করছি, ভালো নির্বাচন করার বিকল্প রাস্তা নেই। আপনাদের সহযোগিতা চাই। পোলিং এজেন্ট নিয়োগের বিষয়ে দলগুলো যেন আগে থেকেই এক্সারসাইজ করে। পোলিং এজেন্ট নিয়োগের বিষয়ে ভোটের আগের দিন চূড়ান্ত না করে আগেই তালিকা করে দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেন, আশা করি, দলগুলোর প্রত্যাশিত সহযোগিতা পাব। জাতি হিসেবে আমরা একসঙ্গে কাজ করে কামিয়াব হব। তিনি বলেন, কোনো আসনে একক প্রার্থী থাকলে সেখানেই শুধু ‘না’ ভোট হবে। নির্বাচিত হওয়ার পর হলফনামায় গোঁজামিল থাকলে ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে।
গতকাল বিকালের সংলাপের শুরুতে সিইসি বলেন, এই সংলাপের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, আচরণবিধি সম্পর্কে রাজনৈতিক দলগুলোকে জানানো। আচরণবিধি প্রতিপালনে দলগুলোর সহযোগিতা দরকার। আগামী নির্বাচনে অপতথ্য, ভুলতথ্য ঠেকানো সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে সিইসি বলেন, এই জিনিসগুলোকে আগের কমিশন ট্যাকেল করতে হয়নি। এটা বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি- বাংলাদেশ ন্যাপের চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গানি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এই সংলাপ আগে হলে ভালো হতো। তাহলে আরপিও সংশোধনী ও আচরণ বিধির সংশোধনী নিয়ে এত আলোচনা হতো না। কমিশন সব অংশীজনদের কাছ থেকে মতামত নেয়নি।
খেলাফত মজলিসের মহাসচিব জালাল উদ্দিন আহমদ বলেন, বিগত তিন নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারেনি। ভোট দিতে মানুষ মুখিয়ে আছে। তবে কমিশনের নিরপেক্ষতা অপরিহার্য। কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন থাকলে জাতীয় নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র প্রেসিডিয়াম মেম্বার সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানি বলেন, গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন একই দিনে হলে গণভোটের গুরুত্ব থাকবে না। গণ্ডগোল হলে ভোটসেন্টার বন্ধ থাকবে, তখন গণভোটের কী হবে।
বাংলাদেশ জাসদের সাধারণ নাজমুল হক প্রধান বলেন, একটা দলের একটা অংশ পালিয়েছে। তারা নির্বাচনে অংশ নেবেন না। যারা ইলেকশনে অংশ নেবেন, সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশ যেন থাকে তা নির্বাচন কমিশনকে নিশ্চিত করতে হবে। এই পরিবেশ কমিশনকে তৈরি করতে হবে।
জাতীয় পার্টিসহ (জাপা) বামদলগুলোকে ভোটের আয়োজন থেকে বাদ না দিতে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) সুপারিশ করেছেন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী। তিনি বলেন, তাদেরকে বাদ দিলে চলবে না। কাদের সিদ্দিকী বলেন, বর্তমান সরকার দেশকে একেবারেই বিভক্ত করে ফেলেছে। নিবন্ধিত দল এখন ৪০-৫০টি। কিন্তু তারা আলোচনা করে দু-তিনটি দলের সঙ্গে বসে। সেটা না নিরপেক্ষ, না সার্বিক।
ইসি কারও হয়ে কাজ করবে না : সিইসি : প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেছেন, নির্বাচন কমিশন কারও পক্ষে কাজ না করে, বিবেক, দেশের প্রচলিত আইন, বিধি ও বিধান অনুযায়ী নির্বাচন আয়োজন করবে। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের জন্য জাতি ও জনগণের কাছে নির্বাচন কমিশন ‘প্রতিশ্রুতিবদ্ধ’ বলে জানিয়েছেন তিনি। গতকাল রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে কমিশনের উদ্যোগে আয়োজিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে তিনি এসব কথা বলেন। শুরুতে শুভেচ্ছা বক্তব্যে সিইসি বলেন, অনেকে মনে করেন তার পক্ষে কাজ করলে আমরা নিরপেক্ষ। কিন্তু আমরা কারও পক্ষে কাজ করতে পারব না। আমাদের বিবেক দেশের প্রচলিত আইন, বিধিবিধান যা বলে সেটা মেনেই আমরা চলব, ইনশাআল্লাহ। তিনি এ উদ্দেশ্য সাধনে সব রাজনৈতিক নেতার সহযোগিতা কামনা করেন।
সংলাপ আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য তুলে ধরে সিইসি বলেন, ‘আপনাদের এখানে আমন্ত্রণ জানানোর মূল পারপাস দুইটা। একটা হলো, আমরা যে একটা আচরণবিধি বানিয়েছি তা পরিপালনে আপনাদের সহযোগিতা চাওয়া। আর হলো, একটা সুন্দর নির্বাচনের কথা আমরা সবাই বলছি এবং আমরা জাতির কাছে ওয়াদাবদ্ধ। এখানে আপনাদের সহযোগিতা চাওয়া আমাদের বড় উদ্দেশ্য।’
সিইসি বলেন, এটা আমাদের কমিটমেন্ট টু দ্য নেশন। আমরা দায়িত্ব গ্রহণের দিন থেকেই এটা বলে আসছি। নতুন কমিশন দায়িত্ব গ্রহণের পর অনেকগুলো বড় ও অতিরিক্ত কাজ করতে হয়েছে বলে তুলে ধরেন সিইসি।
জাতীয় নেতাদের ব্যস্ততা ও ইসির অভ্যন্তরীণ কাজের চাপ মিলিয়ে কিছুটা দেরিতে সংলাপ শুরু হয়েছে মন্তব্য করে সিইসি আশা প্রকাশ করে বলেন, সবার সহযোগিতা নিয়ে কনসালটেশনের কাজ সুষ্ঠুভাবে শেষ করা যাবে।
বর্তমান কমিশনের সামনে থাকা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে এআই ব্যবহার করে ‘মিথ্যা ও অপতথ্য’ ছড়ানোকে চিহ্নিত করেছেন সিইসি। তিনি বলেন, এই চ্যালেঞ্জ আগের কমিশনদের ফেস করতে হয়নি। এই একটা বড় চ্যালেঞ্জ আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছে। এর মধ্যে অনেক চ্যালেঞ্জ জেনারেট হচ্ছে ফ্রম আউটসাইড দ্য বর্ডার। এগুলো ট্যাকেল করা আমাদের জন্য বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আপনারা সহযোগিতা করলে আমরা এ চ্যালেঞ্জও উতরে যেতে পারব বলে আমি বিশ্বাস করি।