জলবায়ু পরিবর্তনে ক্রমেই বাড়ছে তাপমাত্রা। এতে পৃথিবীর একের পর এক হিমবাহ দ্রুত গলে যাচ্ছে- যা জলবায়ু সংকটের নতুন মাত্রা তৈরি করেছে। বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে দিয়েছেন, বর্তমান প্রবণতা অব্যাহত থাকলে আইসল্যান্ডসহ বহু অঞ্চলের হাজার হাজার বছরের জমা হিমবাহ ২২০০ সালের আগে সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যেতে পারে। এর প্রভাব পড়বে বিশ্বব্যাপী, বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো নিচু ও ঘনবসতিপূর্ণ দেশে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ায় তলিয়ে যাবে অনেক এলাকা। বাড়বে বন্যা। সাগরের লবণ পানি ঢুকে পড়বে দেশের অভ্যন্তরে। ঝুঁকিতে পড়বে কৃষি।
জাতিসংঘ ইতোমধ্যেই সতর্ক করেছে- যদি গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন আগামী দশকের মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো না হয়, তবে একুশ শতকের শেষে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এক মিটার বা তারও বেশি বৃদ্ধি পেতে পারে। এটি বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, কিরিবাতির মতো নিম্নভূমি দেশগুলোর অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলবে।
হিমবাহ গলনের ভয়াবহ চিত্র আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। গবেষণার তথ্যানুযায়ী, গত সাত দশকের বেশি সময় ধরে দক্ষিণ ভারত মহাসাগরে অবস্থিত জাতিসংঘ ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হার্ড দ্বীপে হিমবাহ গলার বার্ষিক হার প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। একইভাবে আইসল্যান্ডের হিমবাহগুলোও দ্রুত গলছে। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার (ডব্লিউএমও)-এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- গত ছয় বছরের মধ্যে পাঁচ বছরেই হিমবাহ গলার হার রেকর্ড ছুঁয়েছে। ১৯৭৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত বিশ্বের হিমবাহগুলো ৯ হাজার বিলিয়ন টনের বেশি বরফ হারিয়েছে, যার আয়তন পুরো জার্মানির আয়তনের সমান এলাকা ২৫ মিটার পুরু বরফ দিয়ে ঢেকে দিলে যতটুকু হয় তার সমান। জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতে, ২০০০ সাল থেকে আইসল্যান্ড তার হিমবাহের ৭৫০ বর্গকিলোমিটার হারিয়েছে, যা ওয়াশিংটন ডিসির আয়তনের চারগুণের বেশি। বিজ্ঞানীরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে অর্ধ শতাব্দীর মধ্যে আইসল্যান্ড তার হিমবাহের ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত হারাতে পারে। অন্য এক গবেষণার তথ্য বলছে, ২০০০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বিশ্বের হিমবাহগুলো সম্মিলিতভাবে ৬.৫৪২ ট্রিলিয়ন টন বরফ হারিয়েছে। এতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়েছে ১৮ মিলিমিটার।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে বর্তমানে বিশ্বের ১৯টি হিমবাহ অঞ্চলই ঝুঁকির মধ্যে। এই ধারা চলতে থাকলে শুধু আর্কটিক নয়, হিমালয় ও আন্দিজের মতো পাহাড়ি অঞ্চলের হিমবাহও ব্যাপকভাবে বিলীন হয়ে যাবে। ইতোমধ্যে আর্কটিক অঞ্চলে হিমবাহ পর্যটনেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে পর্যটন এলাকা। গত বছর ২৩ জন পর্যটকের একটি দল বরফ গুহা পরিদর্শন করতে গেলে একটি বরফের প্রাচীর ধসে পড়ে। এতে একজন আমেরিকান পর্যটক নিহত হন এবং তার গর্ভবতী বাগদত্তা আহত হন।
এদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। গবেষণা প্রতিষ্ঠান চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী এবং আন্তর্জাতিক জলবায়ু অর্থনীতি বিশ্লেষক এম জাকির হোসেন খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাংলাদেশ অধিক জনসংখ্যার ভারে জর্জরিত একটি নিম্নভূমি দেশ। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির প্রভাব এখানে দ্রুত অনুভূত হবে। উপকূলীয় অঞ্চলের বহু এলাকা তলিয়ে যাবে। লবণাক্ততা ঢুকে পড়বে কৃষিজমিতে, ফলে ফসল উৎপাদন কমে যাবে। মিঠাপানির উৎস দূষিত হবে, পানীয় জলের সংকট দেখা দেবে। লাখ লাখ মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। তিনি বলেন, হিমবাহ গলছে। আমরা এর অন্যতম ভুক্তভোগী। কিন্তু হিমবাহ গলে কোন মৌসুমে কী পরিমাণ পানি গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র বেসিনে আসছে সেই হিসাব আমরা রাখছি না। যৌথ নদী কমিশনও এটা নিয়ে কাজ করছে না। ভারত ও চীন নদীতে একের পর এক ড্যাম নির্মান করছে। হিমবাহ দ্রুত গলতে শুরু করলে এসব ড্যাম পানির চাপ ধরে রাখতে পারবে না। দেখা যাবে শীতকালেও হুট করে বন্যায় ভেসে যাবে দেশ। এজন্য বরফ গলে কতটা পানি আসছে, কখন বরফ বেশি গলছে এগুলো যৌথ মনিটরিং করা জরুরি। এ কাজে নাসার মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাকে যুক্ত করতে হবে। বাংলাদেশের স্পারসো, নদী কমিশন, পাউবোসহ সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠান নিয়ে একটা মনিটরিং সেল করতে হবে। বাঁধের কারণে আমরা যে ক্ষতির শিকার হচ্ছি এটা নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে প্রতিকার চাইতে হবে। সেক্ষেত্রে সম্প্রতি সিন্ধু নদের পানি বণ্টন নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতের রায়কে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এ ছাড়া পানি ধরে রাখতে খাল, বিল, নদী পুনরুদ্ধার করতে হবে। বন্যা এখন বাড়তেই থাকবে। তাই বন্যা ব্যবস্থাপনা কমিউনিটি পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। অন্যতম ঝুঁকিতে থাকা দেশ হিসেবে আমরা জলবায়ু ফান্ডের দাবিদার। বিশ্বব্যাংক, ক্লাইমেট ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড প্রস্তুত আছে। তবে অনুদান আর খুব বেশি পাওয়া যাবে না। আমাদেরকে বিজনেস মডেলে গিয়ে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে হবে। এমন মডেলে যেতে হবে, যারা টাকা দেবে তারাও লাভবান হবে, আমরাও লাভবান হব।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, জীবাশ্ম জ্বালানি (কয়লা, তেল, গ্যাস) পোড়ানোর ফলে বিপুল পরিমাণ কার্বন ডাইঅক্সাইড ও মিথেন বায়ুমণ্ডলে জমা হচ্ছে, যা পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়াচ্ছে। জাতিসংঘের গবেষণা অনুসারে, ২০২৪ সালে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের ঘনত্ব ৮ লাখ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছেছে। শিল্প বিপ্লবের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন, ভারতসহ শীর্ষ কার্বন নির্গমনকারী দেশগুলো পরিবেশে সবচেয়ে বেশি গ্রিনহাউস গ্যাস ছড়িয়েছে। ব্যাপক হারে বন উজাড় হওয়ায় প্রাকৃতিক কার্বন শোষণের ক্ষমতা কমে গেছে।
পরিবেশবিদদের মতে বিশ্বের মোট গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবদান নগণ্য হলেও জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় শিকার এই দেশ। এখনই বৈশ্বিক পদক্ষেপ না নিলে, সামনে অপেক্ষা করছে ভয়াবহ বাস্তুচ্যুতি, খাদ্য সংকট ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়। বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক জলবায়ু কূটনীতিতে আরও সক্রিয় হতে হবে। উন্নত দেশগুলোকে কার্বন হ্রাস ও ক্ষতিপূরণ তহবিল প্রদানে চাপ দিতে হবে।