বাংলা গানের ইতিহাস মানেই একেকটি সময়, একেকটি অনুভূতি, একেকটি সুরভরা গল্প। কালের পরিক্রমায় জনপ্রিয় হওয়া কিছু গান আজও হৃদয়ে বাজে, তাদের জন্মের পেছনে আছে আশ্চর্য কিছু গল্প। তেমন কিছু কালজয়ী গান সৃষ্টির নেপথ্যের গল্প তুলে ধরেছেন - পান্থ আফজাল
মন শুধু মন [তপন চৌধুরী, সোলস]
১৯৮০ সালে ঢাকার আরামবাগের একটি এক তলা বাড়িতে নকীব খান ও তার ভাই ঝিলু খান লিখে ফেলেন ‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে’। গানটি প্রথম পরিবেশিত হয় চট্টগ্রামের সৈকতচারী সংগঠনের এক অনুষ্ঠানে। পরে ঝংকার স্টুডিওতে পুনরায় রেকর্ড করা হয় সোলস ব্যান্ডের সদস্য আইয়ুব বাচ্চ (লিড গিটারে), কিবোর্ডে নকীব, ড্রামসে পিলু খান, রিদম গিটারে র্যালি, বেজে শাহেদকে নিয়ে। ‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে’র শিল্পী তপন চৌধুরী, গীতিকার নকীব খান, সুরকার ঝিলু খান।
এই নীল মণিহার [লাকী আখান্দ]
গানটির জন্ম ১৯৭৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর, আজিমপুরের ১৬ নম্বর বিল্ডিংয়ে। সেদিন সকালে কুচকাওয়াজের শব্দে অনুপ্রাণিত হয়ে লাকী আখান্দ, হেদায়েত ও শেখ ইশতিয়াক বসেছিলেন নতুন কিছু করার জন্য। গিটারে ইশতিয়াক বি মাইনর কর্ডে প্ল্যাক করছিলেন, আর লাকীর কিবোর্ডে ভেসে আসে এক সুর। তার ওপর হেদায়েত লিখলেন, ‘এই নীল মণিহার...’। গানটি প্রথম প্রচারিত হয় ১৯৭৭ সালে বেতারে, আর ১৯৭৮ সালে নাটক জীবন একটি উদ্যম নদীতে ব্যবহৃত হওয়ার পর এটি লাকীর অন্যতম জনপ্রিয় সৃষ্টি হয়ে ওঠে। গানটির শিল্পী ও সুরকার লাকী আখান্দ, গীতিকার এস এম হেদায়েত।
মন কি যে চায় [ডিফারেন্ট টাচ, চাইম]
নব্বইয়ের দশকের সবচেয়ে আলোচিত গানগুলোর একটি ‘মন কি যে চায় বলো’। কিন্তু এর জন্মের গল্পে রয়েছে তীব্র বিতর্ক। গানটি মূলত উইনিং ব্যান্ডের হলেও চাইম ব্যান্ড এটি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিজেদের বলে গাইতে শুরু করে। পরে উইনিং গানটি দেয় ডিফারেন্ট টাচকে, যারা তাদের অ্যালবামে গানটি প্রকাশ করে। এর ফলে তৈরি হয় তিন ব্যান্ডের মধ্যে বিরাট দ্বন্দ্ব। অবশেষে এক বৈঠকে ঠিক হয়, দুটি ব্যান্ডই গানটি গাইতে পারবে। আর শ্রোতারা পেলেন এক অবিস্মরণীয় ক্ল্যাসিক। গানটির গীতিকার ও সুরকার হায়দার।
আবার এলো যে সন্ধ্যা [হ্যাপী আখান্দ]
১৯৭৫ সালে বিকালে নওগাঁর জমিদারবাড়ির ধানখেত ঘেরা পথে রিকশায় ঘুরতে বের হয়েছিলেন লাকী আখান্দ ও এস এম হেদায়েত। প্রকৃতির মোহে হেদায়েত হঠাৎ বলে ওঠে, ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা শুধু দুজনে।’ লাকী পরে ঢাকায় ফিরে গানটির সুর করেন রক অ্যান্ড রোল আঙ্গিকে। পরে হ্যাপী আখান্দ চুপিচুপি গানটি রেকর্ড করে ফেলে এবং বিটিভির ‘বর্ণালী’তে গাওয়ার পর গানটি হয়ে যায় প্রজন্মের চিরকালীন প্রেমগীতি।

ভালো লাগে জোসনা রাতে [নকীব খান, রেনেসাঁ]
১৯৮৩-৮৪ সালের এক জোসনাভরা রাতে ট্রেনে ঢাকা ফিরছিলেন নকীব খান ও তার বন্ধু আরিফ। জানালার বাইরে কাশবন, গাছপালা আর জোসনার আলো দেখে লিখেছিলেন, ‘ভালো লাগে জোসনা রাতে’। ট্রেনের ভিতরেই তৈরি হয় সুরের খসড়া। পরের বছর ঢাকায় ফিরে গানটির কম্পোজিশন সম্পন্ন করেন নকীব। ১৯৮৫ সালে রেনেসাঁ গঠনের পর এটি রাখা হয় ব্যান্ডের প্রথম অ্যালবামে, যা প্রকাশিত হয় ১৯৮৮ সালে।
নাতি খাতি বেলা গেল [খালিদ, চাইম]
১৯৮৩-এ চাইম ব্যান্ডে খালিদ যোগ দেন। ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত প্রথম অ্যালবামের গান ‘নাতি খাতি বেলা গেল’। গানটির স্রষ্টা হাফিজুর রহমান। মাগুরার আঞ্চলিক ভাষায় রচিত গানটি।
মাঝরাতে চাঁদ যদি [টিপু, অবসকিউর]
১৯৮৫ সালে সারগাম স্টুডিওতে শুরু হয় সাইদ হাসান টিপুর অবসকিউর দলটির প্রথম অ্যালবামের কাজ। মোট ১২টি গানের আলোচিত ‘মাঝরাতে চাঁদ যদি’ লিখেছিলেন টিপুর বড় বোনের বান্ধবীর ভাই এহসান। টিপু বলেন, ‘রাতে বাসায় কাপড় চেঞ্জ করতে গিয়ে মনে হলো দেখি কাগজে কী লেখা। খুলে দেখি লেখা ‘মাঝরাতে চাঁদ যদি আলো না বিলায়, ভেবে নেব আজ তুমি চাঁদ দেখোনি’- এ দুটি লাইন পড়ে মনে হলো দেখা যাক। এক বসায় সুরও করে ফেললাম।
স্কুল পলাতক মেয়ে [ফজল, নোভা]
১৯৯৩ সালে জনপ্রিয় ব্যান্ড নোভার ‘স্কুল পলাতক মেয়ে’ গানটি সৃষ্টি হয়। ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা আহমেদ ফজল গানটি করেন।
ঐ দূর পাহাড়ের ধারে [চন্দন, উইনিং]
সোনালি সময়ের জনপ্রিয় ব্যান্ড ‘উইনিং’-এর শ্রোতাপ্রিয় গান ‘ঐ দূর পাহাড়ের ধারে’। গানটি গেয়েছেন চন্দন জামান আলী। এটি একটি রোমান্টিক-বিষাদময় গান, যা একজন নিঃসঙ্গ মেয়ের গান শোনার আকুতি নিয়ে তৈরি হয়েছে। ১৯৯১ সালের জুলাই মাসে প্রথম অ্যালবাম ‘উইনিং’-এ প্রকাশ করা হয় গানটি।
স্বার্থপর ([রুণ, ট্র্যাপ]
১৯৯৪ সালের এক উচ্ছ্বসিত তরুণ সময়ের গান ‘স্বার্থপর’। গীতিকার-শিল্পী তরুণ বলেন, ‘তখন জীবন কোনো নিয়মে বাঁধা ছিল না। যা মনে হতো, তাই লিখতাম।’ ‘তুই তুকারি’ ভাষায় লেখা এই গান তারুণ্যের খোলামেলা আবেগের প্রতীক হয়ে ওঠে। গানটির কথা, সুর ও কণ্ঠ দিয়েছেন তরুণ মুন্সী (ব্যান্ড ট্র্যাপ)।
বায়োস্কোপ [সঞ্জীব ও বাপ্পা, দলছুট]
জীবনের গল্প থেকে জন্ম নেওয়া গান ‘বায়োস্কোপ’। কামরুজ্জামান কামু বলেন, ‘কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই গানটি লিখেছিলাম- গুনগুন করতে করতেই কথা ও সুর এসে গেল।’ পরে গানটি তিনি দেন সঞ্জীব চৌধুরীকে। সংগীতায়োজনে বাপ্পা মজুমদার।
সরলতার প্রতিমা [খালিদ, চাইম]
‘মিক্স মাস্টার’ বা ‘চাইম খালিদ’-এর কণ্ঠে ‘সরলতার প্রতিমা’ প্রকাশিত হওয়ার পরপরই সে সময়কার শ্রোতাদের কাছে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। খালিদের ‘সরলতার প্রতিমা’ গানটির গীতিকার হলেন তরুণ মুন্সী। সুরকারও ছিলেন তরুণ।