১৯৯৩ সালে চলচ্চিত্রে আসা। জনপ্রিয়তার পথ ধরে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া। একসময় ক্লান্ত মন আর শরীরকে বিশ্রাম দেওয়া, সংসার করা। সবই হয়েছে জনপ্রিয় নায়িকা শাবনূরের জীবনে। তিনি অস্ট্রেলিয়ারও নাগরিক। সেখানে অনেক আগেই থিতু হয়েছেন। এতকিছুর পরও ঢাকাই চলচ্চিত্রের সাফল্যের বরপুত্র খ্যাত সালমান শাহর মৃত্যুর ঘটনায় জড়িয়ে গেছেন তিনি। এসব নিয়ে ও তার জীবনের সাতসতেরোর গল্প নিজেই তুলে ধরলেন, আর তা বিন্যস্ত করলেন- আলাউদ্দীন মাজিদ
সালমানের মৃত্যুর সঙ্গে কেন আমাকে জড়ানো হলো-
সালমান শাহ আর আমাকে নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। আমি বুঝতে পারছি না, সালমানের মৃত্যুর সঙ্গে কেন আমাকে জড়ানো হলো। যারা আমাকে জড়িয়েছে তাদের উদ্দেশে শুধু বলব, এসবের কোনো কথাই সত্য নয়। সালমানের কোনো বোন ছিল না, তাই আমাকে ছোট বোনের মতোই দেখতেন। আমাকে ‘পিচ্চি’ বলে ডাকতেন। তার মা-বাবাও আমাকে খুব আদর করতেন, মেয়ের মতোই ভালোবাসতেন। আমিও সালমানকে ভাইয়ের মতোই দেখতাম। তবে আমাদের মধ্যে ছিল দারুণ বন্ধুত্ব। সালমান নাচে একটু দুর্বল ছিলেন। প্রায়ই বলতেন, ‘আমাকে একটু নাচ দেখিয়ে দে তো।’ আমি হাসতে হাসতে দেখিয়ে দিতাম। সালমানকে আমি ভাই ছাড়া অন্য কোনো চোখে দেখিনি। কিছু মানুষ আমাদের সম্পর্ক নিয়ে নানা মুখরোচক গল্প বানিয়েছে। কেউ কেউ সেটা দিয়ে ব্যবসাও করেছে। এতে আমার কষ্ট হয়েছে। কারণ আমি আমার ক্যারিয়ারটা অনেক কষ্ট করে গড়েছি। সামিরা আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। শুটিংয়ে প্রায় সব সময়ই সে থাকত। আমাদের মধ্যে কখনো কোনো মনোমালিন্য হয়নি। সামিরা নিজে আমার হাতে চুড়ি পরিয়ে দিয়েছে, পোশাক মিলিয়ে দিয়েছে, কানের দুল বেছে দিয়েছে, সত্যি আমরা খুব ভালো সময় কাটিয়েছি।
কথা যদি শুরু করি...
‘কথা যদি শুরু করি শেষতো হবে না, আগুন যদি জ্বালি নেভানো যাবে না...’ হ্যাঁ, দীর্ঘসময় পর আবারও বড়পর্দায় নিজের মনকাড়া অভিনয় দিয়ে দর্শক হৃদয়ে আগুন জ্বালাতে আসছেন দেশি চলচ্চিত্রের আকাশছোঁয়া জনপ্রিয় নায়িকা শাবনূর। সাল ১৯৯৩। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা এহতেশামের হাত ধরে নূপুর নামের একটি মেয়ে সেলুলয়েডের ক্যামেরার সামনে দাঁড়াল। ছবির নাম ‘চাঁদনী রাতে’। সেই ছবিতে শাবনূর গেয়ে উঠলেন ‘কথা যদি শুরু করি শেষতো হবে না...’। সত্যি তার কথা প্রায় তিন দশকেও শেষ হয়নি। তার সুরেলা কণ্ঠের আওয়াজ শোনার জন্য দর্শক সবসময়ই অধীর হয়ে থাকে। আর তাই তো দীর্ঘ বিরতির পর আবার বড়পর্দায় ফিরতে সুদূর অস্ট্রেলিয়া থেকে ছুটে এসেছেন সেই চাঁদনী রাতের কন্যা শাবনূর। এবার তিনি অভিনয় করবেন চয়নিকা চৌধুরীর ‘মাতাল হাওয়া’ ছবিতে। এতে তার নায়ক হয়ে আসছেন দক্ষ অভিনেতা মাহফুজ আহমেদ। এ অভিনেতার সঙ্গে এর আগে শাবনূর প্রয়াত শহীদুল ইসলাম খোকনের ‘বাঙলা’ ছবিতে জুটি বেঁধেছিলেন।
শিল্পীদের ব্যাক করার কিছু নেই
দীর্ঘসময় ধরে চলচ্চিত্রে নেই, অনুভূতি কেমন জানতে চাইলে শাবনূরের সাফ কথা, ‘শিল্পীদের ব্যাক করার কিছু নেই। একজন শিল্পী সব সময় তীর্থের কাকের মতো মুখিয়ে থাকেন একটি ভালো গল্পের জন্য। আর মনের মতো গল্প পেলেই কাজ শুরু করে দেব। এ অপেক্ষায় আছি। এরই মধ্যে বেশ কিছুদিন আগে আগে রঙ্গনা নামের একটি ছবির কাজ শুরু করেছিলাম। এটি এখন শেষ করার অপেক্ষায় আছি। বলতে পারেন এর গল্প আমার বেশ মনে ধরেছে।
শিল্পীদের বয়স বলেও কিছু নেই
শাবনূর বলে চললেন, ‘ও হ্যাঁ আরেকটা কথা কিন্তু চির সত্য, আর তা হলো শিল্পীদের বয়স বলেও কিন্তু কিছু নেই, যে কোনো বয়সে মনের মতো চরিত্র পেলে কাজে নেমে পড়তে পারে। শিল্পীরা কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে চিরসবুজ, এ কথা মানতেই হবে। তাই আমার বয়স যতই হোক না কেন আমি অভিনয় করে যাব। আসলে আমাদের লাইফটাই এমন, মানে আমৃত্যু কাজে ডুবে থাকা’।
আবারও চলচ্চিত্রে ডুবে যাব
শাবনূর এবার আরেকটি সুখবর দিলেন। আর তা হলো তিনি আবারও চলচ্চিত্রের অভিনয়ে ডুবে যাবেন। দর্শক নন্দিত এই অভিনেত্রী বলেন, ‘প্রচুর নির্মাতা আমার কাছে গল্প নিয়ে আসছেন। প্রতিটা গল্পই মনকে মাতাল করে দেওয়ার মতো। আমি কোনটা ছেড়ে কোনটা রাখব বুঝতে পারছি না। তাই আমার মন বলছে আবারও অভিনয়ে ডুবে যাই। এখন তাই করব বলে মনস্থির করেছি।’
নির্মাণের কথাও ভাবছি
শাবনূর চলচ্চিত্র নির্মাণে তার অতীত সিদ্ধান্তের কথা মনে করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘আমি যখন চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিলাম তখন চলচ্চিত্র জগতের অবস্থা কোনো দিক দিয়েই সুখকর ছিল না। এখন দেখেশুনে মনে হচ্ছে চলচ্চিত্রের সুদিন আবার ফিরতে শুরু করেছে। তাই স্থির করেছি এবার হয়তো নির্মাণের ইচ্ছাটা পূরণ করতে পারি। তবে ভালো কিছু করার জন্য একটু সময় নিতেই পারি।’
আইজেন বড় অভিমানী
নিজের একমাত্র পুত্র আইজেনকে নিয়ে খুবই আবেগী শাবনূর। তাকে নিয়ে আবেগ ছড়িয়ে বলেন, ও বড় অভিমানী এবং খুব মেধাবী। ইংরেজি-বাংলা মিলিয়ে ওর আধো আধো কথা শুনতে খুব ভালো লাগে। ও আমাকে খুব টেককেয়ার করে। সবকিছুই করছে আমার জন্য আমার এতটুকু বয়সের আদরের আইজেন। আমার মনে হয়েছে আমি নই, ও-ই আমার গার্ডিয়ান। ওকে নিয়ে আমি খুব সুখী।
আমার জীবনের গল্পটা অন্যরকম
নিজের জীবনটাকে নিজের কাছে কেমন মনে হয়? এমন কথার জবাবে শাবনূরের তড়িৎ উত্তর হলো এমন, ‘একেকজন মানুষের জীবনের গল্প একেক রকমের। আমার জীবনের গল্পটা কিন্তু অন্যরকম। সবাই ছোটবেলায় খেলাধুলা করে, ঘুরে বেড়ায়,
রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ঝাল মুড়ি, বাদাম, আইসক্রিমসহ কত কী খায়, মেয়েরা ছোট বয়সে ছেলেদের সঙ্গে টাংকি মারে, প্রেম করে; আমি এসবের কিছুই পাইনি। যখন বুঝে ওঠার বয়স হলো তখনই ফিল্মে চলে এলাম। তাই এখন ছোট বেলাটাকে খুব মিস করি। শুধু তাই নয় ছোটবেলার দিনগুলোতে ফিরে যাওয়ারও চেষ্টা করি। গতবার যখন দেশে এসেছিলাম তখন ইচ্ছে হলো খোলা রাস্তায় রিকশায় চড়ে ঘুরে বেড়াই। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। বোরকা পরে রিকশায় চড়ে বাজার করলাম, রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ঝাল মুড়ি কিনে খেলাম। কেউ কিন্তু আমাকে একটুও চিনতে পারেনি। আরেকদিন ইচ্ছা হলো মুড়ির টিন মার্কা বাসে চড়ে মায়ের বাসায় যাব। বাসে চড়তে কেমন লাগে দেখতে চাই। তাই আমার এক বান্ধবীকে সঙ্গে নিয়ে চড়লাম শ্যামলী বাসে...মজা করে ঘুরে বেড়ালাম ঢাকা শহরের রাজপথে...উফ সে কী আনন্দ। মনের অজান্তে গেয়ে ওঠলাম- ‘ভালো আছি ভালো থেকো আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো...।’
সালমানের মৃত্যুসংবাদ কীভাবে পেয়েছিলেন?
হঠাৎ কেউ একজন জানাল, সালমান মারা গেছে। আমি বিশ্বাসই করতে পারিনি। ভেবেছিলাম কেউ মজা করছে। পরে নিশ্চিত হয়ে পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিলাম। এরপর এফডিসিতে গিয়ে ওকে শেষবার দেখি।