মৃৎশিল্প বাঙালির ঐতিহ্যের একটি অংশ। আধুনিকতার ছোঁয়ায় প্রায় বিলুপ্তের পথে এই শিল্পটি। তবে ঠাকুরগাঁওয়ে এই শিল্পকে ধরে রাখতে মৃৎশিল্পীদের হাতের ছোঁয়ায় প্রস্তুতকৃত পণ্যের প্রদর্শনী মেলার আয়োজন করা হয়েছে। এর পাশাপাশি জেলায় শীতের আগমনকে ঘিরে বাসানো হয়েছে পিঠা মেলাও। এই উৎসবে আনন্দ মেতে উঠেছেন সকলেই।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সারিবদ্ধভাবে নিজের হাতের তৈরী পণ্য নিয়ে চেয়ারে বসে আছেন একদল মৃৎশিল্পকারীগর। তাদের হাতে ছোঁয়ায় হারিয়ে যাওয়া এসব পণ্য পুনর্জীবিত করতেই এমন আয়োজন। পাশাপাশি জেলায় শীতের আগমনকে কেন্দ্র করে নারী উদ্যোক্তাদের সাথে নিয়ে করা হয়েছে পিঠা উৎসব।
এই উৎসবে মৃৎশিল্পীরা তাদের হাতের তৈরী বিভিন্ন খেলনা, কাপ-পিরিচ, ফুলদানি, মগ, প্লেট, চামুস, ডিনারসেট সহ বিভিন্ন পণ্য তৈরী করে রেখেছেন তাদের টেবিলে।
জানা যায়, মৃৎশিল্পীদের জীবনমান উন্নয়নে চলতি বছরের ৪ অক্টোবর জেলা প্রশাসনের আয়োজনে ২০ জন মৃৎশিল্পকারীগরকে সাথে নিয়ে করা হয় ১০ দিনের প্রশিক্ষণ। আজ জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ও জেলা পরিষদের সহযোগিতায় বিকেলে এই প্রশিক্ষণে কারীগরদের প্রস্তুতকৃত পণ্যগুলো প্রদর্শনী করা হয় ঠাকুরগাঁও শহরের ডিসি পর্যটন পার্কে।
উৎসবে জেলার নারী উদ্যোক্তারা তাদের হাতের তৈরী মালাই পিঠা, কলা পিঠা, ক্ষীর পিঠা, দুধ পুলি, নারিকেল পিঠা, পাটিসাপটা পিঠা সহ বিভিন্ন বাহারি সব নামের পিঠা নিয়ে বসেছে। যা দর্শনার্থীদের নজর কেড়েছে।
উৎসবে যোগ দিতে ছুটে এসেছেন বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থীরা সহ নানা বয়সী মানুষেরা। জেলায় প্রথমবারের মতো মৃৎশিল্পীদের প্রস্তুতকৃত পণ্য নিয়ে মেলার আয়োজন করায় খুশি সর্বস্তরের মানুষ।
সদর উপজেলার আকচা পালপাড়ার মৃৎশিল্পী সুবোধ পাল জানান, আমরা প্রজন্ম ধরে মাটি দিয়ে কাজ করছি। একসময় বাড়ি বাড়ি মাটির হাঁড়ি-পাতিল ছাড়া রান্নাই হতো না। এখন সেই দিন আর নেই। তবু এই মেলায় এসে মনে হচ্ছে মানুষ এখনো মাটির জিনিস ভালোবাসে। বিক্রিও বেশ ভালো হচ্ছে। প্রশাসন যদি এমন আয়োজন নিয়মিত করে, তাহলে এই পেশায় আবারও টিকে থাকা সম্ভব।
আরেক মৃৎশিল্পী মালতি রানী পাল বলেন, আমাদের এই শিল্প এখন টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। কাঁচামালের দাম বাড়ে, কিন্তু জিনিস বিক্রির দাম বাড়ে না। তবু আজকের এই মেলায় বেশ বিক্রি হয়েছে, মানুষ প্রশংসা করছে। নতুন করে কাজের উৎসাহ পেয়েছি।
নারী উদ্যোক্তা উম্মে কুলসুম বলেন, আমি নিজের হাতে পাটিসাপটা, চিতই আর ভাপা পিঠা বানিয়েছি। আগে শুধু বাড়ির জন্য করতাম, এখন বিক্রি করে আয়ও হচ্ছে। মানুষ আগ্রহ নিয়ে খাচ্ছে, দামও জিজ্ঞেস করছে- এইটাই আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি।
আরেক উদ্যোক্তা তামান্না বলেন, মেলায় এমন পরিবেশে পিঠা বিক্রি করা আনন্দের। লোকজন এসে বলছে, এই পিঠার স্বাদ ছোটবেলার মতো। এই কথাই সব পরিশ্রমের দাম দেয়।
ঠাকুরগাঁওয়ের জেলা প্রশাসক ইশরাত ফারজানা বলেন, কুমার জনগোষ্ঠীর সার্বিক জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে এবং জেলা পরিষদের অর্থায়নে আমরা কুমার পরিবার থেকে ২০ জন করে একটা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছি। সেই প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্য হচ্ছে আধুনিক জিনিসপত্র ও বর্তমানকালে যেসব জিনিসপত্রের চাহিদা রয়েছে হাতের তৈরির সেইসব বিষয়ে তাদেরকে ধারণা প্রদান করা।
তিনি আরও বলেন, পরবর্তীতে তারা যেসব জিনিসপত্র তৈরি করবে আমরা সেগুলো বাজারজাতকরণে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করব। যাতে তারা এই সময়ের উপযোগী ও মানুষের চাহিদা অনুযায়ী যদি জিনিসপত্র তৈরি করতে পারে। সেগুলো বাজারজাতকরণের মাধ্যমে তারা যেন জীবিকা নির্বাহ করতে পারে এবং তাদের সার্বিক জীবনমান উন্নয়নে তাদের এই পেশা কাজে লাগবে।
বিডি-প্রতিদিন/জামশেদ