ঘুমের খুব সমস্যা আমার। স্লিপিং পিল খেয়েও রাতের পর রাত ঘুম হয় না। দুপুরে ঘুমের অভ্যাস কোনোকালেই নেই। আজ খাওয়ার পর মাথা ভারী হয়েছিল। আসলে রাতে ঘুম না হলে এমনটা হয়। বিছানায় শুয়ে শুয়ে আকাশপাতাল ভাবতে ভাবতে যা কখনোই হয় না আজ তাই হলো। কখন একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল টেলিফোনের টানা শব্দে। অচেনা এক ভদ্রমহিলা আমার নাম বলে জানতে চাইলেন, আমি কি না। হ্যাঁ বলাতে তিনি লেখিকাদের একটা সংগঠনের নাম করে বললেন, সেখান থেকে বলছেন। জানতে চাইলেন, আমি তাদের সংগঠনে লেখা দিয়েছি কি না। বললাম, ওই সংগঠনের শীর্ষ ব্যক্তির আহ্বানে আমি লেখা দিয়েছি। মহিলা জানতে চাইলেন, কয়টা লেখা দিয়েছি। বললাম, একটা। এবার উনি বললেন, টাকা দিয়েছি কি না। আমি শোয়া থেকে উঠে বসলাম। কারণ বিষয়টা নিয়ে ইতোমধ্যে যথেষ্ট কথা হয়ে গেছে। যিনি আমার কাছ থেকে লেখা নিয়েছেন তিনি লেখা নেওয়ার আগে বলেননি টাকা দিতে হবে। বললে আমি কখনোই লেখা দিতাম না। বলেছেন লেখা পাঠানোর পর মেসেঞ্জারে। তাকে জানিয়ে দিয়েছি, টাকা দিয়ে আমি লেখা ছাপি না। সারা জীবনে কোনো প্রকাশক বা অন্য কাউকে পাঁচ টাকাও দিইনি। আমার লেখা যেন না ছাপা হয়। আমি ওনার কথায় দুটি লেখা তৈরি করেছিলাম। ওনার এ কথার পর আমি দ্বিতীয় লেখাটা আর পাঠাইনি। উনি গাঁইগুঁই করে বলেছেন, আমার কাছে টাকা চাননি। আমি লেখা দিয়েছি এটাই যথেষ্ট। উনি শুধু অবগতির জন্য জানিয়েছিলেন। টাকা যদি না চান, আমার অবগতির দরকার কী। আগে অবগত করালে তো আমি লেখাই দিতাম না। এ ধরনের কাজ নৈতিকতাবিরোধী। এরপর আমি আর কথা বাড়াইনি। ভদ্রমহিলা যথেষ্ট বয়স্ক, এখনো উদ্যম নিয়ে কাজ করেন। বয়স্ক মানুষের সঙ্গে কথাকাটাকাটি করতে আমার ইচ্ছা হয়নি। লেখা ছাপতে বারণ করেছি এটাই যথেষ্ট। আর বাড়তি কথার তো দরকার নেই। কিন্তু এরপর আবার কেন টাকা চেয়ে ফোন এলো। আমার মাথা ঠিক রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়াল। কোনোক্রমে মেজাজ ঠিক রেখে এই কথাগুলোই মহিলাকে বললাম।
এমন বেশ কিছু সংগঠন আছে ঢাকাসহ সারা দেশে, যাদের কাজই হচ্ছে নিজেরা চাঁদা তুলে বড় বড় অনুষ্ঠান করা, বই বের করা, পুরস্কার দেওয়া। এমনকি এরা নিজেরাই নিজেদের পুরস্কার দিয়ে থাকে। অবাক লাগে আমার। নিজেদের পুরস্কার নিজেরা নেয় কী করে! ১৯৯২ সালের কথা। মাঠ প্রশাসন থেকে সবে সচিবালয়ে পোস্টিং হয়েছে। একদিন জাদুঘরের সামনে দিয়ে যাচ্ছি। দেখি এরকম একটা নারী সংগঠনের ব্যানার। তাদের অনুষ্ঠান হচ্ছে। তখন ওই সংগঠনটিতে বড় বড় নারীরা ছিলেন। অনেকে নামে অনেক ভারী। তবে লেখক হিসেবে ততটা ভারী মনে হতো না আমার অনেককেই। তবে সেই ১৯৯২ সালে শতপ্রতিকূলতার মাঝে তারা যে লিখছিলেন, লেখাকে বাঁচিয়ে রাখছিলেন এটাই বড় কথা।
আমি হাঁটতে হাঁটতে জাদুঘরে ঢুকলাম। পুরোটা অনুষ্ঠান দেখলাম। পরদিন একটা ফিচার লিখে দৈনিক জনকণ্ঠে পাঠিয়ে দিলাম। দিন কয়েক পরে লেখাটা ছাপা হয়ে গেল। তখন ওই সংগঠনের কাউকে আমি চিনতাম না। ওরাও কেউ আমাকে চিনত না। অনেক পরে সংগঠনের একজন শীর্ষ লেখিকার সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়। তিনি একজন চমৎকার মনের দরদি মহিলা ছিলেন। আমাকে স্নেহ করতেন। মাঝেমধ্যে ছোট ছোট চিঠি লিখতেন। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার কোনো দিন তার সংগঠনে আমাকে যুক্ত হতে বলেননি। উনি ওনার বোধ বিবেচনা দিয়ে বুঝেছিলেন, সংগঠনের ভালোমন্দ আমি লিখব ঠিক আছে কিন্তু সংগঠনে যুক্ত হব না। তা ছাড়া যেসব সংগঠন নারী লেখক পুরুষ লেখক বলে একটা ভেদরেখা টেনে দেয় সেখানে আমি কোনো দিনই যাব না। ওই আপা মারা গেছেন বহুদিন। তারপর যারা সভাপতি সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তারা সবাই আমার চেনা। কেউ কেউ টানা অনেক দিন ছিলেন। প্রত্যেকেই ওই সংগঠনের শ্রেষ্ঠ লেখকের পুরস্কারটি নিয়েছেন। লাজে মরে যাই! আরও মজার ব্যাপার পুরস্কার নেওয়া হয়ে যাওয়ার পর কেউই আর তেমনভাবে সক্রিয় থাকেননি। এখন নেতৃত্ব তরুণ ঠিক বলা যাবে না অপেক্ষাকৃত কম বয়সিদের হাতে। যাদের লেখক হিসেবে তেমন নামধাম নেই।
তাদেরই একজন সম্প্রতি আমাকে ফোন করলেন। লেখার জগতে দীর্ঘদিন ধরে থাকায় এখন সবাই সবাইকে চিনি। সেটাই স্বাভাবিক। মেয়েটি সংগঠনে তার পদবি জানিয়ে বলল, মাত্র তিন-চার দিনের মধ্যে আমি একটা লেখা দিতে পারব কি না। লেখার বিষয়টা আমার ভালো লাগল। তা ছাড়া এক দিন দুই দিন চার দিন ব্যাপারগুলো আমাকে খুব আনন্দ দেয়, চ্যালেঞ্জিং মনে হয়। রাজি হলাম। ওর দেওয়া তারিখের আগেই লেখাটা হয়ে গেল। খুব খেটে লিখেছি। আমার ধারণা লেখাটা বেশ ভালো হয়েছে। লেখা পাঠাব তখন হঠাৎ করেই আমার সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতাটা মনে হলো। এরা আবার টাকা নেওয়া পার্টি না তো? আমি মেয়েটার কাছে মেসেঞ্জারে জানতে চাইলাম, লেখার সঙ্গে কোনো টাকা দিতে হবে কি না। সে জানাল ৩ হাজার টাকা দিতে হবে। আমি কি পানিতে পড়েছি, নাকি আমার লেখা কোনো দিন ছাপা হয় না যে ৩ হাজার টাকা দিয়ে লেখা ছাপাব বরং এ লেখার জন্য আমাকেই ৩ হাজার কেন আরও বেশি টাকা দেওয়া উচিত। অনেকে বলতে পারেন, বলেনও, সংগঠন চালাতে গেলে টাকা লাগে। বই বের করতে গেলে টাকা লাগে। চাঁদা না দিলে এরা পাবে কি করে! ন্যায্য কথা! সংগঠন চালাতে গেলে টাকা লাগে। মাসিক ভিত্তিতে যেটুকু লাগে টাকা নিন, যতটুকু প্রয়োজন। বড় বড় প্রজেক্ট বানিয়ে এক লেখার জন্য ২ হাজার, দুই লেখার জন্য ৩ হাজার, তিন লেখার জন্য ৫ হাজার টাকা চাঁদা ধার্য করে বইমেলায় স্টল দিয়ে সেই বই পুশ সেলিং করে করে সাহিত্য শিল্প-সংস্কৃতির কী লাভ হচ্ছে? এভাবে বই বের করে লাভ কী। বরং ভালো লেখার চেষ্টা করে পেশাদার পাবলিশার দিয়ে বই বের করলে সেটার আলাদা মূল্য আছে। নিজের প্রকাশনা থেকে নিজের বই বের করলে মানুষকে তো বলাও যায় না। ধরে নিলাম, একটা সময় হয়তো তারা ভেবেছিলেন নারীদের একত্র হওয়া প্রয়োজন, তারা একত্র হয়েছিলেন। নারীদের অবস্থা তখন খুবই নাজুক ছিল হয়তো। নারীর অবস্থা এখনো নাজুক, তারপরও তারা স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নিয়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে, পুরুষের সমানতালে লিখছে। নারীদের পেছনে ফেলে রাখার চেষ্টা এখনো আছে। তারপরও নারীরা লিখছে, পুরস্কার পাচ্ছে, তাদের বই বের হচ্ছে। তাহলে নিজেদের নারী নারী বলে এভাবে আলাদা করে দলছুট রাখার প্রয়োজন কী?
একবার একটা সংগঠন থেকে আমাকে খানিকটা জোরাজুরি করে পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল। আমি পুরস্কার নিতে গিয়ে অবাক হয়ে দেখেছিলাম, সেই সংগঠনের প্রেসিডেন্ট, জেনারেল সেক্রেটারি পুুরস্কার পাচ্ছে নিজ সংগঠনের। লজ্জায় ঘৃণায় সে পুরস্কার আমি কোনো দিন বের করিনি। যে পুরস্কার লুকিয়ে রাখতে হয় তেমন পুরস্কার আমি কেন নেব? আমাদের সাহিত্য সংগঠনসহ সব ধরনের সংগঠনের মধ্যে ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দ রেশারেশি দলাদলি প্রকট। একই সংগঠনে কারও জন্মদিন পালিত হচ্ছে কারও হচ্ছে না, কেউ পুরস্কার পেলে অনুষ্ঠান হচ্ছে, কারওটা হচ্ছে না, কারও বাড়ির অনুষ্ঠানে কেউ দাওয়াত পাচ্ছে কেউ পাচ্ছে না। কারও কারও প্রতি পক্ষপাতিত্ব প্রবলভাবে চোখে পড়ে। সংগঠনে প্রতি সদস্যের মূল্য সমান হওয়া উচিত। সেখানে কোনো পক্ষপাতা থাকা উচিত না। কিন্তু এ দেশের অধিকাংশ সংগঠনে সেটা হয় না। সংগঠনে কেউ হয় প্রধান কেউ অপ্রধান।
আজকাল অদ্ভুত অদ্ভুত কথা শুনি। একসময় আমরা টাকা দিয়ে বই ছাপানোর কথা ভাবতে পারতাম না। এখন টাকা দিয়ে বই ছাপানোই দস্তুর। অল্প কিছু প্রকাশক বাদে অধিকাংশ প্রকাশক লেখকের টাকা নিয়ে বই ছাপছেন। বই ছেপে ব্যবসা করছেন। ব্যবসা করতে এসেছেন প্রকাশকরা, ব্যবসা করবেনই কিন্তু তাই বলে লেখকদের পথে বসিয়ে নয়। আজকাল আর একটা কথাও বাতাসে ভাসে। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না। নিজে যেহেতু কোনো দিন এসব করিনি, বিশ্বাস হওয়ার কথাও না। কোনো কোনো লেখক নাকি সম্পাদককে ক্যাশ বা কাইন্ডস দিয়ে লেখা ছাপান। কতটা সত্যি জানি না। তবে শুনতে বড় খারাপ লাগে।
যা হোক, নারী সংগঠনের টাকা নিয়ে বই ছাপানোর ব্যাপারে লেখা শুরু করেছিলাম। আপনারা যা করছেন করুন। তবে এতে করে গুদাম বোঝাই আর তেলাপোকার বংশবৃদ্ধি ছাড়া আর কিছু হবে বলে আমার মনে হয় না। তা ছাড়া এখানেই শেষ নয়, এরপর বই বিক্রি করার, কেনার আর একটা চাপ আছে। একজন লিখবে নাকি এসব চাপ সহ্য করবে। সবশেষে বলি, এটা কোনো ভালো কালচার না, অনুসরণযোগ্য কালচার না। কাজেই এ ধরনের কাজ পরিত্যাজ্য।
লেখক : কথাশিল্পী, গবেষক