পৃথিবীর সব দেশেই কমবেশি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটে থাকে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। দেশের প্রত্যেক জেলাতেই কমবেশি ধর্ষণ, খুন, অপহরণ, চুরি, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, ভূমি দখল এসবের মতো জঘন্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটে থাকে। এসব ঘটনার কোনোটার বিচার হয়, আবার কতক ক্ষেত্রে অপরাধীরা আইনের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যায়, কতক ক্ষেত্রে প্রশাসন নীরব থাকে, আবার কতক ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী নিজেই চেপে যায়। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলাতেও ধর্ষণ, খুন, অপহরণ বা চাঁদাবাজির মতো অপরাধমূলক ঘটনা ঘটে থাকে। তবে এ ক্ষেত্রে এক ভয়ংকর প্রবণতা হলো বিচারের আগেই সামাজিক প্রতিক্রিয়া হয়ে পড়ে সহিংস। অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় শুরু হয় কুটিল রাজনীতি। এসব অপরাধমূলক ঘটনাকে রাজনৈতিক রং দেওয়ার কারণে সেখানকার পাহাড়ি জনগোষ্ঠী ও বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্যে সহিংসতা দেখা দেয়। যেমন ২৩ সেপ্টেম্বর এক পাহাড়ি স্কুলছাত্রীর অপহরণ ও ধর্ষণের অভিযোগকে কেন্দ্র করে খাগড়াছড়ি জেলায় কয়েক দিন ধরে ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটে। একে কেন্দ্র করে শুরু হয় পাহাড়ি ও বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্যে উত্তেজনা। ঘটনার তদন্তের আগেই পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর লোকজন বাংলাভাষী লোকজনের ওপর ক্ষিপ্ত হয়। ঘটনায় অভিযুক্ত নয়ন শীল নামের একজন যুবককে গ্রেপ্তার করা হলেও পরিস্থিতি শান্ত হয় না। জুম্ম ছাত্র-জনতা এই ছদ্মবেশী ব্যানারে খাগড়াছড়ি জেলাজুড়ে হরতাল অবরোধের ডাক দিয়ে ওই এলাকার জনগণকে অবরুদ্ধ করে ফেলা হয়।
অতীতের কয়েকটি ঘটনাতেও দেখা গেছে যে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর কেউ নিপীড়নের শিকার হওয়ামাত্রই পুরো পাহাড়কে উত্তপ্ত করে ফেলা হয়েছে। তদন্ত ও বিচারের আগেই পুরো দায় বাংলাভাষী জনগণের ওপর চাপানো হয়েছে এবং পাহাড়ে শান্তি রক্ষার কাজে নিয়োজিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ওপর অযথাই অভিযোগের তির ছোড়া হয়েছে। ২০১৭ সালে খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজের ছাত্রী ইতি চাকমাকে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছিল। এ ঘটনা বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর কেউ ঘটিয়েছে এমন দাবি তুলে সামাজিক মাধ্যমে এবং মাঠে আন্দোলন শুরু হয়। উত্তপ্ত হয়ে ওঠে রাজপথ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম। কিন্তু পরবর্তী সময়ে পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে তুষার চাকমা ও তার সহযোগী পাঁচজন চাকমা যুবক এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, কারণ ইতি তার প্রেম প্রত্যাখ্যান করেছিল।
ওই বছর ২০১৭ সালে আরেকটি ঘটনা ঘটেছিল। পানছড়িতে বালাতি ত্রিপুরাকে হত্যা করে সাধন ত্রিপুরা ও তার সহযোগীরা। প্রথমে তিন বাংলাভাষীকে দোষারোপ করে আন্দোলন শুরু হয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সংগঠনগুলো। কিন্তু তাদের কূটকৌশল ধরা পড়ে যায়। ঘটনার মাত্র ছয় দিনের মাথায় বালাতি ত্রিপুরার খুনের মূল নায়ক কার্বারি সাধন ত্রিপুরা নামক একজনকে গ্রেপ্তার করে পানছড়ি থানার পুলিশ। তদন্তের পর সাধন ত্রিপুরা গ্রেপ্তার হন, যিনি নিজেই বাংলাভাষীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করেছিলেন। (সূত্র : দৈনিক পূর্বকোণ, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০১৭)।
এর আগের বছর ২০১৬ সালে এক বাংলাভাষী ছেলের দোকানে কলেজে ভর্তির আবেদন করতে যাওয়ার ‘অপরাধে’ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর একটি সংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতারা আয়না চাকমাকে ধরে নিয়ে যৌন নির্যাতন করে। পুলিশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে, কিন্তু উল্টো গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মুক্তির দাবিতে হরতাল-অবরোধ ও বিক্ষোভ করে খোদ পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ সংগঠন। (সূত্র : পরিবর্তন ডটকম, ২৭ জুন ২০১৬)।
২০১৪ সালে ঘটেছিল বিশাখা চাকমা ধর্ষণ ও হত্যা। রাঙামাটিতে বিশাখা চাকমার লাশ কাপ্তাই হ্রদে পাওয়া যায়। ঘটনার পরপরই শুরু হয় বাংলাভাষীদের দোষারোপের রাজনীতি। শুরু হয় সমাবেশ-মানববন্ধন। কিন্তু পুলিশি তদন্তে দেখা যায় তার স্বামী লক্ষ্মীরাম চাকমার উপস্থিতিতে সঞ্জয়, তত্তারাম ও বিনোদ চাকমা মিলে ধর্ষণ ও হত্যা করে। পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে। (সূত্র : সিএইচটি টাইমস, ২২ নভেম্বর ২০১৪)। ওই একই বছর ২০১৪ সালে বান্দরবানে ব্র্যাক স্কুলের শিক্ষিকা উ প্রু মারমাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে তোলে স্থানীয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সংগঠনের সদস্যরা বাংলাভাষী কাঠুরিয়া মুসলিম উদ্দিনকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তদন্তে দেখা যায় ওই ধর্ষণ ও হত্যার মূল খলনায়ক রশদ তঞ্চঙ্গ্যার ছেলে বিজয় তঞ্চঙ্গ্যা, যে একজন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর যুবক। (সূত্র : পার্বত্য নিউজ, ৮ জুন ২০১৪)।
২০১৪ সালের আরেকটি ঘটনা হলো, খাগড়াছড়ির কমলছড়িতে সবিতা চাকমার লাশ পাওয়া যায়। বাংলাভাষী ট্রাক ড্রাইভার ও হেলপারকে দায়ী করে গণধর্ষণের অভিযোগে আন্দোলন করে উপজাতীয় সংগঠন। কিন্তু ময়নাতদন্তে ধর্ষণের কোনো আলামতই পাওয়া যায়নি। এখানে উল্লেখ্য যে খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালসহ পাহাড়ের হাসপাতালগুলোতে অধিকাংশ চিকিৎসকই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর।
এদিকে ২০১৮ সালের ২৮ জুলাই খাগড়াছড়ির দীঘিনালার ৯ মাইলে কৃত্তিকা ত্রিপুরা নামে পঞ্চম শ্রেণির এক শিশুকে হত্যা করা হয়। পাহাড়ি সংগঠনগুলো এই ধর্ষণ ও হত্যার দায় চাপায় বাংলাভাষীদের ওপর। আন্দোলনের মাধ্যমে পরিস্থিতি উপ্তপ্ত করে তোলা হয়েছিল এবং স্থানীয় পুলিশকে বাধ্য করে ঘটনার সঙ্গে জড়িত মর্মে দুই বাঙালির স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছিল। পরে পিবিআইয়ের তদন্তে সগোত্রীয়রা জড়িত বলে প্রমাণ হয়। (সূত্র : দৈনিক আমার দেশ, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫)।
এভাবে তিন পার্বত্য জেলার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশু ও নারীর পরিচালিত নিপীড়নের ঘটনাগুলো রাজনৈতিক রং লাগিয়ে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা হয়। ২০২৫ সালের ১৯ আগস্ট ৫ জন মারমা নৃগোষ্ঠীর যুবক স্বগোত্রীয় এক মারমা স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণ করে। কোনো সংগঠন প্রতিবাদ করেনি, বরং ঘটনা চেপে যাওয়া হয়। স্থানীয় সালিশে শুকর জরিমানা দিয়ে বিচার মীমাংসার চেষ্টা হয়। ২০২৫ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর রাতে কক্সবাজারের কলাতলী এলাকায় ঘটে যায় আরেকটি বিভীষিকাময় ঘটনা। চাকমা দম্পতি রঞ্জন চাকমা ও তার স্ত্রী স্থানীয় একটি সুপারিবাগানে কাজ করতেন। সেই পরিচয়ের সূত্র ধরে চাকমা যুবক বীরেল চাকমা একদিন সেখানে হাজির হয়। মদ্যপ অবস্থায় স্ত্রীকে কুপ্রস্তাব দিলে রঞ্জন বাধা দেন। তাতেই ক্ষিপ্ত হয়ে বীরেল চাকমা রঞ্জনকে দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে, এরপর তার স্ত্রীর ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। সেনাবাহিনী ঘটনাস্থল থেকে অভিযুক্তকে রক্তমাখা অবস্থায় আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। ঘটনাটি ছিল ভয়াবহ, নির্মম ও নৃশংস।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর পার্বত্য জেলার পরিস্থিতি আরও বেশি অস্থির হয়েছে। ওই বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর ভোররাতে খাগড়াছড়ি জেলা সদরে ফার্নিচার ব্যবসায়ী মো. মামুনকে মোটরসাইকেল চুরির অভিযোগে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার জেরে দীঘিনালা, খাগড়াছড়ি সদর এবং রাঙামাটি সদরে পাহাড়ি ও বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্যে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। এতে হতাহতের ঘটনা ঘটে এবং জানমালের ক্ষতি হয়। ওই সহিংস ঘটনার প্রথম বার্ষিকী উপলক্ষে জুম্ম ছাত্র-জনতা ব্যানারে এ বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর পাহাড়িদের ছদ্মবেশী সংগঠন কর্মসূচি আয়োজন করে। এরপর ২৩ সেপ্টেম্বরের ওই মারমা স্কুলছাত্রী নিপীড়নের ঘটনা পুরো পরিস্থিতিকে সহিংস করে তোলে। বস্তুত পার্বত্য জেলার খুন, গুম, ধর্ষণ, অপহরণ এসব অপরাধকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করছে কিছু গোষ্ঠী, যারা আইনের বাইরে থেকে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করছে। এদের উদ্দেশ্য হলো পার্বত্য চট্টগ্রামে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। তারা নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলোকে ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক সহানুভূতি অর্জনের চেষ্টা করে। এরা গণমাধ্যমে বিভ্রান্তিকর প্রচারণা চালায়, বাংলাভাষীদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ায়, সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালায়। এভাবে তারা পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারতের সঙ্গে একীভূত করার মূল লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে চায়।
এখন এই অশুভ লক্ষ্য ব্যর্থ করতে হলে জনগণের করণীয় হলো, অপরাধের বিচার চাইতে হবে আইন ও ইনসাফের ভিত্তিতে। ধর্ম, জাতি বা গোত্রের ভিত্তিতে নয়। অপহরণ, খুন, ধর্ষণ ও চাঁদাবাজির মতো ঘটনায় সব রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলোকে পক্ষপাত ত্যাগ করে নৈতিক অবস্থান নিতে হবে। প্রথাগত সালিশ নিষিদ্ধ করে, প্রচলিত আইনের আওতায় বিচার নিশ্চিত করতে হবে। নারীকে রাজনীতির হাতিয়ার নয়, সম্মানিত মানুষ হিসেবে দেখতে হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বাংলাভাষী এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকজন সবাই এ দেশেরই গর্বিত নাগরিক। এদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব। ভারতীয় মদতপুষ্ট কুচক্রী মহলের ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করতে হলে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে। শান্তি, সম্প্রীতি ও উন্নয়নের পথে হাঁটতে হলে জাতিগত বিভেদ পরিহার করে ন্যায়ের ভিত্তিতে প্রতিবাদ করতে হবে। কোনো নারীর সম্ভ্রমহানি ঘটবে, আর সেটাকে পুঁজি করে রাজনৈতিক অভিসন্ধি পূরণের চেষ্টা করা হবে- এটা মেনে নেওয়া যায় না। কেননা এটি নারীর মানবিক মর্যাদার প্রশ্ন।
লেখক : রাজনীতি বিশ্লেষক