যিনি দুরধিগম্যা, আমাদের দুর্গতিনাশে কৃপাময়ী দক্ষিণামূর্তিতে নিত্য অভিষিক্তা, ভবসমুদ্র পারকারিণী ও সর্বকারিণী পরমাদেবী তিনিই দুর্গা। এভাবেও ব্যাখ্যা করা যায়, বিদ্যারূপ শস্ত্র দ্বারা অজ্ঞানরূপ দুর্গতির বিনাশ করেন বিধায় তিনি দুর্গা। দেবী দুর্গাই অখণ্ডেশ্বরী জগন্মাতৃকা মহামায়া। তিনি সব প্রকাশের কারণস্বরূপিণী ও সর্বশক্তিসমন্বিতা। দিব্য-আসুরী, পাশবিক-মানবিক, শুভ-অশুভ ও ভালো-মন্দ সবকিছুই সেই অদ্বিতীয়া ব্রহ্মশক্তির আপেক্ষিক প্রকাশ। তাই তিনি যেমন মহাদেবী তেমন মহাসূরী। ঋগে¦দ সংহিতা, কেনোপনিষৎ ও দেবীমাহাত্ম্যে স্পষ্টই বলা হয়েছে, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে তাঁকে ছাড়া দ্বিতীয় কিছুই নেই। অর্থাৎ তিনিই সবকিছুর ঊর্ধ্বে বিরাজিতা নির্গুণা অব্যক্ত সত্তা। বৈদিক শাস্ত্র অনুসারে তিনিই ব্রহ্ম; আমরা তাঁকে মাতৃরূপে উপাসনা করি। অবশ্য তাঁকে কন্যারূপে উপাসনা করার চলও আছে। ঋষি কাত্যায়ন তাঁকে কন্যারূপে চেয়েছিলেন। কাত্যায়নের মেয়ে বলে তিনি কাত্যায়নী। প্রজাপতি দক্ষ ও রাজা হিমালয় দেবীকে বাৎসল্য ভাবেই অবলোকন করেছিলেন। হিমালয়ের স্ত্রী মেনকার বাৎসল্য ভাবের কথা তো আজও লৌকিক সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে আছে। আমরা বাংলা ভাষায় দুর্গাপূজাসংক্রান্ত যত গান শুনি তার বড় অংশ মেনকার বাৎসল্য ভাব কেন্দ্র করে লেখা।
দেবী সচ্চিদানন্দময়ী, দ্বন্দ্বাতীত ও আদ্যা। অনাদি অনন্ত দেবীর স্বভাবেই নিহিত রয়েছে শক্তি। দেবীই সৎ বা নিত্য বিরাজমান- ব্যাপ্তিরূপস্বরূপ এক অদ্বয় অস্তিত্ব। তিনিই চিৎ বা চৈতন্যস্বরূপ। তিনি আনন্দ বা রসস্বরূপ ও মুক্ত। রস হলো নৈঃশব্দ্য, ভয়মুক্ত হৃদয়, অভিজ্ঞতার সার, ক্ষুদ্র ‘আমি’র অনুপস্থিতি ও সৌন্দর্যের স্বাদ। রস চেতনার অভ্যন্তরীণ বিকাশ ও পূর্ণতার প্রতীক। রসই সেই বস্তু যা সব দ্বৈতের দেয়াল ভেঙে অদ্বৈত চেতনার দিকে আমাদের নিয়ে যায়। দেবীর এই স্বরূপকে চিনতে পারলে সার্বিক কল্যাণ সম্ভব। দেবী দুর্গার মধ্যেই চলছে নাম-রূপের লীলা। দেবীই সাধ্য রূপে পরমাশক্তি, সাধক রূপে তিনিই ও তিনিই একমাত্র সাধনা। তিনিই দ্রষ্টা, তিনিই দৃশ্য ও তিনিই দর্শন। তিনিই জ্ঞান, জ্ঞেয় ও জ্ঞাতা। তিনিই বিদ্যা আবার তিনিই অবিদ্যা। জ্ঞানও তিনি আবার ভ্রান্তিও তিনিই। তিনিই মহামায়া ও তিনিই যোগমায়া। সত্ত্ব, রজঃ ও তমো এই ত্রিগুণ তাঁরই প্রকাশ মাত্র। অথচ তিনি ত্রিগুণাতীত। বদ্ধ জীবের মাঝে তিনিই জীবচৈতন্য ও সবকিছুর ঊর্ধ্বে তিনিই ব্রহ্মচৈতন্য। তিনি সর্বদেবময়ী সর্বেশ্বরী অনাদির আদি। দেবী দুর্গা হলেন রাজরাজেশ্বরী। সব জ্ঞান, সব ঐশ্বর্য, সব তেজ ও সব দিব্য সম্পদ তিনি ধারণ করে আছেন বিধায় তিনি রাজরাজেশ্বরী। তিনিই সৌভাগ্যরূপিণী। বিপুল ঐশ্বর্য, ধন, যশ, সৌন্দর্য ইত্যাদি তাঁর থেকে ভিন্ন নয়। তাই দেবীকে ঠিকভাবে অর্চনা করলে ঐশ্বর্য, যশ, সৌন্দর্য ইত্যাদি লাভ হলেও মন বিচলিত হয় না।
দেবী অসীম দেশকালের অধিষ্ঠাত্রী বিশ্বাত্মিকা এবং দেশকালের অতীত বিশ্বোত্তীর্ণা চিদানন্দময়ী। তিনিই সত্য। আমরা সত্য বলে যাঁকে চিনি তা তাঁর আরেকটা প্রকাশ মাত্র। সৎ, সত্তা আর সত্ত্ব তাঁর ওপরই প্রতিষ্ঠিত। এই সত্যকে আমরা শিব বলি। তিনি এই সত্যের জন্মদাত্রী ও তিনিই এই সত্যকে বিকাশের পথে নিয়ে যান। সত্যই কল্যাণ, সত্যই জ্ঞান ও সত্যই অদ্বৈত। তাই শিবরূপী সত্যকেই পতিত্বে বরণ করেন তিনি। অর্থাৎ তিনি শিবের জননী ও রমণী দুটোই। তিনিই দেহে কুলকুণ্ডলিনী ও সারা বিশ্বে ব্রহ্মস্বরূপিণী মহাশক্তি রূপে বিরাজিতা। তাঁকে ভাষা, বাক্য ও যুক্তির অধীনে আনা যায় না। কারণ বাক তাঁর একটি বিশেষ রূপ যার আশীর্বাদে আমাদের এত উন্নতি। তাঁর রূপ গুণ কিছুই আমাদের পক্ষে বোঝা ও জানা সম্ভব হতো না যদি বাক্সময়ীরূপে আমাদের আশীর্বাদ না করতেন। তিনি ভোগ ও নিবৃত্তি দুটিই দেন। তিনি যেমন ঐশ্বর্যময়ী তেমন ভবসাগর পারের তরণি। তিনি আনন্দের তেজঘন রূপ হয়ে হৃদিপদ্মে বিরাজ করেন বিধায় তাঁকে কমলা বলা হয়। সত্যের চিরন্তন প্রেরণা বিধায় তিনি সনাতনী। দেবী দুর্গা জগতের প্রসবিতা ও তিনি আমাদের বুদ্ধিবৃত্তি প্রণোদিত করেন। যে তেজ সমগ্র জগৎ উদ্ভাসিত করে ও যে তেজ সর্বত্র বিরাজমান তা দেবী থেকেই প্রাপ্ত।
দেবীর দিব্যজ্যোতিই সর্বত্র তেজ প্রদান করে, যা থেকে প্রাণশক্তির বিকাশ। তাই দেবীর বরণীয় জ্যোতিকে আমাদের হৃদয়ে ধারণ করার চেষ্টা করি। দেবী দুর্গাই ওঙ্কার। ওঙ্কারকে প্রণব বলা হয়। নু ধাতুর অর্থ ডাকা বা স্তব করা। এ ক্ষেত্রে প্রণব অর্থ দাঁড়ায় প্রকৃষ্ট উপায়ে ডাকা, সুন্দরভাবে ডাকা ও প্রীতি সহকারে ডাকা। বোঝা গেল, প্রণব উচ্চারণ দ্বারা দেবী দুর্গাকেই স্মরণ করা হয়। অর্থাৎ দুর্গাতত্ত্ব উপলব্ধি দ্বারা ব্রহ্মতত্ত্ব উপলব্ধি করা যায়।
লেখক : গবেষক