আরবি শব্দ খুতবার আভিধানিক অর্থ ভাষণ, বক্তৃতা, উপদেশ, প্রস্তাবনা, ঘোষণা, সম্বোধন, ওয়াজ ইত্যাদি। খুতবা জুমার নামাজের আগে, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার নামাজের পরে, পবিত্র হজে আরাফার দিনে, বিয়ের অনুষ্ঠানে ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে খলিফার প্রতিনিধি, দায়িত্বশীল ব্যক্তি, ইমাম বা খতিব কর্তৃক প্রাসঙ্গিক বক্তৃতা বা ভাষণ।
খুতবার প্রচলন : হজরত রসুল (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের পর ইসলামের ইতিহাসের প্রথম মসজিদ ‘মসজিদে কুবা’তে প্রথম জুমার নামাজ আদায় করা হয়। এতে হজরত রসুল (সা.) নিজেই ইমামতি করেন। সেদিন জুমার নামাজের আগে আল্লাহর রসুল (সা.) দুটি খুতবা প্রদান করেন। তখন থেকেই শুক্রবারে জুমার নামাজের জামাতের আগে দুটি খুতবা প্রদানের প্রথা প্রচলিত হয়। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, ‘নবী করিম (সা.) জুমার নামাজের আগে দুটি খুতবা দিতেন। একটা শেষ করে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য বসতেন, তারপর দ্বিতীয় অংশটি দিতেন। খুতবার মাঝে তিনি পবিত্র কোরআনের আয়াত তিলাওয়াত করে মানুষকে উপদেশ দিয়ে বোঝাতেন।’ (মুসলিম শরিফ, কিতাবুল জুমা)। ‘খুতবা’ জুমার নামাজের শর্ত বা ফরজ। খুতবা ছাড়া জুমার নামাজ হয় না। উপস্থিত মুসল্লিদের জন্য খুতবা শোনা ওয়াজিব। খুতবা চলাকালে নিরর্থক কথা ও কাজে মশগুল থাকা শরিয়তের দৃষ্টিতে বৈধ নয়। বিশিষ্ট সাহাবি হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, হজরত রসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘জুমার দিন খুতবা প্রদানের সময় যদি তুমি তোমার সঙ্গীকে বল, “চুপ কর,” তখন তুমি অনর্থক কথাই বললে।’ (বোখারি শরিফ, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১২৭ ও ১২৮)। অন্য এক হাদিসে বর্ণিত আছে, ‘যখন ইমাম খুতবার জন্য বের হবেন, তখন নামাজ পড়বে না, কথাও বলবে না।’ (মেশকাত শরিফ, ৩/৪৩২)।
খুতবার গুরুত্ব : হজরত রসুল (সা.) জুমার নামাজে খুতবা দেওয়ার কারণে জুমার নামাজ অধিক গুরুত্ব লাভ করেছে। আল্লাহর রসুল (সা.) জুমার খুতবায় সাহাবিদের উদ্দেশে মহামূল্যবান বাণী পেশ করতেন। তাঁর বাণী মোবারকে সঠিকভাবে ধর্ম পালনের প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা থাকত। সাহাবায়ে কেরাম পরবর্তী শুক্রবার আসার আগপর্যন্ত আল্লাহর রসুল (সা.)-এর নসিহত অনুযায়ী সপ্তাহের বাকি ছয়টি দিন অতিবাহিত করতেন। শুক্রবার জুমার নামাজের গুরুত্ব অত্যধিক। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, হজরত রসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যারা স্বেচ্ছায় জুমার নামাজ পরিত্যাগ করবে, তাদের অন্তর রুক্ষ হয়ে যাবে এবং তারা মোনাফেক ও কপট বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হবে।’ হজরত রসুল (সা.)-এর যুগে জুমার নামাজে অংশগ্রহণ করে সাহাবায়ে কেরাম আল্লাহর রসুল (সা.)-এর সোহবত লাভ করতেন এবং তাঁর বরকতময় নসিহত শুনে হৃদয়ে অফুরন্ত শান্তি পেতেন এবং তাঁদের মাঝে আত্মিক পরিশুদ্ধতা অর্জন হতো। সেই যুগে সঠিকভাবে ধর্ম পালনের জন্য মনোযোগ দিয়ে হজরত রসুল (সা.)-এর খুতবা শোনা এবং তদনুযায়ী আমল করা সাহাবায়ে কেরাম সর্বাধিক গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতেন। উল্লেখ্য একদা হজরত রসুল (সা.) জুমার নামাজের খুতবা দিচ্ছিলেন। সে সময় একদল বণিক খাদ্যশস্য নিয়ে মদিনায় আসেন। এ সংবাদ জানতে পেরে বহু মুসল্লি খুতবা শোনা ছেড়ে শস্য কিনতে চলে যান। মাত্র ১০ জন মুসল্লি আল্লাহর রসুল (সা.)-এর খুতবা শোনার জন্য মসজিদেই ছিলেন। (মাওলানা আশরাফ আলী থানভী, অনুবাদক মাওলানা নূরুর রহমান)। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘যখন তারা কোনো ব্যবসায়ের কিংবা কোনো ক্রীড়া কৌতুকের বস্তু দেখে আপনাকে খুতবারত রেখে সেদিকে ছুটে যায়। আপনি বলে দিন আল্লাহ্র কাছে যা আছে, তা ক্রীড়া-কৌতুক ও ব্যবসায়ের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর।’ (সুরা জুমা ৬২ : আয়াত ১১)। হজরত রসুল (সা.) আরব দেশে জন্মগ্রহণ করেছেন বলে তিনি আরবি ভাষায় খুতবা প্রদান করতেন। ফলে আল্লাহর রসুল (সা.)-এর খুতবা সাহাবায়ে কেরামদের বুঝতে কোনো অসুবিধা হতো না। কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুসলমানরা মহান আল্লাহ এবং তাঁর প্রিয় হাবিব হজরত রসুল (সা.)-এর আদেশ, নিষেধ, উপদেশ নিজ ভাষায় জানতে পারলে, সেগুলো আমল করা তাদের জন্য সহজ হবে। আরবি ভাষার পাশাপাশি যে দেশে যে ভাষা, সেই ভাষায় খুতবা দেওয়া নিঃসন্দেহে উত্তম। আরবি যেহেতু আমাদের মাতৃভাষা নয়, তাই ইসলামি শরিয়তের বিধিবিধানগুলো বাংলা ভাষায় সঠিকভাবে অনূদিত হলে সর্বস্তরের মানুষের জন্য সহজে বোধগম্য হবে এবং বাস্তবভিত্তিক অনুশীলন ও চর্চায় মনোযোগ বৃদ্ধি পাবে। বর্তমানে বাংলাদেশে জুমার খুতবা আরবির পাশাপাশি বাংলা ভাষায় প্রদান করা হয়। এতে মুসল্লিদের খুতবা শোনার প্রতি মনোযোগ বহু গুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। মাতৃভাষা বাংলায় খুতবা প্রদানের রীতি প্রচলিত হওয়ায় মুসল্লিরা খুতবার মর্মার্থ সহজেই বুঝতে পারছেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত ‘সংক্ষিপ্ত ইসলামি বিশ্বকোষ’-এ ‘খুতবার’ বর্ণনায় বলা হয়েছে, ‘ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের কোনো কোনো মসজিদে খুতবায় স্থানীয় ভাষা ব্যবহৃত হয়।’
লেখক : গবেষক, কদর রিসার্চ অ্যান্ড পাবলিকেশন্স