বিশুদ্ধ মতে নবীজি (সা.) ৫৭১ খ্রিস্টাব্দের রবিউল আউয়াল মাসের সোমবার মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের কয়েক মাস আগেই তিনি পিতাকে হারান। দাদা আবদুল মুত্তালিব তাঁর নাম রাখেন মুহাম্মদ। শুরুতে মা আমেনা এবং আবু লাহাবের আজাদকৃত দাসী সোয়াইবার দুধ পান করেন তিনি। এরপর তৎকালীন আরবের রীতি অনুযায়ী তিনি তায়েফে দুধমাতা হালিমা সাদিয়া (রা.)-এর বাড়িতে প্রেরিত হন। সেখানেই তাঁর শৈশব কাটে। হালিমার বাড়িতে থাকা অবস্থায় প্রথমবার বক্ষ বিদারণের ঘটনা ঘটে। প্রসিদ্ধ মত অনুযায়ী বক্ষ বিদারণের ঘটনা তাঁর জীবনে মোট চারবার ঘটেছে। ছয় বছর বয়সে নানাবাড়ি মদিনা থেকে ফেরার পথে আবওয়া নামক স্থানে তাঁর মা ইন্তেকাল করেন। এরপর তাঁর লালনপালনের ভার অর্পিত হয় দাদা আবদুল মুত্তালিবের কাঁধে। যখন তাঁর বয়স আট, তখন দাদাও ইন্তেকাল করেন। এরপর তাঁর অভিভাবক হন চাচা আবু তালিব।
১২ বছর বয়সে চাচা আবু তালিবের সঙ্গে সিরিয়া সফরকালে ধর্মযাজক বুহাইরা তাঁর ব্যাপারে নবুয়তের ভবিষ্যদ্বাণী করেন। ২০ বছর বয়সে সামাজিক সংগঠন ‘হিলফুল ফুজুল’ চুক্তিতে অংশগ্রহণ করেন। ২৫ বছর বয়সে খাদিজা (রা.)-এর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ৩৫ বছর বয়সে কাবাঘর ও হাজরে আসওয়াদকেন্দ্রিক সৃষ্ট বিবাদে অসামান্য বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে অনিবার্য যুদ্ধ থামিয়ে দেন। ৩৯ বছর বয়স পর্যন্ত সততা ও নিষ্ঠার জন্য মক্কায় ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন এবং আল-আমিন হিসেবে প্রসিদ্ধ হন। ৪০ বছর বয়সে নবুয়তের মহাসৌভাগ্য লাভ করেন এবং সুরা আলাকের মাধ্যমে কোরআন নাজিলের ধারা শুরু হয়। নবুয়তের প্রথম দুই বছর গোপনে ইসলাম প্রচার করেন। এ সময় খাদিজা, আবু বকর, আলী, যায়েদ বিন হারেসা (রা.) প্রমুখ সাহাবি ইসলাম গ্রহণ করেন। আল্লাহর নির্দেশে নবুয়তের তৃতীয় বছর থেকে শুরু হয় প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচারের কাজ। নবুয়তের পঞ্চম বছর কাফেরদের নির্যাতনের মুখে মুসলমানদের দুটি দল দুবার হাবশায় হিজরত করে। নবুয়তের ষষ্ঠ বছর হামজা ও ওমর (রা.) ইসলাম গ্রহণের মাধ্যমে ইসলাম শক্তিশালী হয় এবং মসজিদে হারামে প্রকাশ্যে নামাজ আদায় শুরু হয়।
নবুয়তের সপ্তম বছর কুরাইশদের সামাজিক বয়কটের শিকার হন রসুল (সা.) ও সাহাবিগণ। এ বছরই আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)-এর জন্ম হয়। নবুয়তের দশম বছর অবসান হয় সামাজিক বয়কটের। এ বছর চাচা আবু তালিব ও স্ত্রী খাদিজা (রা.) ইন্তেকাল করলে রসুল (সা.) অত্যন্ত ব্যথিত হন। এ কারণে এ বছরকে দুশ্চিন্তার বছর বলা হয়। এ বছরই আয়েশা ও সাওদা (রা.)-এর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন নবীজি (সা.)। তায়েফের ময়দানে পাথরের আঘাতে রক্তাক্তের হৃদয়বিদারক ঘটনাও এ বছরই সংঘটিত হয়। নবুয়তের বারোতম বছরে ইসরা-মিরাজ এবং পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ হয়। মিনার আকাবার গিরিখাদের প্রথম শপথও এ বছরই অনুষ্ঠিত হয়। যে শপথ মদিনা হিজরতের প্রেক্ষাপট উন্মুক্ত করে। পরের বছর গিরিখাদের দ্বিতীয় শপথ, সম্মিলিত কাফের শক্তির নবীজি (সা.)কে হত্যার ষড়যন্ত্র এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে আবু বকর (রা.)কে সঙ্গে নিয়ে মদিনায় হিজরত করেন নবীজি (সা.)। এরপর শুরু হয় নবীজি (সা.)-এর মাদানি জীবন। হিজরি প্রথম বর্ষে মদিনায় গমন, মদিনার ইহুদি ও প্রতিবেশী গোত্রগুলোর সঙ্গে নিরাপত্তা-চুক্তি, মসজিদে নববী নির্মাণ, আনসার-মুহাজিরদের মাঝে অসামান্য ভ্রাতৃত্বের বন্ধন তৈরি হয়। দ্বিতীয় হিজরিতে কেবলা পরিবর্তন, ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ, রমজানের রোজা, জাকাত, ফিতরা, ঈদ, কোরবানির মতো বড় বড় বিধান নাজিল হয়। তৃতীয় হিজরিতে ওহুদ যুদ্ধ, সুদ ও মদ হারাম এবং পর্দার বিধান নাজিল হয়। চতুর্থ হিজরিতে বনু নাজিরকে মদিনা থেকে বহিষ্কার এবং যাতুর রিকার অভিযান পরিচালিত হয়। পঞ্চম হিজরিতে আহজাবের যুদ্ধ, বনু কোরাইজার বিচার, তায়াম্মুমের বিধান এবং আয়েশা (রা.)-এর সঙ্গে ইফকের ঘটনা সংঘটিত হয়। পরের বছর হুদাইবিয়ার সন্ধি এবং রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে ইসলামের বার্তা দিয়ে চিঠি প্রেরণ করেন রসুল (সা.)।
সপ্তম হিজরিতে খায়বার বিজয়, উমরাতুল কাজা আদায়, সাফিয়া ও মাইমুনা (রা.)-এর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। অষ্টম হিজরিতে মক্কা বিজয়, হুনাইনের যুদ্ধ এবং তায়েফ অবরোধ করা হয়। নবম হিজরিতে তাবুক অভিযান এবং বিদায় হজের প্রস্তুতি শুরু হয়। দশম হিজরিতে ঐতিহাসিক বিদায় হজ, বিদায় হজের ভাষণ এবং দীন পূর্ণাঙ্গ করার ঘোষণা-সংবলিত সুরা মায়েদার আয়াত নাজিল হয়। একাদশ হিজরির রবিউল আউয়াল মাসের সোমবারে রসুল (সা.)-এর অবিস্মরণীয় পার্থিব সফর শেষ হয়।
রসুল (সা.) যে বর্ণাঢ্য ও শানদার জীবন কাটিয়ে গেছেন, তার অনুপুঙ্খ বিবরণ ছোট্ট পরিসরে কখনোই ধারণ করা সম্ভব নয়। এখানে কেবল তাঁর জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রত্যেক বছরের স্মরণীয় ও বড় ঘটনার দিকে ইশারা করা হয়েছে। নবীজি (সা.)-এর বর্ণাঢ্য জীবন পুরোপুরি জানতে হলে বৃহৎ কলেবরের নির্ভরযোগ্য সিরাত গ্রন্থ পাঠ করতে হবে।
জুমার মিম্বর থেকে
গ্রন্থনা : সাব্বির জাদিদ