গত বুধবার গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সমাবেশকে কেন্দ্র করে ঘটে গেছে তুলকালাম। জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে সমাবেশের মঞ্চ লন্ডভন্ড করা হয়েছে। ঘটনায় কমপক্ষে চার ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করলে এনসিপি নেতারা পুলিশের আশ্রয় গ্রহণ করেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে গোপালগঞ্জে কারফিউ জারি করা হয়। সেই সঙ্গে চলে গ্রেপ্তার অভিযান। যখন লিখছি, তখনকার খবর; সেখানে বিরাজ করছে সুনসান নীরবতা।
গোপালগঞ্জে কেন, কোন প্রেক্ষাপটে এমন ঘটল-তা নিশ্চিত করে এখনই বলা মুশকিল। তবে একটি অনলাইন পোর্টালে রিপোর্ট দেখলাম, বলা হয়েছে, কয়েক দিন আগে থেকেই এই প্রচারণা চালানো হয়েছিল যে এনসিপির মার্চ টু গোপালগঞ্জের উদ্দেশ্য শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিস্থল নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। বিষয়টি গোপালগঞ্জের মানুষ সহজভাবে নেয়নি। আঞ্চলিক সেন্টিমেন্ট বাংলাদেশে নতুন নয়। ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনে জেলে থেকে এইচ এম এরশাদ রংপুরের পাঁচটি আসনে জয়লাভ করেছিলেন। রংপুরের সব কটি আসনে এরশাদের জাতীয় পার্টি জয় পেয়েছিল। কারণ এরশাদ রংপুরের সন্তান। সারা দেশ স্বৈরাচার বলে এরশাদের নিন্দা করলেও রংপুরের মানুষের কাছে তিনি ছিলেন গৌরবের ধন। মনে পড়ে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ময়মনসিংহের নান্দাইল আসনে পিডিপিপ্রধান নূরুল আমিন ভূমিধস বিজয় পেয়েছিলেন। প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের তুখোড় নেতা রফিক ভূইয়ার জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের ওপর গুলির নির্দেশ নূরুল আমিনই দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী। বাংলাদেশের রাজনীতিতে নূরুল আমিন ছিলেন একটি নিন্দিত নাম। কিন্তু নান্দাইলে তিনি ছিলেন নন্দিত। কারণ তিনি নান্দাইলের সন্তান। এ ধরনের আঞ্চলিকতাবোধের চটজলদি ব্যাখ্যা দেওয়া কঠিন। সেজন্য গভীর সমাজ গবেষণা প্রয়োজন। শেখ মুজিবুর রহমানের যত সমালোচনাই আমরা করি না কেন, গোপালগঞ্জের মানুষের তিনি পরম আত্মীয়। এটা নেহাতই আঞ্চলিকতা। মুজিবের সমাধি ভাঙা হবে-সত্যিই যদি এমন প্রচারণা কোনো মহল থেকে চালানো হয়ে থাকে, তাহলে সেটা একটা গুরুতর জটিল পরিস্থিতি তৈরির অসৎ উদ্দেশ্যেই হয়তো করা হয়েছিল। এখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে জাতীয় ঐক্য এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচন ইস্যু। নির্বাচন ইস্যুটিকে পেছনে ঠেলে দেওয়ার জন্য সুপরিকল্পিতভাবেও এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়ে থাকতে পারে। বিষয়টি নিয়ে বিস্তর ভাবনা এবং আলোচনার অপেক্ষা রাখে।
দেশে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে। সুন্দর ও নিরাপদ দেশ বিনির্মাণের জন্য সুদৃঢ় জাতীয় ঐক্য জরুরি। বিভেদ অগ্রসরতার পথে বড় বাধা। রাজনীতিতে মতের ভিন্নতা থাকবে। বহুমত ও বহুপথের অর্থ কখনই বিভেদ নয়। তবে জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে বিভেদ থাকতে পারে না। এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। সব মতের সহাবস্থান। এভাবেই সংহত হয় গণতান্ত্রিক সমাজের ভিত। এভাবেই বিকশিত হয় রেইন বো সোসাইটি-রংধনু সমাজ। জাতীয় ঐক্যের পথে যারা ইচ্ছাকৃত বিঘ্ন সৃষ্টি করছে, তারা দেশের শত্রু। তাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো গোপন কোনো প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে চাইছে।
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ সময়ের প্রয়োজনে বারবার ঐক্যের ঝান্ডা ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছে এবং বারবারই সেই পতাকা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে কোটারি স্বার্থের পদতলে। পরিতাপের বিষয়, বাংলাদেশের ইতিহাসে যারা ঐক্যের মশাল উঁচিয়েছিল, তারাই নিজেদের স্বার্থে ঐক্য নষ্ট করেছে। উনসত্তর, সত্তর ও একাত্তরে বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) গড়ে উঠেছিল এক ইস্পাতদৃঢ় জাতীয় ঐক্য। সেই ঐক্যের মধ্যমণি হয়ে উঠেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর সেই জাতীয় ঐক্য বিঘ্নিতও করলেন তিনি নিজেই, একদলীয় শাসনের জাঁতাকলে। ১৯৭৫ সালে আওয়ামী লীগ নামের আগে কৃষক শ্রমিক-এই দুটি শব্দ বসিয়ে বানালেন বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ তথা বাকশাল। বাকশালের মটো হলো-এক দেশ এক দল এবং এক নেতা। অর্থাৎ শেখ মুজিবুর রহমান আর আওয়ামী লীগই বাংলাদেশ। এই আদর্শটি ধার করা হয়েছিল হিটলারের নাৎসি দলের কাছ থেকে। নাৎসি দলের সেøাগান ছিল, ওয়ান স্টেট, ওয়ান পিপল, ওয়ান লিডার। এর ফলে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেল জাতীয় ঐক্যের ধারণা। গণবাহিনী সৃষ্টি হলো। পাহাড়ে শুরু হলো বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সংগ্রাম।
নব্বইয়ে এরশাদবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠলেও সেটা স্থায়ী হয়নি। ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠল জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত ঐক্য। সত্য বটে হুইস্ল বাজিয়ে ’২৪ সালের আন্দোলনকে ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। এই আন্দোলন ছিল নেহাতই কোটা সংস্কার আন্দোলন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ ও মুগ্ধ পুলিশের গুলিতে শাহাদাতবরণের পর সরকারি ও প্রাইভেট ভার্সিটির পাশাপাশি রাজপথে নামলেন স্কুল, কলেজ ও মাদরাসার শিক্ষার্থীরাও। পথে নেমে এলেন অভিভাবকরাও। শেখ হাসিনার সাড়ে ১৬ বছরের অগণতান্ত্রিক ও একনায়কতান্ত্রিক শাসনে দেশের মানুষের দম বন্ধ হয়ে আসছিল। জ্বলে ওঠার জন্য তারা মুখিয়ে ছিলেন। তাদের জ্বলে ওঠার জন্য একটা অবলম্বনের প্রয়োজন ছিল। শিক্ষার্থীদের রক্তঝরা আন্দোলনই হয়ে উঠল জনগণের জ্বলে ওঠার দীপাধার। এই আন্দোলনে সর্বসাধারণের ঝাঁপিয়ে পড়ার অন্তর্গত প্রেরণা ছিল গণতন্ত্রের আকাক্সক্ষা, ভোটের অধিকার ফিরে পাওয়ার প্রত্যাশা। কোনোভাবেই এই আন্দোলন একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয়ের গৌরব ম্লান করে দেওয়ার আন্দোলন ছিল না।
সব মত, পথ ও শ্রেণির মানুষের, নারী-পুরুষ এমনকি কোমলমতি কিশোরের আত্মত্যাগ ও অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট যে বিজয় অর্জিত হয়েছে, তা জনগণের বিজয়। বিশেষ কোনো দল বা মতাদর্শের বিজয় নয়।
দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে গণতন্ত্রহীনতায় পিষ্ট মানুষ পিঞ্জিরা ভেঙে বেরিয়ে আসতে চাইল। বুকভরে নিঃশ্বাস নিতে চাইল। কিন্তু পাড়ে উঠতে না উঠতেই বাংলাদেশের বাতাসে ছেড়ে দেওয়া হলো নৈরাজ্যের কার্বন ডাই-অক্সাইড। ডেমোক্র্যাসির বদলে জাতি পেল মবোক্র্যাসি। সামনে নিয়ে আসা হলো জুতোমারা কালচার। মানুষ ভীতসন্ত্রস্ত; কখন কার ওপর মব জারি হয়ে যায়! অসহায়-নীরব দর্শকের মতো জাতি দেখল স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়-পথেঘাটে, পাড়া-মহল্লায় সবখানে মব সন্ত্রাস। কোনো বিচার নেই, প্রতিকার নেই। শিক্ষকের গলায় জুতার মালা। মুক্তিযোদ্ধার গলায় জুতা। দেশের প্রবীণ নাগরিক এমনকি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের সাবেক প্রধানের গলায়ও জুতার মালা।
গালে জুতা মারা হচ্ছে। ক্যাম্পাসে নির্দয়ভাবে মানসিক প্রতিবন্ধী তফাজ্জলকে মব করে হত্যা করা হলো। সিটি করপোরেশনের বুলডোজার নিয়ে মিছিল করে ধানমন্ডির ঐতিহাসিক বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আর এই সেদিন পৈশাচিক কায়দায় বিশ-বাইশ কেজি ওজনের পাথর মেরে হত্যা করা হয়েছে সোহাগকে। চাঁদাবাজি, দখলদারি আর টেন্ডারবাজি চলছে সমানে। এসব অপরাধের সঙ্গে যুক্ত নেতা-কর্মীদের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিএনপি ও তার বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে এবং এখনো এ প্রক্রিয়া চলমান।
এসব অপকর্মের সঙ্গে সমন্বয়ক নামধারী একশ্রেণির তরুণ এবং কিছু ধর্মভিত্তিক সংগঠনের নেতা-কর্মীর অনেকে জড়িত। লালন উৎসবে বাধা দেওয়া, মাজার ভাঙা, পাবলিক লাইব্রেরিতে হামলা, ভাস্কর্য ভাঙা-এগুলোর সঙ্গে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির আড়ালে রয়েছে বিশেষ মহলের দুরভিসন্ধি।
বিএনপির হাইকমান্ড সন্ত্রাস চাঁদাবাজিসহ অপরাধের সঙ্গে যুক্ত নেতা-কর্মীদের ছাড় দিচ্ছেন না। এ পর্যন্ত বহু সহস্র নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক চরম ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু পুলিশ প্রশাসন এই বহিষ্কৃতদের অনেকের বিরুদ্ধেই কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিজেও অনুরূপ অভিযোগ করেছেন। তাহলে কি প্রশাসন দুষ্কৃতকারীদের প্রশ্রয় দিচ্ছে? কঠিন প্রশ্ন। বিএনপি নিজেদের উচ্ছৃঙ্খল নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেও অন্য কোনো দল তাদের উচ্ছৃঙ্খল কর্মীদের বিরুদ্ধে তেমন ব্যবস্থা নেয়নি। তা সত্ত্বেও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে দোষারোপ করা হচ্ছে। অশ্লীল ভাষায় আক্রমণ করা হচ্ছে। এটা কোন ধরনের রাজনীতি? এই রাজনীতির নিট ফল বিভেদ ছাড়া আর কী হতে পারে?
অন্যদিকে এনসিপি, জামায়াতে ইসলামী ও অন্যান্য দল এমন সব দাবি সামনে নিয়ে আসছে, যেগুলো জাতীয় ঐক্যের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে এমনকি নারী আসনেও পিআর চাইছে। বোধগম্য কারণেই বিএনপি পিআরের পক্ষে নয়। এনসিপি ও তার মিত্ররা সংস্কার ও গণহত্যার বিচার শেষ করে ইলেকশন করতে চায়। তারা মুক্তিযুদ্ধের সমান্তরাল জায়গায় নিয়ে আসতে চায় জুলাই আন্দোলনকে। তাদের কথা ও কাজে মনে হয় ২০২৪-এর এক মাসের আন্দোলনকে তারা বাঙালির ২৩ বছরের স্বাধিকার ও স্বাধীনতার সংগ্রাম, সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধে শত-সহস্র মানুষের সর্বোচ্চ ত্যাগেরও ঊর্ধ্বে স্থান দিতে চায়। একাত্তরকে তারা যেন নিক্ষেপ করতে চায় বিস্মৃতির অতল গহ্বরে।
দেশের নাম পরিবর্তন, মূলনীতির আমূল পরিবর্তনের সুপারিশও এসেছিল হয়তো এই দৃষ্টিকোণ থেকেই। এই দৃষ্টিভঙ্গি যত বৈপ্লবিকই হয়ে থাকুক না কেন, তা স্পষ্টত জাতিকে বিভক্ত করার মন্ত্রসিদ্ধ। একপক্ষ; যারা মনেপ্রাণে মুক্তিযুদ্ধের গৌরব ধারণ করে এবং অন্য পক্ষ; যারা মুক্তিযুদ্ধকে বিস্মৃত অতীত মনে করে অবজ্ঞা করে। দ্বিতীয় ভাগে এমন অনেকে হয়তো আছে যারা একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণ করতে চায়। এ ধরনের বিভক্তিকে যারা উসকে দেয়, যারা এ বিষবৃক্ষের গোড়ায় পানি ঢালে, নিঃসন্দেহে তারা জাতীয় ঐক্যের প্রতিপক্ষ।
এই বাস্তবতায় জুলাই সনদ স্বাক্ষরিত হোক বা না হোক, দ্রুত জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে একটি শক্তিশালী সরকারের হাতে দায়িত্ব হস্তান্তর করা উচিত। কেবল অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র ও জাতীয় ঐক্যের পথ সুগম হতে পারে। এর কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক