গোলাম দস্তগীর গাজীর অপরাধ কাহিনি সবার মুখে মুখে ছিল। সবাই জানতেন গোলাম দস্তগীর গাজী একজন ভয়ংকর অপরাধী। দুর্নীতিবাজ, ভূমিদস্যু, লুণ্ঠনকারী এবং মাদক কারবারি। কিন্তু তারপরও তিনি ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। তার এসব অপকর্ম যেমন ছিল ওপেন সিক্রেট, তেমনি তার পরকীয়া প্রেম কাহিনি ছিল প্রকাশ্য। রূপগঞ্জের আওয়ামী লীগের নেত্রী ফেরদৌসী আলম নীলার সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক ছিল দীর্ঘদিনের। এ নিয়ে কোনো রাখঢাক ছিল না। এমনকি গাজীর স্ত্রী সাবেক মেয়র হাসিনা
গাজী, তার পুত্র পাপ্পা গাজী এসব বিষয় জানতেন। জানাজানি হওয়ার পর স্ত্রী হাসিনা গাজী এ নিয়ে স্বামীকে রীতিমতো ব্ল্যাকমেল করতেন। নীলাকে যেন গাজীর স্ত্রী মেনে নেয়, এ জন্য তাকে রাজনীতিতে আনেন। একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, স্বামীর এসব অপকর্মের জন্য ব্ল্যাকমেল করে স্ত্রী রূপগঞ্জের তারাব পৌরসভার মেয়র পদ বাগিয়ে নেন এবং বিনা ভোটে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। স্বামীকে ব্ল্যাকমেল করে হাসিনা গাজী সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। এভাবেই গোলাম দস্তগীর গাজী তার প্রেমিকা নীলার জন্য সবকিছু করেছেন। একাধিক সূত্র জানাচ্ছে যে, শেষদিকে নীলার মেয়ের সঙ্গেও গাজী গোলাম দস্তগীরের একটি অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তবে নীলার এই প্রেম নিঃস্বার্থ প্রেম ছিল না। এর বিনিময়ে তিনি রূপগঞ্জের অঘোষিত ‘ছায়ামন্ত্রী’ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। বিত্ত আর সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। তার বিপুল পরিমাণ সম্পদের কাহিনি নিয়ে শুধু রূপগঞ্জ নয়, সারা দেশেই আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়।
নীলা। নামের সঙ্গে জীবনের গল্প অনেকটাই পরিপূরক। নীলা নামের বিশেষায়িত অর্থ সফল। আবার ভাগ্য রাশি বদলাতে নীলা পাথরের জুড়ি মেলা ভার। তবে নামের অর্থের নীলা আর ব্যক্তি নীলার সফলের গল্পটা কিন্তু ভিন্ন। ব্যক্তি নীলা অবৈধ উপায়ে রাতারাতি ধনকুবের বনে গেছেন। নীলার ডানে-বাঁয়ে থাকত সুঠাম নারী দেহরক্ষী। আর পেছনে বিশাল নারীর বহর। নীলার প্রভাবে গোটা রূপগঞ্জ জিম্মি ছিল। চাউর আছে-নীলার নীল দংশনে অতীতে অনেক তরুণ-যুবকও ধ্বংস হয়েছেন। নানা কেলেঙ্কারি আর অঘটনের পর ফটিক নামের একজনকে বিয়ে করেন নীলা।
বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের একসময়ের মাঠকর্মী নানা অনিয়ম-দুর্নীতি, সরকারি টাকা তছরুপ, ভুয়া প্রকল্প, সরকারি টাকা লোপাট আর ক্ষমতার বদৌলতে কয়েক শ কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। তার রয়েছে পূর্বাচল উপশহরে এক ডজন প্লট, বিঘায় বিঘায় জমি, ঢাকায় আলিশান পাঁচ তলা বাড়ি, ঢাকার অভিজাত শপিং মলে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের শোরুম এবং চীন ও সিঙ্গাপুরেও রয়েছে ব্যবসা। গাজীর সাহচর্যে ফুলে-ফেঁপে উঠেছিলেন ফেরদৌসী আলম নীলা। তার থাবা থেকে বাদ যায়নি ক্রিকেট স্টেডিয়ামের জমিও। এ জমিতে গড়ে তুলেছিলেন ‘নীলা মার্কেট’। নীলা মার্কেটের আড়ালেই চলে নানা অপরাধ কর্মকাণ্ড। মার্কেটের আশপাশ এলাকাগুলো এখন অপরাধীদের নিরাপদ আস্তানা। মন্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক থাকার পাশাপাশি উপজেলা নারী ভাইস চেয়ারম্যান হওয়ায় প্রশাসন তার বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। একবার নীলাকে আওয়ামী লীগের কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হলে গাজী গোলাম দস্তগীর ছুটে গিয়েছিলেন শেখ হাসিনার কাছে। শেষ পর্যন্ত বিপুল টাকার বিনিময়ে প্রেমিকার পদ পুনরুদ্ধার করেন গাজী। এভাবেই নীলা হয়ে উঠেছিলেন অপ্রতিরোধ্য।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্লট দখল করে নীলা অবৈধভাবে করেছিলেন ‘নীলা মার্কেট’। এর পাশেই প্লট দখল করে বানিয়েছেন ‘আওয়ামী লীগ ক্লাব’। নীলার স্বামী শাহ আলম ফটিক আর দেবর আনোয়ার হোসেন ক্লাবটির দেখভাল করতেন। পূর্বাচলে প্রতিবন্ধীদের খেলার জায়গা দখল করে বানিয়েছেন লেডিস ক্লাব, পূর্বাচল কনভেনশনের ৭৬ কাঠার প্লট দখল করে বানান পূর্বাচল ক্লাব। শীতলক্ষ্যার তীরে প্লট দখল করে চলছে কয়লা-পাথর-বালুর কারবার, মন্দির-শ্মশানের প্লটে উঠিয়েছিলেন দোকান আর ইউসুফগঞ্জ খালের ওপর ওঠে নীলার বাড়ি।
প্রতিবন্ধীদের খেলার জায়গায় লেডিস ক্লাব, পূর্বাচল ১৩ নম্বর সেক্টরের ৩০৫ নম্বর রোডে প্রায় তিন বিঘা জমি প্রতিবন্ধীদের খেলার মাঠ হিসেবে সংরক্ষণ করেছিল রাজউক। ওই প্লটের দুই বিঘা জমি নীলা দখল করে তৈরি করেছেন পূর্বাচল লেডিস ক্লাব। চার পাশে সীমানা দিয়ে ভিতরে বানানো হয়েছে সুইমিং পুল, অফিস কক্ষ, ব্যায়ামাগারসহ কয়েকটি অবকাঠামো। নীলা নিজেই ক্লাবের সভাপতি। অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৭ সালের ২১ নভেম্বর রাজউকের পূর্বাচল প্রকল্পে একটি কনভেনশন সেন্টারের জন্য জমি বরাদ্দের আবেদন করেন কফিল উদ্দিন ভূঁইয়া, মোজাহারুল হক ও হুমায়ুন কবির। ওই বছরের ২৩ নভেম্বর প্লটের জামানতের ১৫ লাখ টাকাও জমা দেন তারা। বোর্ড সভায় অনুমোদনের পর ২০১৮ সালের ৩ অক্টোবর ১ নম্বর সেক্টরের ২০৪ নম্বর রোডের ৩ নম্বর প্লটটি কনভেনশন সেন্টারের জন্য বরাদ্দ দেয় রাজউক। প্লটের আয়তন ৭৬ দশমিক ৮৩ কাঠা। প্লটটির বর্তমান বাজারদর প্রায় ১০০ কোটি টাকা। বরাদ্দ পেয়ে প্রথম ও দ্বিতীয় কিস্তির ১০ কোটি টাকা জমা দেন সংশ্লিষ্টরা। বরাদ্দ পাওয়া ব্যক্তিরা হঠাৎ জানতে পারেন, ফেরদৌসী আলম নীলা ‘পূর্বাচল নীলা কনভেনশন লিমিটেড’ নাম দিয়ে ওই প্লটটি দখল করে নিয়েছেন। আর রাজউকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হাত করে নতুন নামে সেটা রেজিস্ট্রির অনুমতিপত্রও রাজউক থেকে বের করেছেন। পুরো প্লটে দেয়াল দিয়ে নিজের নিয়ন্ত্রণে নেন নীলা।
১৯৬৭ সালে স্থাপিত ইউসুফগঞ্জ স্কুল অ্যান্ড কলেজটি পূর্বাচল প্রকল্পের ১ নম্বর সেক্টরে। পূর্বাচল প্রকল্প বাস্তবায়নের পর সেখানে ১৪৭ কাঠা জায়গা বরাদ্দ দেয় রাজউক। পাশাপাশি একটি তিন তলা ভবনও তৈরি করে দেয়। বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা অন্তত ১ হাজার ২০০। ২০১০ সাল থেকে ফেরদৌসী আলম নীলা ওই ইউসুফগঞ্জ স্কুল অ্যান্ড কলেজের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতির পদ দখল করে ছিলেন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন পর্যন্ত। প্রতি বছর স্কুলের নামে আশপাশে থাকা খালি প্লটগুলোতে কোরবানির বিশাল পশুর হাট বসান নীলা। এ থেকে কয়েক কোটি টাকা আয় করেন তিনি। স্কুলের নামে হাটটি বসালেও কানাকড়িও স্কুলের তহবিলে দেন না। ৪ নম্বর সেক্টরে গোটা পঞ্চাশেক প্লট দখল করে নীলা বছরের পর বছর কয়লার ব্যবসা করে আসছিলেন। কয়লার কারণে আশপাশে মানুষের বাস করা কষ্টকর হয়ে উঠেছিল। তীব্র জনরোষের মুখে ২০২৪-এর জানুয়ারিতে রাজউক এখানে উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে কিছুদিন কয়লার ব্যবসা বন্ধ থাকে। পরে ওই জায়গায় এখন চলছে ইট-বালু-পাথরের ব্যবসা। বড় বড় ব্যবসায়ীকে এসব ব্যবসার সুযোগ করে দিয়েছেন নীলা। বিনিময়ে ওই সব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পাচ্ছেন মোটা অঙ্কের টাকা। আওয়ামী লীগের পতনের পর নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের পূর্বাচলের আলোচিত-সমালোচিত আওয়ামী লীগ নেত্রী ও সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ফেরদৌসী আলম নীলার সাম্রাজ্যে হানা দেয় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। রূপগঞ্জের পূর্বাচলে নির্মিত ‘পূর্বাচল লেডিস ক্লাব’ গুঁড়িয়ে দিয়েছে রাজউক। পূর্বাচলের ১৩ নম্বর সেক্টরে খেলার মাঠ দখল করে এবং আবাসিক প্লটে গড়ে তোলা এই ক্লাবকে অবৈধ ঘোষণা করে।
রাজউক জানায়, দীর্ঘদিন ধরে রূপগঞ্জ উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ফেরদৌসী আলম নীলাসহ স্থানীয় কিছু ব্যক্তি রাজউকের জমিতে অবৈধভাবে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করে দখল করে রেখেছেন। বিষয়গুলো রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নজরে এলে গত বছরের আগস্ট মাসে পূর্বাচলের ১৩ নম্বর সেক্টরে অভিযান চালিয়ে নীলার লেডিস ক্লাব এবং ২৪ নম্বর সেক্টরে লাভ ফরেস্ট রেস্টুরেন্টের সব স্থাপনা উচ্ছেদ করেন তারা। আওয়ামী লীগের পতনের পর বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগে নীলার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। গত বছরের ৩০ আগস্ট তাকে দুর্নীতি দমন কমিশনে তলব করা হয়েছিল। দুদকের সহকারী পরিচালক মো. সাহিদুর রহমান স্বাক্ষরিত এক নোটিসে তাকে দুদকে তলব করা হয়। কিন্তু নীলা দুদকে যাননি। ৫ আগস্টের পর এলাকায় যাচ্ছেন না নীলা ও তার পরিবারের সদস্যরা। একাধিক সূত্র দাবি করছে, নীলা বর্তমানে দুবাইয়ে অবস্থান করছেন।