জ্ঞান আর প্রজ্ঞা দুটি সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। জ্ঞানের অনেক ওপরের স্তরে থাকে প্রজ্ঞা। জ্ঞান হলো আগুনের মতো। প্রজ্ঞা ওই আগুন ব্যবহারপ্রণালি বোঝা। জ্ঞানী জানে, আগুন সবকিছু জ্বালিয়েপুড়িয়ে ছাই করে দেয়। আর প্রজ্ঞাবান জানে, কীভাবে আগুন ব্যবহার করে সুস্বাদু রান্না করা যায়। আবার ওই আগুন দিয়েই প্রজ্ঞাবান শীতের রাতে উত্তাপ নিয়ে শান্তিতে ঘুমান। জ্ঞান অর্জন হয় বিদ্যালয়ে। চক-শ্লেট আর কলম-কাগজ। প্রজ্ঞা আসে সিনা থেকে সিনায়। এ জন্য সোহবত শর্ত। পীর বা শায়েখের নিবিড় সান্নিধ্যে থাকার পরই জ্ঞানী হয়ে ওঠেন প্রজ্ঞাবান। নিকট অতীতেও মাদরাসা থেকে পাস করার পর একজন মাওলানাকে পীরের সান্নিধ্যে থাকতে হতো বছরের পর বছর। কখনো যুগের পর যুগও থাকতে হতো শায়েখের খেদমতে। শায়েখ যা বলতেন তার বাইরে এক চুলও চলার সুযোগ ছিল না ছাত্রের। তাসাউফের পরিভাষায় এ ধরনের ছাত্রকে বলা হয় মুরিদ। ফারসিতে বলে মুর্দা। মানে মৃত। মৃতের যেমন নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি নেই, পছন্দ-অপছন্দ নেই; তেমনি তরিকতের সালেকেরও কোনো নিজস্ব চাহিদা নেই। পীর যেভাবে বলবেন সেভাবেই করতে হবে। অনেক সময় পীরমুরিদের অবস্থা বুঝে এমন মামুলি সবক দিয়ে থাকেন, যা বাহ্যিক দৃষ্টিতে মনে হয় অনর্থক। কিন্তু গভীরভাবে ভেবে দেখলে বোঝা যাবে ওই মুরিদের জন্য এটাই সবচেয়ে জরুরি সবক।
বলছিলাম প্রজ্ঞার কথা। জ্ঞানের কথা। প্রজ্ঞাবান পীরের কথা। পীর যদি প্রজ্ঞাবান না হন তাহলে মুরিদের দুনিয়াও শেষ, আখেরাতও শেষ। দুঃখজনক হলেও সত্য, সবকিছুর মতো ভেজাল ঢুকেছে পীরালিতেও। ভেজালের ভিড়ে খাঁটি পীর চিনে নেওয়া মুরিদের দায়িত্ব। দায়িত্ব প্রজ্ঞাবান খাঁটি আলেম খুঁজে নেওয়া। প্রজ্ঞাবান আলেমের পরিচয় কী? অনেক বড় ডিগ্রি, মুফতি, মুফাসসির, মুহাদ্দিস, শায়খুল মাশায়েখ হলেই কেউ প্রজ্ঞাবান হয়ে যায় না। মাদরাসায় মাওলানা বা মুফতি কোর্স শেষ হলে কেবল আলেম হওয়া যায়। হাদিসের উচ্চতর ডিগ্রি নিলে বড় শায়খুল হাদিস হওয়া যায়। এসব বড় বড় আলেমের কেউ কেউ প্রজ্ঞাবান আলেমের স্তরে পৌঁছতে পারেন। তাঁরাই বিশ্বকে পথ দেখান নতুন ভোরের। যে ভোরে থাকে আশার আলো। মনে থাকে নতুন স্বপ্ন।
প্রজ্ঞাবান আলেমের পরিচয় দিতে গিয়ে একজন গবেষক লিখেছেন, দুটো বৈশিষ্ট্য থাকলে কোনো আলেমকে প্রজ্ঞাবান বলা যায়। এক. সব সময় যিনি সহজ নীতি গ্রহণ করেন এবং আমলে ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন। দুই. ধর্মীয় ব্যাপারে গোঁড়ামি ও কঠোরতা যার মাঝে পাওয়া যায় না এবং যিনি ছোটখাটো মাসআলা নিয়ে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন না। এ দুই বৈশিষ্ট্য যার মধ্যে পাওয়া যাবে তিনিই প্রজ্ঞাবান আলেম। বিষয়টি আরও ব্যাখ্যা করে ওই গবেষক লেখেন, প্রজ্ঞাবান আলেম কখনো সাধারণ মানুষের মধ্যে এমন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন না, যার ফলে পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে পড়ে। এক কথায় তাঁর বক্তব্যে বা লেখনীতে উসকানি ও বিশৃঙ্খলা তৈরি হয় না। সাধারণ মানুষ কিংবা অন্য কোনো আলেমের থেকেও যদি কোনো ভুল আচরণ বা কথা প্রকাশ পায়, তাহলে সেটাকে যতদূর সম্ভব ইতিবাচক দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা করেন। বলেন, তাঁর এ আচরণ বা কথা বাহ্যিক দৃষ্টিতে ভুল মনে হলেও আসলে এ দৃষ্টিকোণ থেকে এটা সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা রাখে। হয়তো তিনি এভাবে দেখেছেন। হয়তো এ কারণে তিনি এমনটা করে থাকবেন। এর ফলে সমাজে আলেমদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ অটুট থাকে। অন্যদিকে প্রজ্ঞাহীন আলেমের আচরণে সমাজে আলেমদের প্রতি বিরূপ ধারণা বাড়তে থাকে।
প্রজ্ঞাবান আলেমের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য উঠে এসেছে সমকালীন আরেকজন ইসলামি গবেষকের আলোচনায়। প্রজ্ঞাবান আলেমের পরিচয় নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, কোনো বিষয় হাালাল বা হারাম বলার বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করাই প্রজ্ঞাবান আলেমের বড় পরিচয়। সেই সাহাবিদের যুগ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত হক্কানি ওলামায়ে কেরামের এটাই ছিল নীতি। সুস্পষ্ট দলিল ছাড়া কোনো বিষয়কে তাঁরা হারাম বলতেন না। বড় জোর তাঁরা বলতেন, এটা অপছন্দনীয়। ইমাম আবু হানিফাসহ (রহ.) অন্যান্য ইমাম এ নীতির ওপরই তাঁদের উসুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। আফসোস! হালে নতুন যা দেখি সেগুলোই আমরা হারাম ফতোয়া দিয়ে বসে থাকি। প্রথম যখন মাইক আবিষ্কার হয়েছে, তখন পাকিস্তানের একজন বড় আলেম মাইক ব্যবহার হারাম এ বিষয়ের ওপর বড় একটি কিতাব লেখেন। এরও অনেক আগে যখন বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কার হয়, তখন কাবা শরিফেও হারাম ফতোয়ার কারণে বৈদ্যুতিক বাতি স্থাপন করা হয়নি। আরব আলেমদের অন্তত ১০০ বছর লেগে গেছে এ বিষয়টি বুঝতে যে বৈদ্যুতিক বাতি ব্যবহারের সঙ্গে হালাল-হারামের কোনো সম্পর্ক নেই। শুধু কি তাই? কিছুদিন আগেও কোরআন বাংলা ভাষায় অনুবাদ করা জায়েজ কি না, এ নিয়ে তর্ক হয়েছে। এরও অনেক আগে কোরআন ইংরেজি ভাষায় তর্জমা করা জায়েজ কি না, এসব নিয়ে বিতর্ক হয়েছে।
লেখক : প্রিন্সিপাল, সেইফ এডুকেশন ইনস্টিটিউট