পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে- ‘আর তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য যথাসাধ্য শক্তি সঞ্চয় করো। যাতে আল্লাহর শত্রু ও তোমাদের শত্রুদের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হতে পারো।’
এ আয়াতে বস্তুসামগ্রীর সম্ভাব্য ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তার প্রতি দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়। যতটুকু পাওয়া যায়, এর অধিক বস্তুর প্রতি নির্ভরশীল হওয়া যাবে না। বরং পবিত্র কোরআন ও হাদিসের আলোকে সফলতার মূল কারণ নির্ণয় করে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। কোরআন-সুন্নাহর আলোকে মুসলমানদের অধঃপতন ও বিপর্যয় থেকে মুক্তির প্রকৃত উপায় হচ্ছে নিজ নিজ পাপের ব্যাপারে লজ্জিত হওয়া, খাঁটিভাবে তওবা-ইস্তিগফার করা এবং ভবিষ্যৎ জীবনকে পরিপূর্ণভাবে গুনাহমুক্ত রেখে সুন্নত ও শরিয়তের অনুশীলনের মাধ্যমে যোগ্য করে তোলা। সঙ্গে সঙ্গে নেক কাজের উপদেশ দান ও পাপাচারিতার অবসানে যথাযথ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা। কেবল কথা এবং বাক্য রচনা করে নয়; বরং কথাবার্তা, আমল-আখলাক ও উত্তম আচরণের মাধ্যমে ইসলামের আদর্শগত বৈশিষ্ট্য ও সৌন্দর্য চিত্রিত করে মানুষকে ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট করে তোলা। মুসলমানরা যদি তাদের প্রতি অর্পিত খোদায়ী দায়িত্ব সঠিক সুন্দরভাবে পালন করে তাহলে ইনশাআল্লাহ অবশ্যই এ অবস্থার পরিবর্তন সাধিত হবে, গায়েবিভাবে অবস্থা মুসলমানদের অনুকূলে আসবে। আর যদি মুসলমানগণ অবস্থা সংশোধন ও পরিবর্তনে উল্লিখিত আসল কারণটিকে গুরুত্ব না দেয়, বরং এ বিষয়ে অবহেলা প্রদর্শন করে চলে তাহলে তারা কেবল বস্তুগত ব্যবস্থাপনা ও কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে কোনো দিন সমস্যার সমাধানে সফলকাম হতে পারবে না। বরং দ্রুতবেগে অবস্থার অবনতি ঘটবে।
ইসলামি যুদ্ধে মুসলমানদের জয়-পরাজয়ের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে উপরিউক্ত তত্ত্বের বাস্তবতা প্রমাণিত হয়। ইসলামের প্রথম যুদ্ধ ‘বদর’ এলাকায় সংঘটিত হয়। এ কারণেই এ যুদ্ধকে বদরের যুদ্ধ বলা হয়। এ যুদ্ধে বস্তুশক্তি ও অস্ত্র-সরঞ্জামের দিক দিয়ে মুসলমানরা ছিলেন সর্বাধিক দুর্বল। কিন্তু পরবর্তী যুদ্ধগুলো বিজয় অর্জনের তুলনায় বদরের যুদ্ধে সহজে বিজয় অর্জিত হয়েছে। ওহুদের যুদ্ধে মুসলমানদের বাহ্যিক প্রস্তুতি বদরের তুলনায় অধিক ছিল। কিন্তু এ যুদ্ধে বিজয় অর্জনের ক্ষেত্রে বদরের তুলনায় অধিক বেগ পেতে হয়েছে। এমনিভাবে খন্দক, হুনাইনসহ অন্যান্য যুদ্ধের বিজয়ের ক্ষেত্রেও এ বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়। রসুলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তিরোধানের পর খোলাফায়ে রাশেদীন থেকে পরবর্তী মুসলিম খেলাফতের আমলে, অতঃপর অদ্যাবধি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একই অবস্থা পরিলক্ষিত হয় যে মুসলমান কেবল বস্তু ও অস্ত্রশক্তির বলে কামিয়াবি অর্জন করতে পারেনি। বর্তমান যুগে মুসলমানরা অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় অধিক বস্তুশক্তি, জনশক্তি, অর্থশক্তি ও সমরশক্তির অধিকারী। কিন্তু তারা সমগ্র বিশ্বে সর্বাধিক নিগৃহীত, অপদস্থ ও শত্রুদের খেলনার পাত্র হয়ে আছে।
শক্তিসামর্থ্য অনুপাতে মুসলমানদের বস্তুশক্তি অবশ্যই সংগ্রহ করতে হবে। কিন্তু বিজয় সুনিশ্চিতকরণের জন্য আল্লাহপাকের শক্তি ও সাহায্যকে পক্ষে রাখতে তাঁর প্রতি পরিপূর্ণ আনুগত্য ও গোলামি প্রমাণিত করতে হবে। এ প্রসঙ্গে বদরের যুদ্ধাবস্থায় রসুলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যবস্থাপনা ও কর্মকাণ্ডের বিষয়গুলো পর্যালোচনা করা যেতে পারে।
সহিহ বুখারি শরিফসহ হাদিসের বিভিন্ন কিতাব ও সিরাতসংক্রান্ত বিশুদ্ধ সূত্রে পাওয়া যায় যে বদরের যুদ্ধকালে রসুলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় তাঁবুতে নামাজ ও সেজদায় নতশির হয়ে থাকেন। অশ্রুসিক্ত নয়নে মোনাজাত ও প্রার্থনায় ব্যাকুল হয়ে পড়েন। খন্দকের যুদ্ধে আনুমানিক তিন দিন মোনাজাতে অশ্রুসিক্ত হন। এ কথা সর্বজনস্বীকৃত যে ইসলামের প্রতিটি যুদ্ধে আল্লাহপাকের নির্দেশক্রমেই রসুলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অংশগ্রহণ করেছিলেন অথবা পরিচালনা করেছিলেন। সুতরাং পরাজয়ের কোনো প্রকার আশঙ্কা তখন ছিল না।
তথাপি রসুলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত অস্থির ও বিচলিত হয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে আল্লাহপাকের দরবারে মোনাজাতে বলেন, ‘হে প্রভু! যদি আজ বদরের যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজয় হয় তাহলে তোমার আনুগত্যকারী আর কেউ পৃথিবীতে থাকবে না।’
লেখক : আমির, আল হাইআতুল উলয়া ও বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ