৫ আগস্ট, মঙ্গলবার, ঢাকার আকাশ ছিল মেঘাচ্ছন্ন। থেমে থেমে বৃষ্টির পানিতে ভিজছিল রাজপথ। গত বছর এদিনেই শেখ হাসিনা সরকারের পতন ও ফ্যাসিবাদ বিলোপের এক দফা দাবিতে লাখো ছাত্র-জনতা গণভবনের দিকে জনস্রোত আকারে এগিয়ে যায়। পরিস্থিতি বুঝে বেলা আড়াইটার দিকে প্রথমে সামরিক হেলিকপ্টার ও পরে সামরিক বিমানে করে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। তবে ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য ১ জুলাই থেকে টানা ৩৬ দিন ছাত্র-জনতার ওপর মরণ কামড় বসিয়েছিল শেখ হাসিনা ও তাঁর পেটুয়া বাহিনী। তারপরও টিকে থাকতে না পারায় ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। এদিনটিকে ‘জুলাই অভ্যুত্থান দিবস’ ঘোষণা করেছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। এদিনে প্রায় সব টেলিভিশনের পর্দায় গত বছর এ সময়ে চলা নৃশংসতার ছবি ও বর্ণনা ভেসে উঠছিল; যা দেখে চোখ ভিজছিল বারবার। বিকালে একটি দুঃসংবাদে সেই চোখের পানি বৃষ্টির মতোই নেমেছে সম্মুখ রণাঙ্গনের একদল লড়াকু মুক্তিযোদ্ধার চোখে। তাঁদের মুক্তিযুদ্ধকালীন অধিনায়ক বা কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন আহমেদ বীর উত্তম (৮৩) ৫ আগস্ট ২০২৫ বিকালে সবাইকে ছেড়ে পরলোকে যাত্রা করেছেন।
১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই পশ্চিম পাকিস্তানের ঝিলাম থেকে শিয়ালকোট হয়ে জীবনবাজি রেখে ভারত হয়ে বাংলাদেশের দিকে যাত্রা করেছিলেন তৎকালীন মেজর জিয়া; যিনি সম্প্রতি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ক্যাপ্টেন পাটোয়ারী, মেজর তাহের, স্ত্রী-দুই সন্তানসহ মেজর মঞ্জুর এবং একজন বাঙালি সৈনিক। উল্লেখ্য তাঁদের মধ্যে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে তাহের কর্নেল পদে উন্নীত হন। অবসরকালীন অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার দায়ে সামরিক আদালতের মাধ্যমে তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হয়। আর মঞ্জুর মেজর জেনারেল অবস্থায় চট্টগ্রামে প্রেসিডেন্ট জিয়া হত্যাকাণ্ড ঘটান বলে ব্যাপকভাবে রটনা করা হয়। পরবর্তী সময়ে তাঁকে বিচারের সম্মুখীন করার বদলে রহস্যজনকভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয় একদল সৈনিকের হাতে। সদ্য প্রয়াত জিয়াউদ্দিনসহ দুঃসাহসী দল ১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই দিবাগত রাতে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যে জীবনবাজি রেখে কাশ্মীর অঞ্চলে অবস্থিত পাক-ভারত সীমান্তের দিকে যাত্রা করেন। মেজর মঞ্জুরের বাচ্চাদের ঘুমের ওষুধ দিয়ে প্রায় অচেতন অবস্থায় কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যান জিয়া ও তাঁর সঙ্গীরা। কাশ্মীর সীমান্তে মোতায়েন দুর্ধর্ষ রেঞ্জার্স, কমান্ডো ও অন্য সীমান্তরক্ষীদের চোখ ফাঁকি দিতে পাহাড়, নিচু খাদ, জঙ্গল ও ফসলের মাঠে কখনো হামাগুড়ি দিয়ে, আবার কখনো হাঁটুতে ভর করে পাড়ি দেন দীর্ঘ এক বিপদসঙ্কুল দুর্গম পথ। সারা রাত জীবন-মৃত্যুর দোলাচলে দুলে এবং দুবার নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়ে ভোরের প্রথম আলোতে ভারতের সীমান্তে প্রবেশ করেন এই জিয়া ও তাঁর সঙ্গীরা। তাঁদেরই একজন ক্যাপ্টেন পাটোয়ারী; তথা পরবর্তী সময়ে কর্নেল বজলুল গনি পাটোয়ারী বীর প্রতীক। এ দুঃসাহসিক যাত্রা ও পরবর্তী সময়ে তাঁদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ‘শত্রুভূমি থেকে সম্মুখসমরে’ শীর্ষক একটি বই লেখেন। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল কিছু বিচ্ছিন্ন নোট সম্পাদনা করে এমন একটি বই রচনার সঙ্গে সংযুক্ত থাকার। ২০২৪ সালের নভেম্বরে বইটি প্রকাশিত হয়। তখন কর্নেল পাটোয়ারীর মুখে লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিয়ার বীরত্বগাথা ও দেশপ্রেমের এক অনন্য উপাখ্যান জানতে পেরেছিলাম। আবেগ আর শ্রদ্ধা নিয়ে সামরিক হাসপাতালে অসুস্থ বীর লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিয়াকে দেখতেও গিয়েছিলাম। সেই স্মৃতি আজও মনে পড়ে।
পশ্চিম পাকিস্তানের ঝিলাম ছেড়ে তৎকালীন মেজর জিয়া ও তাঁর দল ভারতের পূর্ব পাঞ্জাবে প্রবেশ করেন। ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের সহায়তায় পরবর্তী সময়ে তাঁদের নেওয়া হয় দিল্লিতে। দিল্লির ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা বিশেষত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করা সমরবিদ ও গোয়েন্দারা তখন ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে অধিকৃত বাংলাদেশ ভূখণ্ডকে শত্রুমুক্ত করতে চূড়ান্ত আক্রমণের পরিকল্পনা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। ঠিক তখন জিয়া, মঞ্জুর, তাহের ও পাটোয়ারী পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিষয়ে বিশদ বর্ণনা ও তাঁদের গোপনীয় সব পরিকল্পনার তথ্য জানিয়ে যৌথ বাহিনীর চূড়ান্ত আক্রমণ পরিকল্পনা প্রণয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন।
দিল্লির পর্ব শেষে তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্নেল (পরবর্তী সময়ে জেনারেল) এম এ জি ওসমানীর সঙ্গে দেখা করেন। ওসমানীর নির্দেশেই মেজর জিয়া বৃহত্তর সিলেট ও ময়মনসিংহ সীমান্তে যুদ্ধরত প্রথম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক নিযুক্ত হন। আর প্রথম ইস্টবেঙ্গলের ডি কোম্পানির অধিনায়ক ও উপ অধিনায়কের দায়িত্ব পান ক্যাপ্টেন বজলুল গনি পাটোয়ারী। ক্যাপ্টেন হাফিজ (বিএনপি নেতা), লেফটেন্যান্ট মাহবুব, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট লিয়াকত প্রমুখ আগে থেকেই এ সেনাদলের সঙ্গে যুদ্ধরত ছিলেন। তাঁদের চিকিৎসক ছিলেন ক্যাপ্টেন ডাক্তার মুজিব; যিনি পরবর্তী সময়ে মন্ত্রী হয়েছিলেন। এসব সাহসী অফিসার জিয়ার নেতৃত্বে পরবর্তীকালে মরণপণ লড়াই করেছিলেন বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে। মেজর জিয়া নেতৃত্ব গ্রহণের আগে প্রথম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট জুলাই মাসের ধনুয়া-কামালপুরে পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বেশ ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়। এ যুদ্ধে সিনিয়র টাইগারস নামে অধিক পরিচিত প্রথম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন অফিসারসহ ৩৩ জন বিভিন্ন পদবির সৈন্য শাহাদাতবরণ করেন। এ ছাড়াও দুইজন অফিসারসহ ৬৬ জন সৈন্য গুরুতর আহত হন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এ সেনাদলের যুদ্ধের ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং সহযোদ্ধাদের হারিয়ে বাকি সৈন্যরা ভয় ও হতাশার শিকার হন। উপযুক্ত প্রশিক্ষণ, অনুপ্রেরণা ও সম্মুখে থেকে জীবনবাজি রেখে নেতৃত্ব দিয়ে মেজর জিয়া এই সৈন্যদের নিয়েই গড়ে তোলেন পাকিস্তানিদের ঘুম হারাম করা আজরাইল বাহিনী ‘সিনিয়র টাইগার্স’। রাতের অন্ধকার ভেদ করে জিয়া ও তাঁর সৈন্যরা গগনবিদারি ‘টাইগার’ সেøাগান তুলে ঝাঁপিয়ে পড়তেন শত্রুর ওপর। এভাবেই জিয়ার নেতৃত্বে একের পর এক সফল যুদ্ধ চালিয়ে যায় ‘সিনিয়র টাইগার্স’রূপী প্রথম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট। একে একে শত্রুমুক্ত হয় ধলই চা-বাগান, রাজঘাট চা-বাগান, শিলচর, আটগ্রাম, জকিগঞ্জ ও কানাইঘাট। সবশেষে শত্রুমুক্ত করে সিলেটে বিজয় পতাকা ওড়ান সদ্য প্রয়াত সেদিনের মেজর জিয়াউদ্দিন বীর উত্তম।
স্বাধীনতার পর ঢাকা সেনানিবাসের স্থাপিত ‘ব্যাটেল স্কুল’ পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় মেজর জিয়াকে। এ স্কুলেই স্বাধীন বাংলাদেশের নবীন অফিসারদের প্রশিক্ষণের সূত্রপাত ঘটে। ১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ বাংলাদেশের পক্ষে শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ‘ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী, সহযোগিতা ও শান্তিচুক্তি’ শিরোনামে ২৫ বছরের মেয়াদি একটি চুক্তি করেন। অনেকের কাছেই এটি ছিল একটি গোলামি চুক্তি, যা দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দেয়। তৎকালীন লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. জিয়াউদ্দিন বীর উত্তম এবং তাঁর মতো বহু মুক্তিযোদ্ধা এমন চুক্তিকে দেশের জন্য ক্ষতিকর, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য অবমাননাকর বলে মনে করেন। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানের তৎকালীন ইমেজ, সার্বভৌম ক্ষমতা এবং তাঁর রাজনৈতিক মতানুসারীদের আকাশচুম্বী ক্ষমতার কারণে এ ব্যাপারে অধিকাংশ মানুষই ছিলেন নীরব, নিথর। কিন্তু গর্জে উঠেছিলেন একজন, তিনিই এই লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিয়াউদ্দিন বীর উত্তম। প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে বেছে নেন গণমাধ্যমকে। ১৯৭২ সালের আগস্টে তৎকালীন সাপ্তাহিক ইংরেজি সময়িকী ‘হলিডে’তে জিয়াউদ্দিন ‘লুকানো মূল্য’ (হিডেন প্রাইস) শিরোনামে একটি নিবন্ধ লেখেন। বিভিন্ন সূত্রমতে এ নিবন্ধে জিয়া তাঁর দৃষ্টিতে অবমাননাকর চুক্তিটি বাতিল করার দাবি জানান। তদুপরি শেখ মুজিবের প্রতি ইঙ্গিত করে লেখেন যে ‘আমরা তাঁকে (শেখ মুজিবুর রহমান) ছাড়াই লড়াই করেছি এবং জয়লাভ করেছি। প্রয়োজনে তাঁকে ছাড়াই আবার যুদ্ধ করব।’ এ লেখা প্রকাশের সময় রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান দেশের বাইরে ছিলেন। দেশে ফিরে তিনি জিয়াউদ্দিনকে ডেকে পাঠান এবং ক্ষমা চাইতে বলেন। বীর উত্তম জিয়াউদ্দিন সরাসরি এমন প্রস্তাব নাকচ করে দেন। পরবর্তী সময়ে তাঁকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। একবুক অভিমান নিয়ে জিয়াউদ্দিন রাজধানী ছেড়ে আত্মগোপনে চলে যান। অনেকেই মনে করেন, এ সময় তিনি সিরাজ শিকদারের সর্বহারা পার্টির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। তাঁর শেষ জীবন নীরবেই কাটে চট্টগ্রামের নিজ বাড়িতে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে পালানোর এক বছর পূর্তির দিনে পৃথিবী ছেড়েই নীরবে চলে গেলেন বাহাত্তরের সরব কণ্ঠ লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিয়াউদ্দিন বীর উত্তম। ৭ আগস্ট দুই দফা জানাজা শেষে যথাযথ মর্যাদায় চট্টগ্রাম সেনানিবাসে তাঁকে সমাহিত করা হয়। মরণোত্তর সালাম ও শ্রদ্ধা জানাই মুক্তিযুদ্ধের এই প্রবাদ পুরুষকে।
লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট
ইমেইল : [email protected]