অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় কিছু অগ্রগতি থাকলেও কাঠামোগত এবং শাসন ব্যবস্থাগত সমস্যাগুলো বেশির ভাগই অপরিবর্তিত থাকার কথা জানিয়েছে সংস্থাটি। ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে সিপিডি।
গতকাল রাজধানীর হোটেল লেকশোরে ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ৩৬৫ দিন’ শীর্ষক সংলাপে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন গত এক বছরে সরকারের শাসন, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও জনসেবার ফলাফল তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন শ্রম ও নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। সভাপতিত্ব করেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান। আরও উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর, সাবেক উপদেষ্টা ম. তামিম, বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু, বিটিএমইএ সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল, সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. এ এস এম আমানুল্লাহ, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান নুরুল আমিন ও গণমাধ্যম সংস্কার কমিটির সদস্য সাংবাদিক জিমি আমির। সিপিডির মতে, অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে লক্ষণীয় সাফল্যের মধ্যে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দৃশ্যমান উন্নতি, আপেক্ষিক রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে সামান্য পুনরুজ্জীবন। এ সাফল্যগুলোকে কঠোর সাময়িক পাচারবিরোধী পদক্ষেপ, রেমিট্যান্সপ্রবাহ বৃদ্ধির পাশাপাশি সরকারি ব্যয়ের শৃঙ্খলাবদ্ধ ব্যবস্থাপনার ফল হিসেবে উল্লেখ করেন ফাহমিদা খাতুন।
তবে গভীর সংস্কার ছাড়া এ অর্জনগুলো স্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা কম। মূল্যস্ফীতি এখনো উচ্চমাত্রায় রয়েছে, যা খাদ্যদ্রব্যের মূল্য ও সরবরাহ শৃঙ্খলের জটিলতায় প্রবলভাবে প্রভাবিত। রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ধীর, বিশেষ করে তৈরি পোশাকশিল্পের ওপর বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা তীব্র হচ্ছে এবং বৈচিত্র্যকরণ উদ্যোগ কমই এগিয়েছে বলে সতর্ক করেছেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক। এ ছাড়াও সামষ্টিক অর্থনীতি ও শাসনব্যবস্থায় কাঠামোগত সংস্কারের অভাবেরও সমালোচনা করেছে সিপিডি। ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, নীতির ধারাবাহিকতা জরুরি, কিন্তু শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান ছাড়া সংস্কার টেকসই হবে না। তিনি স্বাধীন পরিসংখ্যান কমিশন গঠন, সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা বৃদ্ধি এবং সেবার স্থানীয়করণ জোরদার করার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেন। সামাজিক ক্ষেত্রে সিপিডি বলেছে, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বিস্তার সামান্য হলেও কর্মক্ষমতা ও অপচয় এখনো বিদ্যমান। স্বাস্থ্য খাত কঠোর সংকটে রয়েছে, বাজেট বরাদ্দ পদ্ধতিগত দুর্বলতাগুলো মোকাবিলায় অপর্যাপ্ত উদ্যোগ। শিক্ষার মান অপরিবর্তিত থেকে গেছে, যা দীর্ঘমেয়াদি মানবসম্পদ উন্নয়নে উদ্বেগের কারণ। ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, নগর ও গ্রামীণ অঞ্চলের মধ্যে অবকাঠামো বিনিয়োগের বৈষম্য বাড়ছে। সামঞ্জস্যপূর্ণ আঞ্চলিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা জরুরি, যা সামাজিক অস্থিরতা ও অভিবাসন চাপ কমাবে। শাসনের ক্ষেত্রে সিপিডি অন্তর্বর্তী প্রশাসনের মধ্যেও নাগরিক অংশগ্রহণ ও সংসদীয় নজরদারি জোরদারের আহ্বান জানিয়েছে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, যা নির্দিষ্ট কোনো নেতার সদিচ্ছার ওপর নির্ভরশীল থাকবে না, যুক্তি দেন তিনি। অন্তর্বর্তী সরকারের বাকি সময়ের জন্য সিপিডি কিছু অগ্রাধিকারমূলক পদক্ষেপের পরামর্শ দিয়েছে: বিশেষভাবে খাদ্য বাজারে মুদ্রাস্ফীতি কমানোর লক্ষ্যে লক্ষ্যভিত্তিক উদ্যোগ গ্রহণ, আইটি, ফার্মাসিউটিক্যালস ও কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণসহ উচ্চমূল্য সংযোজিত খাতে রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণ দ্রুততর করা, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে সেবা সরবরাহের মান উন্নত করা, দীর্ঘদিন ধরে দাবি করা স্বাধীন পরিসংখ্যান কমিশন গঠন করে তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি করা, অঞ্চলভিত্তিক উন্নয়ন তহবিল সমানভাবে বরাদ্দ নিশ্চিত করা। উপসংহারে তিনি আরও বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার পূর্ববর্তী সময়ের তুলনায় একটি স্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে, তবে এখন থেকে সময় এসেছে স্বল্পমেয়াদি সমাধান থেকে দীর্ঘমেয়াদি প্রতিষ্ঠান নির্মাণের দিকে মনোযোগ দেওয়ার। সাফল্যের চূড়ান্ত মূল্যায়ন হবে পরবর্তী নির্বাচিত সরকার কি একটি শক্তিশালী ও স্থিতিশীল রাষ্ট্র গ্রহণ করতে পারবে কি না সেটার ওপর ভিত্তি করে।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, বিগত ১৫ বছরের শাসনামলের ভেঙে পড়া কাঠামোতে আপনারা কতটা সংস্কার বাস্তবায়ন আশা করেন। তারপরও আমরা একটা কাঠামো দাঁড় করানোর চেষ্টা করছি। কোথাও শুনেছেন কোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর পালিয়ে যায়। আবার গরিবের ব্যাংকার-খ্যাত গভর্নরও রয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, পরিবর্তন তো হয়েছে, এখন কাউকে গুম করা হচ্ছে না। দোষ বাছতে বাছতে একটা নড়বড়ে অবস্থা। শ্রম খাতে স্বার্থের দ্বন্দ্ব আছে। বিজিএমইএ সভাপতিকে কেন মন্ত্রী, এমপি হতে হবে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সম্মেলনে গিয়ে বিজিএমএই সভাপতি শ্রমিকদের কথা বলতে ভুলে যান। গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে আমার অনুরোধ- এসব ক্ষেত্রে যেন স্বার্থের দ্বন্দ্ব না হয়। এ কাঠামো যারা ভেঙেছে তাদের কী বিচার হবে আমি জানি না। সবকিছু চুপচাপ হজম করতে হচ্ছে।
মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, ব্যাংকের লাইসেন্স পাওয়ার দুর্নীতি কীভাবে বন্ধ হবে সেটা গভর্নরের বলা উচিত ছিল। পাঁচটি ব্যাংক মার্জ করবেন কীভাবে, কবে করবেন তার কোনো ঠিক নাই। ফলে এসব ব্যাংকে আমরা লেনদেন করতে পারছি না। নীতিসহায়তা টেকসই না হলে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে কীভাবে। বর্তমান বেসরকারি খাতের সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের অনুমোদন বন্ধ করেছে। এ খাতে অনেক বিদেশি বিনিয়োগ ছিল। বন্ধ না করে তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ট্যারিফ নির্ধারণ করতে পারত। তিনি আরও বলেন, সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ৩০ শতাংশ ভুয়া। আমরা কিছুতে যুক্ত হতে চাইলেই আমলাতন্ত্রের ধর্ম চলে আসছে।
শওকত আজিজ রাসেল বলেন, দেশ ঠিক করতে একটা কলমের খোঁচাই যথেষ্ট। ৩৬৫ দিনে ভালো ম্যাজিকেল কিছু দেখতে পাচ্ছি না। গত এক বছরে ১৮৫০টি টেক্সটাইল মিলের একটাও বাড়েনি বরং কিছু কমেছে।
ম. তামিম বলেন, গ্যাসের স্বল্পতা আমাদের বড় ধরনের বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের কেন্দ্রীয় সহকারী সাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা চাঁদাবাজি নিয়ে একটি অনুষ্ঠান করতে সিপিডির নির্বাহী পরিচালকের কাছে অনুরোধ জানান। তানভীর মাহমুদ দীপু বলেন, চাঁদাবাজি নির্মূল করা হোক অথবা শিল্প হিসেবে ঘোষণা করা হোক। রিকশা শ্রমিক নেতা নাদিম বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের ৩৫৬ দিন আমাদের স্বপ্নভঙ্গের এক বছর। রাতে দোকান বন্ধ করে আমাদের বাসায় ফেরা অনিশ্চিত হয়ে গেছে।