রাজধানীতে পাঁচতারকা হোটেলে গত ৭ থেকে ১০ এপ্রিল চার দিনের দারুণ এক বিনিয়োগ সম্মেলন হয়েছে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা বিডার উদ্যোগে। সম্মেলনে দেশ-বিদেশি শত শত বিনিয়োগকারী তাদের অভিজ্ঞতা বিনিময় করলেন, চট্টগ্রামে ও আড়াইহাজারে রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের শিল্প-কারখানাগুলোর উৎপাদন কার্যক্রম সরেজমিন ঘুরে দেখে তাদের সুচিন্তিত অনেক সুপরামর্শ উপস্থাপন করেন। এটা দেশের শিল্পায়ন কার্যক্রমে সরকারের নিঃসন্দেহে তাৎপর্যময় এক আয়োজন। সরকারপ্রধান প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশি-বিদেশি শিল্প-উদ্যোক্তাদের বাংলাদেশে ব্যাপক বিনিয়োগ করে শুধু আমাদের এই রাষ্ট্রটিই নয়, সারা বিশ্বকে উন্নত করার প্রস্তাব রাখলেন। প্রায় দেড় কোটি টাকা সরকারের এবং আরও ৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ উদ্যোক্তাদের তহবিল থেকে খরচ করে বিদেশি উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে ৩ হাজার ১০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ অঙ্গীকার অর্জন করা গেছে বলে জানিয়েছেন বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক বিনতে হারুন। বর্ণাঢ্য এই সম্মেলন বাংলাদেশে শিল্প-বিনিয়োগ সম্ভাবনার দিকে বিদেশি অর্থবান শিল্পোদ্যোক্তাদের যথাযথ দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হতে পারে, কিছুটা দেশি উদ্যোক্তাদেরও। সম্মেলনটি আয়োজনে রাষ্ট্রের বা সরকারের যে কর্মকর্তা ও অন্য সব কর্মচারী ও সাধারণ নাগরিকদের মেধা-শ্রম-সময়-এনার্জি খাতসমূহে যে আসল খরচ হয়ে গেছে তা টাকার অঙ্কে হিসাব করলে কমপক্ষে ৪০০ কোটি টাকার সমমানের তো অবশ্যই হবে। বৈদেশিক মুদ্রার তীব্র সংকটের সময়ে এত বড় অঙ্কের রাষ্ট্রীয় ব্যয়ের বিপরীতে প্রকৃত অর্জন কী হলো- সেই মূল্যায়নও প্রয়োজন।
এরই মধ্যে সবচয়ে বড় দুঃসংবাদ পাওয়া গেল। বাংলাদেশের এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন- নতুন শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি নির্ধারণ করেছে ৩৩ শতাংশ বর্ধিত দাম ধরে (এপ্রিল/২০২৫ থেকে কার্যকর); আসল পেট্রোবাংলা, সরকারের শীর্ষ কর্তাদের বুঝিয়েছেন এই দাম বৃদ্ধি না করা হলে গ্যাসের ক্ষেত্রে ১৬ হাজার কোটি টাকা সরকারের বা রাষ্ট্রের গচ্চা যাবে (মিডিয়ায় প্রকাশিত রিপোর্ট)। মাথামোটা আমলারা বুঝলেন না, বুঝতে চাইলেন না, এত বড় বিনিয়োগ সম্মেলনটি করার সঙ্গে সঙ্গে এভাবে গ্যাসের দাম বাড়ানোর পরিণামে দেশি বা বিদেশি যে কোনো উদ্যোক্তা হতোদ্যম হয়ে যেতে পারেন। এত টাকা দিয়ে গ্যাস কিনে বাংলাদেশে অনেক ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে শিল্প-কারখানা গড়তে, বিনিয়োগ করতে?
পাশাপাশি আরেকটি দুঃসংবাদ দিয়েছে ভারত- তারা বাংলাদেশের বিপুল পরিমাণ তৈরি পোশাক রপ্তানির প্রক্রিয়াকরণের পথে ‘ট্রান্সশিপমেন্ট’ সুবিধা বাতিল করে দিয়েছে। বাংলাদেশে সাধারণ পণ্য, যন্ত্রপাতি-সরঞ্জামাদিসহ বিভিন্ন জিনিসপত্রের ভারতের বছরের-বাজার (বৈধ অবৈধ উভয় পথে) রয়েছে কমপক্ষে ৫ লাখ কোটি টাকার। তাই ভারতের কাছে বাংলাদেশের শিল্পায়ন কার্যক্রমে পর্যাপ্ত সহায়তাদান কামনা করাই যায়।
দক্ষিণ কোরিয়ার ইয়াং ওয়ান গ্রুপ চেয়ারম্যান এবং সিইও মি. কিহাক সাং দীর্ঘকাল ধরে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ করে বিশাল শিল্প-কারখানা গড়ে তুলেছেন। এই দেশের প্রায় সত্তর হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে সরাসরি তাঁর হাতে; তাঁকে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দিতে পঁয়তাল্লিশ বছর পর লেগে যায় কেন? এত বছর আমাদের রাজনীতিকগণ, আমলা-গোষ্ঠী ঘুমিয়ে ছিল সবাই? পাঁচটা বছর একটানা কারখানা চালানোর পরেই তাঁকে এই সম্মানটা দেওয়া হলে ভদ্রলোক হয়তো বিগত চল্লিশটা বছর এই সম্মানটুকু উপভোগ করতেন, তাঁর এই সম্মান-অর্জনে আরও অনেক বিনিয়োগকারী এই দেশে শিল্প-কারখানা গড়তে উৎসাহিত হতেন নিশ্চিতভাবে। আমরা এতটাই বেকুব যে বিষয়টা বুঝতে চল্লিশ বছর সময় পার করে দিই। আটাত্তর বছরের বৃদ্ধ লোকটি ইতোমধ্যে তো আমাদের এ দুনিয়া ছেড়ে চলে যেতেও পারতেন, তাহলে এই সম্মান আমরা তখন কাকে দিতাম?
গ্যাসের দাম বাড়ানোর ফলে শিল্পোদ্যোক্তারা কীভাবে কারখানা প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসবেন, তাদের উৎপাদিত শিল্প-পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়বে অপরিসীম, কীভাবে তারা শ্রমিক-কর্মচারীদের পর্যাপ্ত বেতন-ভাতা-সুবিধাদি দিয়ে প্রোডাক্ট মূল্য নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে ধরে রাখবেন? এসব পণ্য কী দরে বিক্রি করে তারা ন্যূনতম নিট-মুনাফা অর্জন করবেন, গ্যারান্টি না থাকলে কীভাবে তারা নতুন শিল্প-কারখানা করবেন?
১. যে কোনো নতুন শিল্প-কারখানা গড়তে আগ্রহী উদ্যোক্তাদের জন্য ওয়ান-স্টপ সার্ভিস জরুরি। কোনো শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এ দেশে এসে বিদেশি যে কোনো নাগরিক (অবশ্যই যিনি মাদক বা অন্য কোনো পণ্যের চোরাকারবারি বা অন্যভাবে কুখ্যাত অপরাধী নন) যেন সব ধরনের রেজিস্ট্রেশন ও অনুমোদনপত্র, দলিলপত্র তৈরি ও ব্যবহারে একটা অফিসে বসেই সব কর্মকাণ্ড সম্পন্ন করতে পারেন। তাঁকে/তাঁদেরকে যেন এই অফিস, সেই অফিসের সিঁড়ি ভাঙার মতো, এই কর্তা, সেই কর্তার টেবিলে টেবিলে ঘুরতে না হয় দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। তিনি/তাঁরা যেন একটা অফিসে বসে সর্বোচ্চ তিন দিনের মধ্যে একটা ১০/২০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের শিল্প-কারখানা প্রকল্প প্রতিষ্ঠার সব দলিলপত্র সম্পাদনের সুযোগ পান- সেটা শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে।
২. যেসব খাতে শিল্প-বিনিয়োগ সফল হতে পারে, রপ্তানি কার্যক্রম ও স্থানীয় বাজারে চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে, সেসব নিয়ে ব্যাপক স্টাডি ও গভীর গবেষণা চালিয়ে রিপোর্ট করতে হবে। সেই রিপোর্টে বাংলাদেশের নাগরিকদের ভোক্তা-চাহিদা মেটাতে যেসব পণ্যের চাহিদা রয়েছে তার প্রকৃত চিত্র এবং একই সঙ্গে বিশ্ববাজারে রপ্তানিযোগ্য পণ্য যেগুলো বাংলাদেশে উপযুক্ত শিল্প বিনিয়োগে উৎপাদন সম্ভব সেগুলোর প্রকৃত চিত্র অনুপুঙ্খ আলোচনা থাকতে হবে। যাতে যে কোনো বিদেশি (এমনকি দেশি উদ্যোক্তাও) উদ্যোক্তা যেন সহজেই সেসব রিপোর্ট পড়ে এখানকার উৎপাদন-ব্যয় পরিস্থিতি ও ভোক্তা-পণ্য-চাহিদা এবং বিদেশে রপ্তানিপণ্য পাঠানোর সুবিধাদি কী কী আছে, সেসব পুরোপুরি বুঝতে সক্ষম হন।
৩. বিদেশি শিল্পোদ্যোক্তাদের বা তাঁদের প্রতিনিধি (কর্মকর্তাদের) এখানকার বিমানবন্দরে নামার সঙ্গে সঙ্গেই যথাযথভাবে তাঁকে স্বাগত জানানো থেকে প্রতিটি পদক্ষেপে সশরীরে উপস্থিত থেকে বিডা কর্মকর্তাদের সার্বক্ষণিক সেবা দিয়ে যেতে হবে। আর বিডা কর্মকর্তাদের চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন সম্ভাবনাময় ধনবান উদ্যোক্তাদের দেশগুলোতে সাশ্রয়ী খরচে সফর করার সুযোগ দিতে হবে এবং ওই সব দেশে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তাদের কাজে লাগাতে হবে। তবে সবার জন্য ঘুষ-উৎকোচ লেনদেন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে।
৪. বিদেশি উদ্যোক্তাদের জন্য (একই সঙ্গে দেশি উদ্যোক্তাদের জন্যও) সার্বক্ষণিক রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাব্যবস্থা কায়েম করতে হবে- তাঁদের আবাসস্থল, অফিস ও শিল্প-কারখানায় এবং চলাফেরার সময়ে সর্বত্র)।
৫. ব্যাংকঋণ সুবিধাদির নিশ্চয়তা বিধান জরুরি, এবং তা সম্ভাব্য স্বল্পতম সময়ের মধ্যে অনুমোদন ও ঋণের অর্থ যথাসময়ে ব্যবহারের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে শিল্প-কারখানার জন্য দরকারি সব যন্ত্রপাতি সরঞ্জামাদি (কাভার্ড ভ্যান ও অন্য সব যানবাহন ইত্যাদি) দ্রুততার সঙ্গে আমদানি ও ইনস্টলেশন সুবিধা এবং শিল্পে প্রয়োজনীয় উৎকৃষ্ট মানের সব কাঁচামালের সরবরাহ নিশ্চয়তা বিধান অপরিহার্য।
৬. শ্রমিক অসন্তোষ পুরোপুরি দূর করতে তাদের ন্যূনতম বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা দরকার; এরপরও কোনো চক্রান্তকারী গোষ্ঠী কুমতলবে যাতে শ্রমিক অসন্তোষ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে না পারে, সে লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা কার্যক্রম শক্তিশালী করতে হবে।
এরপরও আছে বিনিয়োগ কার্যক্রম সফল করতে হাজার তৎপরতা চালানোর বিষয়াদি-প্রতিনিয়ত সেসব লক্ষ্যে কাজ করার জন্য চাই দেশপ্রেমিক আমলাদের নিয়োগ দান।
লেখক : বিএনপির সাবেক তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক