লোটাস কামাল হলেন আওয়ামী লীগের সেই ভাগ্যবান ব্যক্তি, যিনি শেখ হাসিনার পতনের আগেই ব্যাংক খালি করে বিদেশে পালিয়েছেন। ঢাকা এবং কুমিল্লায় তার ৩৭টি ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট এবং বাড়ি এখনো অক্ষত রয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন বা সরকার তার কোনো স্থাবর সম্পত্তি এখনো জব্দ করেনি, এটা একটি আশ্চর্য ঘটনা। দুর্নীতি দমন কমিশন গত ২২ আগস্ট তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করে বটে, কিন্তু তার স্থাবর সম্পত্তি, বাড়িঘর ইত্যাদি জব্দ করেনি।
ফলে ৫ আগস্টের পর সবচেয়ে সৌভাগ্যবান ব্যক্তিদের মধ্যে একজন লোটাস কামাল। কোনো কিছুই তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারেনি। লোটাস কামাল গত পয়লা আগস্ট দেশ ছেড়ে চলে যান। চলে যাওয়ার আগে তিনি তার স্ত্রী এবং মেয়ের নামে যে সমস্ত ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ছিল সেগুলো মোটামুটি খালি করে দিয়ে চলে গেছেন। ২২ আগস্ট তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করার পর দেখা যায় যে তার অ্যাকাউন্টে টাকা পয়সার পরিমাণ সামান্য।
দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রাক্কলিত হিসাব অনুযায়ী, এই সময়ের মধ্যে ব্যাংক থেকে তিনি প্রায় ৭৯৮ কোটি টাকা নগদ উত্তোলন করেছেন। বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে এই টাকাটি তিনি পাচার করেছেন। ইতোমধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন লোটাস কামাল, তার স্ত্রী ও মেয়ের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। এই মামলায় তাদের বিরুদ্ধে ১৬৫ কোটি ৫৭ লাখ টাকার অবৈধ সম্পত্তি পাওয়া গেছে বলে অভিযোগ করেছেন। কিন্তু বাস্তবে বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনুসন্ধানে দেখা যায় যে, এই সম্পদের পরিমাণ অনেক বেশি। লোটাস কামালদের ১০৭টি ব্যাংকের হিসাব জব্দ করা হয়েছে। কিন্তু এসব ব্যাংকে টাকা ছিল খুবই সামান্য। এই ব্যাংক হিসাব জব্দ করার আগেই সবগুলো অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। এসব অ্যাকাউন্টে লেনদেন হয়েছে প্রায় ৮৫০ কোটি টাকার। দুর্নীতি দমন কমিশনের এজাহারে বলা হয়েছে যে, বৈধ আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন ২৭ কোটি ৫২ লাখ ৫৪ হাজার টাকার সম্পদ অর্জন করেছেন লোটাস কামাল। বাস্তবে এই অভিযোগ শুধু হাস্যকর নয়, কৌতুকপ্রদ বটে। কারণ বাস্তবে এর চেয়ে অনেক বেশি সম্পদ তার রয়েছে দেশে এবং দেশের বাইরে।
দুদকের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, লোটাস কামালের নিজের এবং ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে ৩২টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ২৩৪ কোটি ৮৬ লাখ ৬৫ হাজার টাকা জমা ছিল। কিন্তু বিদেশ যাওয়ার আগে তিনি ২১১ কোটি ৫৫ লাখ ৮৮ হাজার টাকা উত্তোলন করেছেন। এই টাকা এখন কোথায় তার কোনো হদিস নাই। লোটাস কামালের স্ত্রী কাশমেরি কামালের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে ৪৪ কোটি ১১ লাখ ৬২ হাজার টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের অভিযোগে। কিন্তু বাস্তবে এই সম্পদ নিতান্তই সামান্য। কাশমেরি কামাল অন্ততপক্ষে ৫ হাজার কোটি টাকার মালিক এবং বিদেশে তার সাম্রাজ্য রয়েছে।
লোটাস কামালের স্ত্রীর ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও নিজের নামে ২০টি অ্যাকাউন্টের হিসাবে ১৮ কোটি ৬৯ লাখ ৭৯ হাজার টাকা জমা এবং ৭ কোটি ৮৪ লাখ উত্তোলনের তথ্য পাওয়া গেছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, এই হিসাব খুবই সামান্য। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কাশমেরি কামালের অধিকাংশ সম্পত্তি বিদেশে। তার স্ত্রী কাশমেরি কামালের বিরুদ্ধে ৩১ কোটি ৭৮ লাখ ৮৩ হাজার টাকার অবৈধ সম্পদের অভিযোগে মামলা হয়েছে। ৩৮টি ব্যাংক হিসেবে তার ৯০ কোটি ৬০ লাখ ৭০ হাজার টাকা জমা ছিল। কিন্তু যখন তার ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয় তখন সেখান থেকে ৮৬ কোটি ৮৭ লাখ ৫২ হাজার টাকা ইতোমধ্যে উত্তোলন করা হয়ে গেছে। অর্থাৎ প্রায় পুরো টাকাটাই তার কাশমেরি কামাল উত্তোলন করেছেন। লোটাস কামালের মেয়ে নাফিসা কামালের বিরুদ্ধে ৬২ কোটি ১৪ লাখ ৭৭ হাজার টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের অভিযোগে মামলা হয়েছে।
দুদকের হিসাব অনুযায়ী, তার ব্যক্তিগত এবং ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাংক হিসাব রয়েছে ১৭টি। যেগুলোতে ১০২ কোটি ১৫ লাখ টাকা জমা ছিল। কিন্তু বিদেশে যাওয়ার আগে তারা ৯৭ কোটি ৭ লাখ টাকা উত্তোলন করে ফেলেছেন। এভাবে সমস্ত ব্যাংক খালি করে লোটাস কামালের পরিবার বিদেশে চলে গেছে। যেখানে তারা সম্পদের পাহাড় করেছেন।
এ তো গেল লোটাস কামালের ব্যাংক হিসাবের বিবরণ। কিন্তু ব্যাংক হিসাবের বাইরে লোটাস কামালের যে বিপুল পরিমাণ স্থাবর সম্পত্তি রয়েছে, সেই স্থাবর সম্পত্তির কোনো কিছুই এখন পর্যন্ত দুর্নীতি দমন কমিশন জব্দ করেনি। অন্যদের বেলায় যেমন দুর্নীতি দমন কমিশন স্থাবর সম্পত্তি জব্দ করার পদক্ষেপ গ্রহণ করে লোটাস কামালের ক্ষেত্রে তার আশ্চর্য ব্যতিক্রম।
ঢাকা শহরে তার অন্তত ৩৭টি বাড়ি এবং ফ্ল্যাট এখনো অক্ষত অবস্থায় রয়েছে। বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনুসন্ধানে দেখা যায় যে, ঢাকার নিকুঞ্জ, জোয়ার সাহারায় রয়েছে আধুনিক বাণিজ্যিক ভবন লোটাস কামাল টাওয়ার। এই লোটাস কামাল টাওয়ার নিয়ে নানারকম দুর্নীতি এবং অনিয়মের কাহিনি আছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের সময় সেই দুর্নীতি, অনিয়মের ব্যাপারে কোনো রকম তদন্ত হয়নি। সে নিয়ে কোনো রকম উদ্যোগও নেওয়া হয়নি। অনুসন্ধানে দেখা গেছে যে, লোটাস টাওয়ারের নকশা থেকে এসব কর্মকাণ্ডে অনিয়ম রয়েছে।
গুলশান এভিনিউ ১ থেকে ২ নম্বরের দিকে যেতেই ৫৯ এবং ৬০ নম্বর প্লটে নির্মাণ করা হয়েছে ব্যয় বহুল একটি ভবন। যার নামও দেওয়া হয়েছে লোটাস কামাল টাওয়ার। এই লোটাস কামাল টাওয়ারে শপিং মল, অফিস জমজমাট। কিন্তু ভবনটি নির্মাণের পিছনে রয়েছে বিরাট গলদ। প্রথমে ১৪ তলার অনুমতি নিয়ে ভবন নির্মাণ শুরু হয়। এরপর নকশা ব্যত্যয় ঘটিয়ে ১৪ তলার ওপর দিয়ে একে একে বাড়ানো হয় আরও ৬টি তালা। যেগুলো পুরোপুরি ভাবে অবৈধ। আর এই অবৈধ কাজ বৈধ করতে অভিনব কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে ২০২১ সালে লোটাস কমাল আওয়ামী লীগের এমপি, তার নেতৃত্বে সে সময় চলছিল আর্থিক খাত খেয়ে ফেলার মহা উৎসব, তখন বিপুল পরিমাণ ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন লোটাস কামাল। ঠিক সেই সময় বহুতল ভবন অবৈধ ছয় তলা বৈধ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
রাজউকে আবেদন করেন লোটাস কামালের স্ত্রী কাশমেরি কামাল ও নাফিসা কামাল। সেই আবেদনে জরিমানা দেওয়ার মাধ্যমে ১৪ তলার ওপর আরও ছয় তলা করার জন্য চাপ দেওয়া হয়। এটি নিয়ে এক সময় রাজউক বেশ জটিলতার মধ্যে পড়েছিল। বিষয়টি নিয়ে পাঁচ সদস্যের উচ্চপর্যায়ের বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন কমিটি গঠন করা হয়। এরপর রাজউক থেকে নেওয়া হয় কৌশলী অবস্থান। ফায়ার সার্ভিস ছাড়পত্র, প্রকৌশলী, স্থাপতি লেআউট নকশা এবং রাজউকের বৃহত্তায়ন প্রকল্পের অনুমোদন ও ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণের জন্য কাঠামো সহযোগিতার বিষয় স্থাপত্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রত্যয়নপত্র নিতে হবে বলে লোটাস কামালের পরিবারকে জানান কর্মকর্তারা।
রাজউক সূত্রে জানা যায় যে, ভবনটির নির্মাণে অনিয়ম ছিল পদে পদে। সবচেয়ে বড় লঙ্ঘন ছিল অনুমোদন না নিয়ে ভবন সম্প্রসারণ করা। কিন্তু সেই ভবনটি এখন পর্যন্ত অক্ষত রয়ে গেছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে যে, বনানীতে লোটাস কামালের নিজস্ব বাড়ি রয়েছে ১০ কাঠা জমির ওপর। ৫ আগস্টের পর বিভিন্ন বাড়ি আক্রান্ত হলেও লোটাস কামালের এই বনানীর বাড়ি আক্রান্ত হয়নি। বনানী ছাড়াও বাড্ডায় রয়েছে তার তিনটি বিলাশ বহুল দামি ফ্ল্যাট এবং একটি বাড়ি। এই বাড়িও এখন পর্যন্ত দুর্নীতি দমন কমিশন জব্দ করেনি।
কাশমেরি কামালের নামে ঢাকার গুলশানে রয়েছে পাঁচটি ফ্ল্যাট এবং বাড্ডায় রয়েছে ছয়টি ফ্ল্যাট। এগুলোর কোনোটাই জব্দ করা হয়নি। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে এই ফ্ল্যাটগুলোতে ভাড়াটে থাকেন। একজন কেয়ারটেকার এই ভাড়া তোলেন। লোটাস কামাল প্রপার্টিজের নামে যে ফ্ল্যাটগুলো রয়েছে সেসব ফ্ল্যাট লোটাস কামালের সম্পত্তি, কিন্তু এসব সম্পদ একটিও এখন পর্যন্ত জব্দ করেনি। ঢাকা ছাড়াও কুমিল্লাতে রয়েছে তার নিজের এবং স্ত্রীর নামে বিলাস বহুল বাড়ি এবং জমি। এসব বাড়ি এবং জমি এখন পর্যন্ত জব্দ করা হয়নি। এ ছাড়াও লোটাস কামালের পরিবারের আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং শেয়ারে বিনিয়োগ রয়েছে। লোটাস কামাল প্রপার্টিজ ও সৌদি বাংলাদেশ কন্ট্রাক্টিং কোম্পানিসহ বিভিন্ন কোম্পানিতে ২৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন, সেই বিনিয়োগ জব্দ করা হয়নি। তার সঞ্চয়পত্র রয়েছে ৪০ কোটি টাকা, যা এখনো জব্দ করা হয়নি। এ ছাড়াও তিনটি গাড়ির মালিক কাশমেরি কামাল যেগুলো এখনো জব্দ করা হয়নি।
বাংলাদেশের আর্থিক খাতে সর্বনাশের হোতা লোটাস কামাল ওরফে আ হ ম মুস্তফা কামাল। কিন্তু তার প্রতি সরকারের এই উদারতার কারণ কী?