মিয়ানমার বাংলাদেশের ফুটবলে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকল। যা পুরুষ ও নারী জাতীয় দলের জন্য সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে। বুধবার ইয়াঙ্গুনে নারী এশিয়ান কাপ বাছাই পর্বে বাংলাদেশ ২-১ গোলে স্বাগতিক মিয়ানমারকে পরাজিত করে এক ম্যাচ আগেই মূল পর্ব নিশ্চিত করেছে। শনিবার ‘সি’ গ্রুপে শেষ ম্যাচে আফঈদা খন্দকার, ঋতুপর্ণারা তুর্কমেনিস্তানের বিপক্ষে লড়বে। আসরে সবচেয়ে দুর্বল দেশ তুর্কমেনিস্তান। সে কারণে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েই বাংলাদেশের মূল পর্বে খেলার সম্ভাবনা বেশি। যদি হেরে যায় এবং বাহরাইনকে মিয়ানমার হারাতে পারলে দুই দেশের পয়েন্ট দাঁড়াবে ছয়। সে ক্ষেত্রেও মূল পর্বে খেলা নিশ্চিত বাংলাদেশের। কেননা, বাইলজ অনুযায়ী টুর্নামেন্টে দুই দলের পয়েন্ট সমান হলে হেড টু হেড নিয়ম ধরা হবে। হেড টু হেড মানে দুই দেশের গ্রুপ পর্ব লড়াইয়ে যারা জিতবে তারাই মূল পর্বে জায়গা করে নেবে।
এখন আর কোনো পরিসংখ্যানই কার্যকর হবে না। শেষ ম্যাচে যদি বাংলাদেশ অপ্রত্যাশিতভাবে হেরেও যায় এবং মিয়ানমারের সমান ছয় পয়েন্ট অ্যাকাউন্টে জমা থাকে তাহলেও বাংলাদেশের কোনো সমস্যা হবে না। মিয়ানমারকে হারানোর সুবাদেই প্রথমবারের মতো এশিয়ান কাপ চূড়ান্ত পর্বে বাংলাদেশ খেলবে। ঋতুপর্ণাদের মূল পর্ব নিশ্চিত হয়েছে বুধবার দ্বিতীয় ম্যাচে তুর্কমেনিস্তান ও বাহরাইন ড্র করায়। তুর্কমেনিস্তান যদি ম্যাচটি জিততে পারত তাহলে তাদেরও চূড়ান্ত পর্বে খেলার সম্ভাবনা থাকত। পরবর্তী ম্যাচে বাংলাদেশকে হারাতে পারলেই তুর্কমেনিস্তান হেড টু হেডের সুবাদে মূল পর্বে চলে যেত। অর্থাৎ এখন আর কোনো ভয় নেই বাংলাদেশের মেয়েদের। ৫ জুলাই জিতুক বা হারুক আফঈদাদের কোনো যায় আসবে না। তবে মিয়ানমারের সঙ্গে ম্যাচটি যদি ড্র হতো, তাহলে বড় ঝুঁকির মধ্যে থাকত বাংলাদেশ। তখন আবার গোল ব্যবধানে যারা এগিয়ে থাকত, তারাই টিকিট পেত অস্ট্রেলিয়ার। শেষ ম্যাচে প্রতিপক্ষ বাহরাইন ছিল বলে মিয়ানমার গোল সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা করত। এ ক্ষেত্রে তারা সফলও হতে পারত।
যাক, সব ভয়কে জয় করেছে বাংলাদেশ। এখন শুধু অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার অপেক্ষা। আগামী বছর অস্ট্রেলিয়াতেই বসবে নারী এশিয়াকাপ ফুটবলের চূড়ান্ত পর্ব। মিয়ানমারের বিপক্ষে ঐতিহাসিক জয় পেয়েই ইতিহাস লিখেছে মেয়েরা। অথচ এ মিয়ানমার ঘিরেই নারী ফুটবলারদের বড় কষ্টও ছিল। আর তা বাফুফের তৎকালীন সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনের মিথ্যাচারের কারণে। ২০২২ সালে সাবিনা খাতুনরা প্রথম সাফচ্যাম্পিয়ন হয়ে ইতিহাস গড়েছিল। পরের বছর মিয়ানমারে নারী দলের অলিম্পিক বাছাই পর্বে খেলার কথা ছিল। এই ট্যুর নিয়ে বাফুফে কী নাটকটাই না করেছে। প্রথমে বলল অলিম্পিক বাছাইয়ে শক্তিশালী দেশগুলো অংশ নেবে। আমরা চাই না টুর্নামেন্টে ভরাডুবি ঘটিয়ে সাফ জেতার স্পিরিটটা নষ্ট হোক। পরে আবার বাংলাদেশ খেলবে বলে ঘোষণা দিলেন তৎকালীন সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন। সাবিনারা অনুশীলনেও নেমে পড়লেন। মিয়ানমার যাওয়া যখন চূড়ান্ত তখনই তারা বড় ধাক্কাটা খেল। যাওয়ার জন্য লাগেজও গুছিয়ে ফেলেছিল মেয়েরা। এমন সময় বাফুফে থেকে বলা হলো, মিয়ানমার যাওয়ার মতো অর্থ তাদের নেই। হলো না অলিম্পিক বাছাইয়ে খেলা। সেই মিয়ানমারে এশিয়া কাপ খেলার স্বপ্ন পূরণ করল আফঈদারা। তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের জবাব মাঠেই দিয়েছে মেয়েরা। এশিয়া কাপ চূড়ান্ত পর্ব খেলতে পুরুষ দলকেই গুরুত্ব দিচ্ছে বাফুফে। উড়িয়ে এনেছে প্রবাসীদের। এর পরও অনিশ্চিত চূড়ান্ত পর্বে খেলা। হামজাদের আগেই ঋতুপর্ণারা স্বপ্নের এশিয়ান কাপে জায়গা করে নিয়েছে। হেড কোচ পিটার বাটলারকে নিয়ে কতই না ষড়যন্ত্র হয়েছে। অথচ এই ইংলিশ ম্যান মাঠেই তার যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছেন। এমন জয়ে প্রমাণ মিলেছে ষড়যন্ত্রকারীদের আসল রূপ। শুধু এশিয়ান কাপ নয়, বাংলাদেশের মেয়েরা এখন বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। অস্ট্রেলিয়ায় এশিয়া কাপের যে মূল পর্ব হবে সেখানকার সেমিফাইনালে যাওয়া চার দল নারী বিশ্বকাপ খেলবে। এশিয়া থেকে আরও দুটি দল খেলবে কোয়ার্টার ফাইনালে সেরা পারফরমার হিসেবে। অনেক শক্তিশালী দেশ খেলবে এটা ঠিক। কিন্তু মেয়েরা যেভাবে একের পর এক ইতিহাস লিখে চলেছে, তাদের নিয়ে তো আশা করা যেতেই পারে। বাফুফে চূড়ান্ত পর্বের জন্য কীভাবে মেয়েদের উৎসাহ জোগাবে। তারই ওপর নির্ভর করছে সবকিছু। এই মিয়ানমারেতেই পুরুষ জাতীয় দলও ইতিহাস লিখেছিল। ১৯৯৫ সালে মোনেম মুন্নার নেতৃত্বে চার জাতি চ্যালেঞ্জ কাপে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ফাইনালে স্বাগতিক মিয়ানমারকে হারিয়ে। আর এটিই ছিল দেশের বাইরে জাতীয় দলের প্রথম ট্রফি জেতা। দুটোই ইতিহাস। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তো মেয়েরা এগিয়ে। পুরুষ জাতীয় দল এক টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন। মেয়েরা পেল এশিয়ান কাপ চূড়ান্ত পর্বে খেলার স্বীকৃতি। যা পুরুষ দলের জন্য বড় স্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। মেয়েদের এ বিজয় পুরুষ দলকে বড় চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলে দিল।