নিরিবিলি এক গ্রাম। চিরচেনা, শান্ত। অথচ এক গোপন আতঙ্কে ঢেকে আছে বছরের পর বছর। লোকমুখে শোনা যায়, গ্রামের শেষপ্রান্তে পুরোনো এক পরিত্যক্ত বাড়ি আর তার পেছনে থাকা পুকুরটি ‘মরা পুকুর’ নামে কুখ্যাত। কেউ বলে, ওখানে যারা গোসল করে, তারা আর ফিরে আসে না। কেমন অদৃশ্য টান আছে পুকুরের পানিতে। অনেকে নাকি রাতের বেলা ওই পুকুরপাড়ে অদ্ভুত কান্নার আওয়াজ শুনেছে। কেউ বা দেখেছে পানিতে অদ্ভুত নড়াচড়া। এসব গুজবের মাঝেই তিন বন্ধু রাফি, সাদিক আর তানিম-দুঃসাহস দেখিয়ে এক রাতে বাড়ি থেকে চুপিচুপি বেরিয়ে পড়ে। ওদের লক্ষ্য, মরা পুকুরের রহস্য উদ্ঘাটন। ওরা কারো কথায় বিশ্বাস করে না। বিশ্বাস করে শুধু নিজেদের কৌতূহল আর সাহসে।
রাত তখন গা ছমছমে। চাঁদ আকাশে লুকোচুরি খেলছে। গ্রামের সীমানা পেরোতেই চারপাশে ছায়াময় অন্ধকার। বাতাস থমকে আছে। যেন কিছু একটা ঘটার অপেক্ষায়। হঠাৎ জঙ্গলপথে কুকুরের করুণ চিৎকার। আবার কোথাও পায়ের শব্দ, অথচ কেউ নেই! তিন বন্ধু একে অপরকে জড়িয়ে ধরে হাঁটে। হাঁটতে হাঁটতে ওরা যায় ধানের মাঠ পেরিয়ে, বাঁশঝাড়ের গা ঘেঁষে, সোজা ‘পরিত্যক্ত বাড়ির’ দিকে। হঠাৎ! একটা শুকনো গাছের ডাল ভেঙে পড়ে পাশেই। তানিম চমকে উঠে বলে, ‘কেউ আমাদের পেছনে আসছে?’ সাদিক কাঁপাকণ্ঠে বলে, ‘কেউ আসছে না। বাতাসে পড়েছে।’ তখনই ওরা একসঙ্গে থেমে যায়। সামনে বাঁশঝাড়ের ফাঁকে একটা ছায়ামূর্তি। টর্চ ফেলতেই কিছুই নেই। একটা শীতল বাতাস আসে পেছন দিক থেকে। যেন কেউ নিঃশ্বাস ফেলল খুব কাছেই। তিন বন্ধু শিউরে উঠল! একে অপরের দিকে তাকাল। রাফি বলল, আমাদের ফিরে যাওয়া উচিত। সাদিক আর তানিম চুপ করে রইল। ওদের মনে ভয়, আতঙ্ক। তবু রহস্য উদ্ঘাটনের তীব্র ইচ্ছা। অন্ধকার ভেদ করে ওরা হাঁটতে থাকল।
অবশেষে ওরা পৌঁছে গেল সেই পরিত্যক্ত বাড়ির সামনে। বাড়িটি যেন ধ্বংসস্তূপ। পাঁচিল ধসে পড়েছে। হাঁটলেই মেঝেতে চির ধরে। জানালায় লতাপাতা জড়িয়ে আছে। ভিতরে ঢুকতেই ভ্যাপসা গরম। ধুলা আর পচা কাঠের মিশ্র গন্ধ। দেয়ালে হাত দিলে মনে হয় কেউ যেন ভিতর থেকে দেয়াল চাপড়াচ্ছে। ঘরের এক কোণে ছেঁড়া একটা পর্দা। তাতে লেগে আছে হাতের ছাপ। এক ঘরের দেয়ালে আঁকাআঁকির মতো কী সব দাগ। যেন নখ দিয়ে কেউ কিছু লিখেছে। এক কোণে পড়ে আছে একটা ছেঁড়া পুতুল। যার চোখগুলো উল্টে আছে মাথার পেছনে। যেখানে সেখানে তৈজসপত্র ছড়িয়ে আছে। ছাদে উল্টে থাকা একটা ঝাড়বাতি, যা একটু পরেই নিজে নিজেই দুলতে শুরু করে।
বাড়ির পেছনে সেই পুকুর। পানি একেবারে স্থির। না ঢেউ, না শব্দ। তিন বন্ধু চমকে উঠে বলল, এটা কেমন পুকুর? রাফি বলল, আমি আগেই বলেছিলাম ফিরে যাওয়া উচিত। সাদিক আর তানিম ঢোক গিলে বলল, এখন তো আর সম্ভব নয়। ওরা ভয়ে ভয়ে পুকুরের কাছে যায়। টর্চের আলো ফেলতেই দেখে, পানির ওপর একটা কিছুর রেখা। আরেকটু কাছে যেতেই বোঝা যায়-এটা শরীর! পচা, ফোলা, অদ্ভুতভাবে পানির ওপর ভেসে আছে। হঠাৎ সেই লাশটা নিজের মুখ ঘোরায়। চোখ দুটো খোলা! সাদা, দৃষ্টিশূন্য, অথচ ওদের দিকেই তাকানো।
তারপর-
লাশটা উঠে দাঁড়ায় পানির ওপর! নড়ে না পানি। কিন্তু সে উঠে দাঁড়ায়। লাশটির চোখে আগুন, মুখ বিকৃত, কণ্ঠস্বর কর্কশ।
‘আমি ছিলাম কৃষক। আমার জমি ছিল। জমিদার কেড়ে নিল সব। আমি চিৎকার করেছিলাম। তারা আমাকে টেনে নিয়ে এলো এই পুকুরে। বছরের পর বছর আমি অপেক্ষা করেছি ... কেউ জানতে আসেনি। কেউ সাহায্য করেনি। রাগে-ক্ষোভে আমি বহুজনকে নিয়ে গেছি আমার সঙ্গে।’ এই বলে সে এমন ভয়ানক চোখে তাকায় যে তিন বন্ধুর দম বন্ধ হয়ে আসে। ওরা দৌড়ে পালাতে চায়। কিন্তু পা যেন জমে যায়।
হঠাৎ দূর থেকে আলো। কণ্ঠস্বর ‘রাফি! সাদিক! তানিম!’ ওদের বাবা-মা! গ্রামের লোকজন মশাল হাতে এসে পড়ে। পুকুরের দিকে দৌড়ে আসে। লাশটা ধোঁয়ার মতো মিলিয়ে যায়। আর পুকুরের পানি আবার থেমে যায়। ঘটনার পর তিন বন্ধু দিনের পর দিন অসুস্থ থাকে। ওরা আর কখনো রাতে বাইরে যায় না। বুঝতে পারে, বড়দের সাবধান বাণী অমূলক নয়। বড়দের কথার পেছনে থাকে অভিজ্ঞতার ছায়া। সব রহস্য জানার নয়। কিছু রহস্য রয়ে যায়। যেমন থাকে ঘুমিয়ে থাকা অভিশাপ।