অ্যাপার্থেইড পলিসির (বর্ণবিদ্বেষ) কারণে ২১ বছর নির্বাসনে থাকা দক্ষিণ আফ্রিকা ফিরে এসে ১৯৯৮ সালে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জিতেছিল বটে, কিন্তু বিশ্বক্রিকেটে কৌলিন্য পায়নি। উল্টে ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল থেকে জুড়ে গিয়েছে ‘চোকার্স’ তকমা। একের পর এক বিশ্বকাপে সেই তকমার আঁঠা আরও গাঢ় হয়েছে।
বলা হয়েছে, বড় ম্যাচের চাপ নিতে পারে না তারা। অ্যালান ডোনাল্ড, শন পোলক, জ্যাক ক্যালিস, এবি ডি ভিলিয়ার্সেরা সেই তকমা মুছতে পারেননি। তা ঘোচালেন টেম্বা বাভুমা, এডেন মার্করাম, কাগিসো রাবাদারা। বিশেষ করে বলতে হয় মার্করামের কথা। ১৩৬ রান করে তিনি যখন সাজঘরে ফিরছেন, ততক্ষণে দলের জয় নিশ্চিত হয়ে গেছে।
২৭ বছর পর আরও এক বার আইসিসি ট্রফি জিতল দক্ষিণ আফ্রিকা। নির্বাসন কাটিয়ে ফেরার সাড়ে তিন দশক পর টেস্ট ক্রিকেটের সিংহাসনে বসল তারা। চাপে পড়লেও যা তারা আর ‘চোকার্স’ নন তা দেখালেন বাভুমা, মার্করামেরা। যে অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরে সেই তকমা জুটেছিল, সেই অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়েই তা মুছল।
দ্বিতীয় ইনিংসে কামিন্স, স্টার্ক, হেজেলউডদের তেমন সুযোগ দিলেন না বাভুমা ও মার্করাম। উল্টে যত সময় গড়াল তত কাঁধ ঝুঁলে গেল কামিন্সদের। নইলে কেন এত রক্ষণাত্মক হয়ে পড়লেন অজি অধিনায়ক। যেখানে উইকেট তোলা ছাড়া গতি নেই সেখানে বাউন্ডারিতে ফিল্ডার রাখলেন। বোঝা গেল দক্ষিণ আফ্রিকার জয়ের পথে বিলম্ব করা ছাড়া আর কোনো পরিকল্পনা নেই তার। হার মেনে নিয়েই বোধহয় চতুর্থ দিন খেলতে নেমেছিল অস্ট্রেলিয়া। তাদের শরীরী ভাষা সেটাই বুঝিয়ে দিচ্ছিল। তাই কামিন্স, স্টার্করা একক দক্ষতায় উইকেট তুললেও তাতে দক্ষিণ আফ্রিকার জয় আটকাতে পারলেন না।
দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট ইতিহাস দীর্ঘ দিনের। ব্রিটিশদের হাত ধরে ১৮৮০ সালে সেখানে ক্রিকেট শুরু। ধীরে ধীরে তার বিস্তার। ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার পর তারাই তৃতীয় দেশ যারা টেস্ট খেলেছে। এই দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটে ঝড় বয়ে গিয়েছিল ১৯৭০ সালে। সেই সময় তাদের ক্রিকেটে অ্যাপার্থেইড পলিসি চলছে। কোনো কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটারদের নেওয়া হচ্ছে না। তারই শাস্তি পায় দক্ষিণ আফ্রিকা। ১৯৭০ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত ২১ বছর নির্বাসিত করা হয় তাদের। আইসিসির সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সেই সময়ে দক্ষিণ আফ্রিকা কিছু টেস্ট খেলেছিল বটে, কিন্তু তা স্বীকৃতি পায়নি। অবশেষে ১৯৯১ সালে নতুন পলিসি আনার পরে দক্ষিণ আফ্রিকাকে আবার ক্রিকেট খেলার অনুমতি দেয় আইসিসি। দলে নির্দিষ্ট সংখ্যক কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটার রাখতে হবে, সেই মর্মেই আবার ক্রিকেটে ফেরে তারা।
নির্বাসন কাটিয়ে ফেরার পর ১৯৯২ সালে কলকাতার ইডেন গার্ডেন্সে ভারতের বিরুদ্ধে প্রথম টেস্ট খেলেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। সেই টেস্ট আয়োজনের ক্ষেত্রে তৎকালীন বিসিসিআই সভাপতি জগমোহন ডালমিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান আলি বাখারের ভূমিকা ছিল দেখার মতো। বিশেষ করে ডালমিয়ার উদ্যোগেই হয়েছিল সেই ম্যাচ। কপিল দেবের ভারতের কাছে সেই ম্যাচ হেরেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। তবে দীর্ঘ ২২ বছর পর আবার লাল বলের ক্রিকেটে দেখা যায় প্রোটিয়াদের।
ক্রিকেটে প্রত্যাবর্তনের পরের বছর ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপে প্রথম বার প্রকৃতির কাছে মার খায় দক্ষিণ আফ্রিকা। সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে রান তাড়া করছিল তারা। ফাইনালে উঠতে দরকার ছিল ১৩ বলে ২২ রান। বৃষ্টিতে খেলা বন্ধ হয়। খেলা শুরু হওয়ার পর ডাকওয়ার্থ লুইস নিয়মে লক্ষ্য দাঁড়ায় ১ বলে ২২ রান। হারতে হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকাকে। তার সাত বছর পর প্রথম আইসিসি ট্রফি জেতে দক্ষিণ আফ্রিকা। বাংলাদেশের মাটিতে প্রথম চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ওঠে তাদের হাতে। সেই শেষ। তারপর থেকে শুধু হতাশা জুটেছে তাদের কপালে। ১১টা আইসিসি প্রতিযোগিতার সেমিফাইনাল থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। ১৯৯৯ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে অ্যালান ডোনাল্ডের ‘ব্রেনফেড’ হয়ে রান আউট ক্রিকেটের ইতিহাসে অমর ফ্রেম হয়ে থেকে গেছে।
গত বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জেতার ২৬ বছর পর। সেখানে ভারতের বিরুদ্ধে একটা সময় জেতার মুখে ছিল তারা। ২৪ বলে দরকার ছিল ২৬ রান। সেখান থেকে হারে দক্ষিণ আফ্রিকা। কিছুতেই ফাইনালের গণ্ডি পার হতে পারছিল না তারা। চলতি বছর চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনালে উঠে আবার হারতে হয় তাদের।
দক্ষিণ আফ্রিকার সেই অন্ধকার সময়ে আলোর কিরণ নিয়ে এলেন বাভুমা। ২০১৪ সালে অভিষেক হয় ৫ ফুট ৩ ইঞ্চির বাভুমার। তিন ফরম্যাটে খেললেও ধীরে ধীরে ছোট ফরম্যাট থেকে বাদ পড়েন তিনি। ২০১৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটার হিসেবে টেস্টে শতরান করেন তিনি। ২০২১ সালে কুইন্টন ডি’কককে সরিয়ে ওয়ানডে দলের অধিনায়ক করা হয় বাভুমাকে। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ অধিনায়কও। ২০২৩ সালে টেস্টের অধিনায়কত্বও পান বাভুমা। টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে তার রেকর্ড দেখার মতো। ১০টা টেস্টে অধিনায়কত্ব করে ৯টা জিতেছেন তিনি। একটাও হারেননি। এই ১০টা টেস্টে তার ব্যাটিং গড় প্রায় ৬০। ক্যারিয়ারে মাত্র ৪টা শতরান করলেও তার কত ৭০, ৮০, ৯০ রানের ইনিংস যে দলকে জিতিয়েছে তা মনে রাখার মতো।
বিডি-প্রতিদিন/বাজিত