সেন্টমার্টিন জেটিঘাট থেকে বাজারপাড়ায় ঢুকতেই ডানপাশে দেখা মেলে এক সময়ের জমজমাট দারুচিনি রেস্টুরেন্টের। এখন সেই রেস্টুরেন্ট খালি, ভিতরে চলছে ক্যারম খেলা। স্থানীয়রা প্রতি গেম ১০ টাকায় খেলে সময় কাটাচ্ছেন। এখান থেকেই প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় করে সংসার চালান রেস্টুরেন্টের মালিক সৈয়দ আমিন। তিনি বলেন, ‘চার মাস ধরে হোটেল ব্যবসা বন্ধ। পর্যটক নেই, তাই সবাইকে ছাঁটাই করতে হয়েছে। সংসার তো থেমে থাকবে না, তাই রেস্টুরেন্টের চেয়ার-টেবিল সরিয়ে ক্যারম বোর্ড বসিয়ে কিছুটা আয় করছি।’ জানা যায়, এক সময় প্রতিষ্ঠানটিতে ২০ জনের বেশি কর্মচারী কাজ করতেন, এখন সবাই বেকার। গত মৌসুমে মাত্র দুই মাস ব্যবসার সুযোগ পেয়েছে পর্যটন উদ্যোক্তারা। ফলে দারুচিনির মতো শাহিনা, আল্লাহর দান, ইউরো বাংলা, এশিয়া বাংলা রেস্টুরেন্টসহ অধিকাংশ হোটেল-রেস্তোরাঁয় এখন হাহাকার। ক্যারম খেলার ফাঁকে আকাশ নামের স্থানীয় এক যুবক বলেন, ‘সেন্টমার্টিনের মানুষ এখন খুব কষ্টে আছে। পর্যটক না থাকায় রিকশা, হোটেল, রেস্তোরাঁ কোথাও আয় নেই।’
শাহজাহান নামে একজন বলেন, ‘আগে ব্যবসা করতাম, এখন বড়শি নিয়ে সাগরে যাই। কিন্তু মাছ কিনবে এমন সামর্থ্যবান মানুষও নেই। এভাবে চললে না খেয়ে মরতে হবে।’
কোনারপাড়ার বয়োজ্যেষ্ঠ তৈয়ব উল্লাহ বলেন, ‘এক সময় আমরা গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি পালন করে চলতাম। কিন্তু পর্যটন ব্যবসা শুরু হলে সবাই সেদিকে ঝুঁকে পড়ে। আগে চার মাস ব্যবসা করলে সারা বছর চলে যেত, এখন সরকারিভাবে তিন মাসের বেশি অনুমতি নেই। এতে আমাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে।’
সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য হাবিবুর রহমান জানান, দ্বীপে ৫০টির বেশি রেস্টুরেন্ট ছিল, যেখানে প্রায় দেড় হাজার কর্মচারী কাজ করতেন। এখন সবাই বেকার। প্রায় ৪০০ অটোরিকশাচালকও আয় ও কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। কেউ গরু-ছাগল বিক্রি করছেন, কেউ সোনা বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছেন। তিনি আরও বলেন, গত মৌসুমে নভেম্বর, ডিসেম্বর, জানুয়ারি- এই তিন মাস সেন্টমার্টিনকে পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছিল।
তবে নভেম্বরে রাতযাপনে নিষেধাজ্ঞা থাকায় পর্যটক আসেনি। বাকি দুই মাসের ব্যবসায় বছর চলে না। এ বিষয়ে সরকারের ভেবে দেখা উচিত। হোটেল মালিক রেজাউল করিম বলেন, ‘হোটেলে আগে ১০ জন স্টাফ ছিল, এখন মাত্র একজন আছে। খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছি। এভাবে চললে হোটেলটিও বিক্রি করে দিতে হবে।’ পর্যটন ব্যবসায় ধস নামায় কেউ কেউ দ্বীপ ছেড়ে মূল ভূখণ্ডে পাড়ি জমাচ্ছেন।
আবাসিক হোটেল ব্যবসায়ী জসিমউদ্দীন শুভ টেকনাফ সদরে গিয়ে মুদি দোকান খুলেছেন। তিনি বলেন, ‘সেন্টমার্টিনে আর চলে না, তাই টেকনাফে এসে সংসার চালাচ্ছি।’ সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ফয়জুল ইসলাম জানান, দ্বীপবাসীর কষ্টের কথা প্রশাসনকে জানানো হয়েছে। স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে মিছিল-মানববন্ধন করেও সমাধান আসেনি। তিনি আশাবাদী, নির্বাচিত সরকার এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. সালাহউদ্দিন বলেন, ‘সেন্টমার্টিন দ্বীপ সুরক্ষায় একটি কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। পর্যটক যাতায়াত বন্ধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় বাসিন্দাদের বিকল্প জীবিকার বিষয়টি ভেবে দেখা হচ্ছে।’ সর্বশেষ ২০২৩ সালের ৪ জানুয়ারি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের আওতায় সেন্টমার্টিন সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরের ১ হাজার ৭৪৩ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। দ্বীপের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ২০২০ সালের আগস্টে পর্যটক নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেয় সরকার। সেন্টার ফর জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস) নামক একটি প্রতিষ্ঠানকে সমীক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়। গবেষণায় বলা হয়, সেন্টমার্টিনে পর্যটকদের রাতযাপন অনুমোদনযোগ্য নয়।