শাকিরের হৃদয়ে এক অদ্ভুত টান প্রকৃতির প্রতি। যেখানেই একটু জায়গা পান সেখানেই গাছ লাগান। গাছ লাগানোই তাঁর ধ্যানজ্ঞান। এ জন্য মানুষজন তাকে পাগল বলত। এসব করে কী লাভ? ফল তো খেতে পারবে না। গাছ বাঁচবে না। শুধু শুধু টাকা নষ্ট- এমন অনেক কথাই বলত। সিলেটে বুদ্ধিজীবীদের কবরস্থান ছিল ময়লা, আবর্জনা, জঙ্গলময়। জায়গাটা পরিষ্কার করে সেখানে বেশ কিছু গাছের চারা লাগিয়েছিলেন শাকির। সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনেও তাঁর লাগানো গাছ শোভা বাড়াচ্ছে। সিলেট শহরের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মসজিদ, মন্দির, কবরস্থান, কারাগার, সড়ক বিভাজন কিংবা সড়কের পাশে বৃক্ষরোপণ করেছেন তিনি। তাঁর লাগানো গাছের তালিকায় আছে হরেক রকমের ফলদ, বনজ ও ঔষধি গাছ। নিম, হরীতকী, বহেড়া, নাগেশ্বর, বকুল, দেবদারু, রঙ্গন, শিমুল, রাধাচূড়া, কড়ই, শীল, অর্জুন, কাঠবাদাম, আম, জাম, জামরুল, গোলাপজাম, কাঁঠাল, তালবীজ, পেয়ারা, সফেদাসহ আরও কত কী! শুধু ফল কিংবা ওষুধ নয়, ফুল গাছের প্রতিও তাঁর গভীর অনুরাগ। বাগানবিলাস, হাসনাহেনা, নয়নতারা, অপরাজিতা, জবা, শিউলি, ডালিয়া রঙে আর সৌরভে তিনি ভরিয়ে তোলেন প্রতিটি চত্বর। বিশেষ করে শহরের সড়ক বিভাজনে তিনি পছন্দ করেন ফুলের গাছ। যাতে যানজটের ধকলের মাঝেও চোখে পড়ে একটুখানি শান্তি, একটুখানি প্রাণ। শুধু সরকারি পতিত জায়গায় নয়, ব্যক্তি মানুষকে গাছ লাগাতে সাহায্য করেন শাকির। সিলেটের বাধাঘাটে এক খন্ড জমি পড়ে ছিল। জমির মালিককে জানিয়ে শাকির সেখানে ফল গাছের বাগান করে দিয়ে আসেন। সেখানে আম, কাঁঠাল, লটকন, চালতাসহ প্রচুর ফল হয় এখন। সিলেট শহরের ডিভাইডারগুলোতে রাধাচূড়া গাছ লাগানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। সেখানে বেড়ে ওঠা রাধাচূড়া গাছ থেকে নিয়ে কয়েক হাজার বীজ শাকির বিভিন্ন স্থানে বপন করেন। তিনি কয়েক শ আমের বীজ লাগিয়েছেন। তাঁর লাগানো বীজের সংখ্যা কয়েক হাজার। প্রথমদিকে ফেসবুকে গাছ লাগানোর পোস্টও দিতেন না। পরে এক শুভাকাক্সক্ষী বড় ভাইয়ের পরামর্শে ফেসবুকে গাছ লাগানোর পোস্ট দেন। শাকির জানান, পচে যাওয়া জাম কিনে সেই বীজ তিনি বপন করেন। ছুটির দিন তো বটেই, অন্যদিন ফজরের নামাজের পর শাকির বের হন। গাছ, বীজ রোপণ করে আসেন। সেই গাছ একসময় অনেক বড় হয়। অনেকেই জানেন না এগুলো শাকিরের লাগানো। নিজ হাতে লাগানো গাছগুলো যখন বড় হয়, দেখে ভীষণ ভালো লাগে তাঁর। শাকির যেখানে যান সেখানেই বৃক্ষরোপণের চেষ্টা করেন। তিনি নরসিংন্দী, চাঁদপুর, চট্টগ্রামে গিয়েছেন। সেখানেও নানা রকম বৃক্ষরোপণ করেছেন। এমনকি কুরিয়ার করে নানা জায়গার মানুষকে গাছের চারা উপহার পাঠিয়েছেন তিনি। শাকির ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন সিলেট শাখায় অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাকাউন্ট পদে কর্মরত। তাঁর বাবা রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। বর্তমানে অসুস্থ। মা গৃহিণী। শাকিররা তিন ভাই দুই বোন। সিলেটে তাঁদের কোনো জায়গাজমি নেই। ভাড়া বাড়িতে থাকেন। চাকরি আর টিউশনির কিছু টাকা বাঁচিয়ে রাখেন তিনি। সেই টাকায় বৃক্ষরোপণ করেন। কেউ গাছ লাগানোর জন্য সাহায্য করতে চাইলে শাকির না করেন না। সবার প্রতি শাকিরের একটাই বিনম্র আহ্বান। বৃক্ষরোপণ করুন। তবে শুধু গাছ লাগালেই হবে না, সেই গাছের যত্ন নিতে হবে মমতা ও দায়িত্ববোধে। কারণ, ভালোবাসা আর যতেœই গড়ে ওঠে সবুজের অপূর্ব সমারোহ, যা আমাদের জীবনকে করে তুলতে পারে আরও প্রাণবন্ত, আরও মানবিক।