আজ ২১ নভেম্বর, সশস্ত্র বাহিনী দিবস। যথাযথ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দিবসটি পালিত হচ্ছে। ১৯৭১ সালের এই দিনে আমাদের সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্যসহ তদানীন্তন মুক্তিবাহিনীর সব সদস্যকে এক সমন্বিত পরিকল্পনার অধীনে আনা হয় এবং দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে জল, স্থল ও অন্তরীক্ষে সার্বিক ও ঐক্যবদ্ধ আক্রমণ রচনা করা হয়। জনতার সঙ্গে একাত্ম হয়ে ওই দিন আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর সম্মিলিত অগ্রযাত্রার শুভ সূচনা বিধায় দিনটি জাতীয় ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত।
উল্লেখ্য, ১৯৮২ সাল থেকে সম্মিলিতভাবে ২১ নভেম্বরকে সশস্ত্র বাহিনী দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ২০২৪-এর জুলাই-আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানকালে সশস্ত্র বাহিনী, বিশেষত সেনাবাহিনীর ঐতিহাসিক জনমুখী ভূমিকা এবং বর্তমান গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম ২০২৫ সালের সশস্ত্র বাহিনী দিবসকে নতুন মাত্রা দিয়েছে।
প্রতিবছর বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা ও যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে দিবসটি উদযাপন করা হয়। সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানমালায় অন্যতম প্রধান আকর্ষণ সমরাস্ত্র প্রদর্শনীতে (বর্তমানে এক বছর পর পর অনুষ্ঠিত হয়) প্রচুর জনসমাগম ঘটে। বিভিন্ন স্থানে নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ এই উপলক্ষে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এই অনুষ্ঠানমালায় জনসাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে সৈনিক-জনতার মৈত্রী বন্ধন আরো সুদৃঢ় হয়।
এ ছাড়া দিবসের তাৎপর্য ও সশস্ত্র বাহিনীর বিভিন্ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরে প্রতিবছরই জাতীয় গণমাধ্যমগুলোতে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ এবং বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করা হয়। এতে জনসাধারণ সশস্ত্র বাহিনী সম্পর্কে বিশদভাবে জানার সুযোগ পেয়ে থাকে।
সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অন্যতম আকর্ষণীয় কর্মসূচি ঢাকাসহ বিভিন্ন সেনানিবাস, নৌবাহিনী ঘাঁটি ও বিমানবাহিনী ঘাঁটিতে আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। পাতাঝরা হেমন্তের মনোরম বিকেলে ঢাকা সেনানিবাসের সেনাকুঞ্জ সরকারপ্রধান, মুক্তিযোদ্ধা, সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদসহ দেশি-বিদেশি বিশিষ্ট আমন্ত্রিত অতিথিদের মিলনমেলায় পরিণত হয়। আমন্ত্রিত নাগরিক ও সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের মাঝে অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটে। কবি নির্মলেন্দু গুণ ১৯৯৮ সালের ২১ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনী দিবসের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগদান করেছিলেন। সেনাকুঞ্জের নজরকাড়া নির্মাণশৈলী ও মূল ভবনের সামনে দেয়ালে আঁকা ম্যুরাল চিত্র তাঁকে মুগ্ধ করেছিল।
এই অভিজ্ঞতার ওপর পরবর্তী সময়ে নির্মলেন্দু গুণ ‘সেনাকুঞ্জে কিছুক্ষণ’ নামে একটি বই লেখেন (২০০০ সাল)। কবি বিদায়ের ক্ষণটি বর্ণনা করেছেন এভাবে—‘রাতে ফ্লাড লাইটের আলোয় উদ্ভাসিত সেনাকুঞ্জকে একটি ছোটখাটো তাজমহল বলেই মনে হলো।’ উল্লেখ্য, সেনাকুঞ্জ (বহুমুখী মিলনায়তন ও সিভিল কমপ্লেক্স) নির্মিত হয়েছিল তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান লে. জেনারেল এম আতিকুর রহমানের উদ্যোগে। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এটি ১৯৮৯ সালের ২১ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন।
এই সময় (১৯৮৮-৮৯) ঢাকা সেনানিবাসের ‘কমান্ডার এমইএস’-এর দায়িত্ব পালন করছিলেন তৎকালীন লে. কর্নেল এম মফিজুর রহমান (পরে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল)। সম্প্রতি এক আলাপচারিতায় অত্যন্ত পেশাদার, মেধাবী ও অসামান্য কর্মোদ্যোগী সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম মফিজুর রহমান এই নিবন্ধকারকে জানান কিভাবে তাঁর তত্ত্বাবধানে বহুল আলোচিত এই সেনাকুঞ্জ নির্মিত হয়েছিল।
এবারের সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অন্য রকম গুরুত্ব রয়েছে। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে দেশের ক্রান্তিলগ্নে সেনাবাহিনী তথা সশস্ত্র বাহিনী অসাধারণ ভূমিকা পালন করে দেশকে চরম বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করেছে। ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সব সময় জনগণের সঙ্গে একাত্ম থাকে। ১৯৭১ সালে এই সামরিক বাহিনী মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমেই গড়ে উঠেছিল। বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানকালে আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর গুলির নির্দেশ না দিয়ে জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতি সম্মান দেখিয়েছিলেন। এভাবে সেনাবাহিনী এবারের গণ-অভ্যুত্থানের এক পর্যায়ে পরোক্ষভাবে জনতার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। এটি ছিল বাঁকবদলকারী ঐতিহাসিক এক জনমুখী সিদ্ধান্ত।
গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়েও সশস্ত্র বাহিনী অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছে ও করছে। বিগত সরকারের পতনের পর ২০২৪-এর ৫ আগস্ট থেকেই অস্থিতিশীল রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখার একমাত্র কার্যকর প্রতিষ্ঠান ছিল সশস্ত্র বাহিনী। বেশ বিশৃঙ্খল অবস্থায় সশস্ত্র বাহিনীর উদ্যোগেই অন্তর্বর্তী সরকার যাত্রা শুরু করে। পরবর্তী সময়ে বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলা, শিল্প-কারখানায় নিরাপত্তা বিধান, দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, অস্ত্র উদ্ধার, নাশকতামূলক কার্যক্রম প্রতিরোধসহ সব কার্যক্রমে বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা দিয়ে আসছে। তবে দুঃখজনভাবে, গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে দেশে-বিদেশে একটি পক্ষকে সশস্ত্র বাহিনী, বিশেষত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক অপপ্রচার চালাতে দেখা গেছে। আশা করি, এই পক্ষ এ ধরনের আত্মঘাতী প্রচারণা ও বিদ্বেষমূলক সমালোচনা থেকে সরে আসবে। সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করা নয়, এখন প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য।
বর্তমানে দীর্ঘমেয়াদি এক পরিকল্পনার (ফোর্সেস গোল ২০৩০) মাধ্যমে সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়ন, সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন চলছে। বেশ কিছু অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র ও প্রযুক্তির সংযোজনীর ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছে। ‘ফোর্সেস গোলের’ পূর্ণাঙ্গ পুনর্মূল্যায়নও অপরিহার্য। তবে এর সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন তিন বাহিনীর যৌথতা, সমন্বয়, ব্যাপক যৌথ অনুশীলন ও অস্ত্র সরঞ্জামাদি ক্রয়ে দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত পরিকল্পনা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সশস্ত্র বাহিনীকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে রেখে, কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ না করে সম্পূর্ণ পেশাদারির মাধ্যমে বিকশিত করা।
বর্তমানে বিভিন্ন খাতে সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। একইভাবে নিরাপত্তা-সামরিক খাতেও ব্যাপক সংস্কার-পরিবর্তন করতে হবে। দক্ষিণ এশিয়ায় সম্প্রতি ব্যাপক ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা চলছে। ভারত-পাকিস্তান এখন মুখোমুখি অবস্থানে। এ অঞ্চলে ব্যাপক সামরিকীকরণ চলছে। মায়ানমারের রাখাইনে চলছে জটিল গৃহযুদ্ধ। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সামাজিক মাধ্যমে আশ্চর্য এক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশের অনেক নাগরিক এখন (সোশ্যাল মিডিয়ায়) শক্তিশালী প্রতিরক্ষা বাহিনীর কথা বলছেন। আমাদের প্রতিরক্ষা ভাবনায় এটি একেবারে নতুন দিক।
বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ায় বিভিন্ন শক্তির দ্বন্দ্ব ও ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা, বঙ্গোপসাগরের গুরুত্ব, রোহিঙ্গা সমস্যা, বাংলাদেশ-মায়ানমার সীমান্তে অস্থিরতা, পার্বত্য চট্টগ্রামের অশান্ত পরিস্থিতি, বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান ভূ-রাজনীতিগত গুরুত্ব এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে প্রতিবেশী একটি দেশের বৈরী আচরণ...ইত্যাদি বিবেচনায় বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর শক্তিশালী ও সুসজ্জিতকরণের বিষয়টি যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক। বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীকে অবশ্যই প্রয়োজনীয় ‘ক্রেডিবল ডেটারেন্স’ (যা শক্তিশালী অবস্থান অন্য দেশকে বাংলাদেশ আক্রমণে নিরুৎসাহ করবে) অর্জন করতেই হবে। এটিই দেয়ালের লিখন। একই সঙ্গে আমাদের বাহিনীগুলোকেও বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত ভুলত্রুটি বা সীমাবদ্ধতাগুলো আত্মসমালোচনার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সংশোধন করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।
১৯৭১ সালে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী সম্মিলিত হয়েছিল বাংলার জনগণের সঙ্গে। মুক্তিযোদ্ধা-লেখক-গবেষক মেজর কামরুল হাসান ভুঁইয়া তাঁর বিভিন্ন লেখায় (বিশেষত ‘জনযুদ্ধের গণযোদ্ধা’) দেখিয়েছেন কিভাবে একাত্তরের রণাঙ্গনে পেশাদার সৈনিকরাও হাজারো মুক্তিযোদ্ধা আর জনগণের সঙ্গে একাকার হয়ে মিশে গিয়েছিলেন। দিনটি স্মরণ করিয়ে দেয় যে দেশের স্বাধীনতা, ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষার জন্য শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনী গড়া প্রয়োজন। মনে করিয়ে দেয় তিন বাহিনীর যৌথতা, সমন্বয়, ভ্রাতৃত্ববোধ ও একাত্মতার কথা। প্রতিবার দিবসটি আমাদের পুনরুত্থানের পরম লগ্ন হিসেবে আবির্ভূত হয় এবং জাতির স্বাধীনতার জন্য আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য ও জনতার চরম ত্যাগ-তিতিক্ষার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এটি আমাদের অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে সেতুবন্ধ।
বাংলাদেশের প্রয়োজন একটি পেশাদার, আত্মনির্ভর ও কৌশলগতভাবে স্বাধীন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর মতো, আগামী দিনেও মাতৃভূমির অখণ্ডতা রক্ষা তথা জাতীয় যেকোনো প্রয়োজনে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে সদাপ্রস্তুত থাকবে। এই হোক নতুন আলোয় এবারের সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অঙ্গীকার।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, গবেষক ও বিশ্লেষক
বিডি প্রতিদিন/নাজিম