বিগত দেড় দশকে ফ্যাসিবাদী শাসনামলে প্রায় ২১ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন হলেও পাচারের ১ টাকাও উদ্ধার করতে পারেনি সরকার। নানান পদক্ষেপের কথা বলা হলেও বাস্তবে কোনো টাকা আসেনি দেশে। উদ্ধারের জন্য টাস্কফোর্স গঠন, বিদেশভ্রমণ, বিদেশে মামলা করার কথা জানানো হয়েছে। ব্যাংকিং চ্যানেল ও বিদেশি হ্যাভেন ব্যবহার করে পাচার করা কোটি কোটি ডলার দেশের বাইরেই রয়ে গেছে। পাচারের গন্তব্য দেশসমূহের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও অনেক দেশ বাংলাদেশের অনুরোধে কোনো সাড়া দেয়নি। একমাত্র ব্যতিক্রম হিসেবে যুক্তরাজ্য সরকার সেখানে পাচার হওয়া সম্পদের মালিক বাংলাদেশের এক সাবেক মন্ত্রীর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করেছে। এমনকি কোথায় বা কোন দেশে টাকা আছে সেটাই সরকার এখন পর্যন্ত শনাক্ত করে নিশ্চিত হতে পারেনি। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) গত বছর অর্থ পাচারসহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরে ৪৯ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন দাখিল করে আদালতে। ওই প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, হংকং, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, ভারত, শ্রীলঙ্কা, কুয়েত, বেলজিয়াম, তানজানিয়ায় বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের কথা রয়েছে। ১৫ বছরে ব্যাংকিং খাত থেকে প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা লুট করা হয়েছে। এস আলম, নাসাসহ কয়েকটি গ্রুপের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছিল ব্যাংক। এসব গ্রুপসহ শীর্ষ কয়েক ব্যবসায়ী ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে বিদেশে পাচার করেছেন। পাচার করা হয়েছে ২১ লাখ কোটি টাকার বেশি। গত বছর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর লুট ও পাচার হওয়া অর্থ ফেরানোর ব্যাপারে বাংলাদেশ উদ্যোগ গ্রহণ করে। পাচার অর্থ উদ্ধারের উদ্দেশ্য নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর গত এক বছরে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ সফর করেন। সেসব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে কথা বলেছেন তিনি। তবে পাচারের টাকা কীভাবে ফিরিয়ে আনা যাবে, কিংবা ব্যাংক থেকে লুট হওয়া টাকা কীভাবে উদ্ধার হবে, এখন পর্যন্ত তার কোনো কূলকিনারা করা যায়নি।
পাচারের অর্থ ফেরত আনার লক্ষ্যে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। সভাপতিসহ নয়জনের এ টাস্কফোর্সে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, আইন ও বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) থেকে একজন করে উপযুক্ত প্রতিনিধি নির্ধারণ করা হয়। এ টাস্কফোর্সের মূল কাজ করার কথা বিএফআইইউয়ের। কিন্তু বর্তমানে বিএফআইইউর প্রধানকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে যৌন কেলেঙ্কারির ঘটনায়। এরপর নতুন কাউকে নিয়োগ দেয়নি সরকার। দৃশ্যত বিএফআইইউপ্রধান না থাকায় কোনো কাজ হচ্ছে না। তবে টাস্কফোর্সের দৃশ্যমান কার্যক্রম বলতে দুদক কয়েকটি ঘটনার বিষয়ে তদন্ত করছে। এর মধ্যে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী যুক্তরাজ্যে, এস আলম গ্রুপের কর্ণধার মোহাম্মদ সাইফুল আলম সিঙ্গাপুরে, আওয়ামী লীগ নেতা মো. আবদুস সোবাহান গোলাপ যুক্তরাষ্ট্রে, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বেলজিয়ামে এবং আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম কানাডায় অর্থ পাচার করেছেন বলে দুদকের তদন্তে বলা হয়েছে। দুদকের তদন্তে যা কিছু পাওয়া যাক না কেন, তাতে দেশে কোনো টাকা আসার সম্ভাবনা নেই।
গত মাসের শুরুতে কয়েকটি বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর নামে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে ১২টি আন্তর্জাতিক সম্পদ পুনরুদ্ধার ও ল ফার্মের সঙ্গে নন-ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট (এনডিএ) করতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর এ নির্দেশনা দেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক সভায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের উপস্থিতিতে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়। তবে নির্দেশনার পর কোনো ব্যাংক এখন পর্যন্ত এ-জাতীয় কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করতে পারেনি। তবে একটি ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, চুক্তি করার বিষয়ে আলোচনা চলছে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে।
লুট ও পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ : আওয়ামী লীগ শাসনামলে খেলাপি ঋণ ২২ হাজার ৪৮২ কোটি থেকে বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি। তবে দেশ থেকে ঠিক কী পরিমাণ টাকা পাচার হয়েছে, তার সঠিক হিসাব নেই। বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে ধারণা করা যায়, বিগত ১৫ বছরে দেশ থেকে পাচার হয়েছে ১৮০ বিলিয়ন ডলার, টাকার অঙ্কে যা ২১ লাখ কোটির বেশি। ব্যাংকিং চ্যানেল, হুন্ডি, আমদানি-রপ্তানি, বন্ড সুবিধার আড়ালে এ টাকা পাচার করা হয়। এর মধ্যে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে বিদেশে পাঠানো হয়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ। একই সময় খেলাপি ঋণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংক গ্রাহক ও ম্যানেজমেন্ট স্তরে বন্ড সুবিধা, বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ বিদেশে নেওয়ার পথ তৈরি হয়েছে।
জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘পাচারের টাকা ফেরত এই সময়ের মধ্যে আনা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। যারা বলছেন কালই এনে ফেলবেন, এসব কথা কোনোভাবেই বাস্তবসম্মত নয়। টাকা কোথায় গেছে সেটাই শনাক্ত করতে পারছেন কি না বড় প্রশ্ন। সারা পৃথিবীতে প্রতি বছর প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলার পাচার হয়। আর উদ্ধারের পরিমাণ তার মাত্র ১ শতাংশ। তার মানে বাংলাদেশ থেকে যদি ২১ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়, তার ১ শতাংশ উদ্ধার হতে পারে। তবে সেটা যে পদ্ধতিতে উদ্ধার করা সম্ভব, সেটা হচ্ছে কি না বলা যাচ্ছে না। টাকা উদ্ধারে নয়টি সংস্থা নিয়ে টাস্কফোর্স করা হয়েছে।
তারা একটি মিটিংই তো করতে পারবে না। সব সংস্থা একসঙ্গে সময় বের করতে পারবে না। বর্তমানে বিএফআইউতে কোনো প্রধান নেই। সেটা চলছে কীভাবে কেউ জানে না। টাকা উদ্ধারের জন্য যে পদক্ষেপ নিক না কেন, এটা অনেক সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আশা নিয়ে কোনো কাজ হবে না।’