গতকাল সন্ধ্যায় ডালে ফোঁড়ন দিয়ে কেবল চুলার কাছ থেকে সরে এসেছে, তখনই খবরটা পেয়েছিল নিসা। অপ্রত্যাশিত খবর নয়, তারপরও শোনার পর থেকেই মনের ভিতরে ধুপধাপ, দিরিম দিরিম। কোনো কাজেই মন বসাতে পারছে না। পাখির কিচিরমিচিরসহ বেড়ালের মিউ ডাকেও চমকে উঠছে। বেড়ালটাও এমন দুষ্টু, বুঝতে পেরেই, একটু পরপরই মিউ মিউ! প্রথম দিনের ফোনে ত্রিশ-বত্রিশ বছরের জীবনে এটি তার জন্য একেবারে অন্যরকম বিস্ময় ছিল। ফোনের জায়গাটায় পৌঁছে দিয়েছিল যে ছেলেটি তাকে গ্রামে আগে দু’একবার দেখেছিল মাত্র। কথাও হয়েছিল ঐ তেমনই, যেমনটি হয়ে থাকে গ্রামের আর দশটি বাড়ির কোনো একজনের সাথে। তুমি কী কর? মানে কাম-কাজ? ছেলেটি সম্পর্কে সামান্যই কিছু জানা ছিল বলেই সাহস পেয়েছিল সে। ছেলেটি খুবই কুণ্ঠিত চেহারা নিয়ে নিসার উঠোনে এসে কথাটা বলেছিল।
তার বিস্মিত চোখ দেখে তিনি বলেছিলেন, তোমার এই অবাক করা চোখ দুটোই ক্লাসিক। ‘ক্লাসিক’ শব্দের ঘেরাটোপে না ডুবেও নিসা সামনের মানুষটির দিকে বোকার মতো চেয়ে থেকে অনুমান করে নিয়েছিল ক্লাসিক শব্দটির অর্থ সাধারণ নয়। ভার আছে। মানুষটিকেও তার ভারহীন মনে হয়নি।
ঝড় ওঠার লক্ষণ দেখেও বাসা থেকে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিল নিসা। উপায় নেই। কথা দিয়েছে। একটু আগেও কচি কলাপাতা রংয়ের রোদে প্রজাপতি আর ফড়িংয়ের লাফালাফি দেখেছে সে। কিছু মাছিও ছিল আশপাশে। বেলা পড়ে যাওয়ার আগের রোদ যেমন হয়, মিষ্টি মিষ্টি। গা ডুবিয়ে বসে থাকার মতো। আজ তৃতীয় দিন। দ্বিতীয় দিনে পুরো বিষয়ের কিছুটা বুঝে খানিকটা ধাতস্থ হয়েছিল। বোঝার চেষ্টা করার সুযোগ পেয়েছিল।
উঠোনের মুরগিগুলোর কক কক শব্দে ও ছুটোছুটির ভাও দেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে যা বোঝার বুঝে গেলে সব গুছিয়ে নিল নিসা। পরনের শাড়িটাও। ওই, মুরগিগুলোকে খুপরির ভিতর ঢোকানো, ছোট্ট মাটি ও টিনের ঘরটির একমাত্র জানালা লাগানোসহ কিছু টুকিটাকি কাজ। নিজেকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে একটু পাউডারের প্রলেপ, পেনসিলের কাজল। শত কষ্টেও অভ্যাস! প্রথম দিন হালকাভাবে একটু লিপিস্টিক লাগিয়েছিল। একটা লিপিস্টিক ছিল বহু আগের, যত্ন করে তুলে রাখা, তাই মাঝে মাঝে একটু ঘষে নেয়। তিনি নিষেধ করাতে আর দেয়নি। বলেছিলেন, এসবের প্রয়োজন নেই তোমার। তোমার সৌন্দর্য সম্পর্কে আসলে তোমার ধারণাই নেই। আমি তোমাকে প্রথম দিন দেখেছিলাম একটি সালিশে দাঁড়িয়ে কোমরে ওড়না পেঁচাতে। এখনো চোখে লেগে আছে।
সলিমুদ্দিন দু’একদিন তার চুলের প্রশংসা করার চেষ্টা করলেও তেমন গুরুত্ব দেয়নি নিসা। মাছের মতো নিষ্প্রাণ চোখের প্রশংসায় তার কোনো ভাব আসেনি। কেটে রাখা গাছের গুঁড়ির মতো মনে হয়েছিল। এমনিতে কামিজ ইত্যাদি দিয়েই চালিয়ে নেয় সে। জায়গা ভেদে শাড়ি। সমস্যা হয় না। সেই অভ্যাসও আছে। কোথাও বের হওয়ার আগে দুকাঠার মতো জায়গাটির শেষ কোনায় শিম, লাউ ইত্যাদির মাচায় চোখ বুলিয়ে নেওয়া অভ্যাস। তাকিয়ে মুহূর্তেই গুনে নেয় কয়টি লাউ বা চাল কুমড়ো ঝুলছে। আজকেই কাটতে হবে নাকি দুদিন পরে কাটলেও চলবে। হিসাব রাখতে হয়। শিম বরবটি গোনা না গেলেও আন্দাজে বুঝতে পারে কোন দিন কত টাকায় বেচা যেতে পারে। না, সে কারও হাতে দিয়ে বেচায় না, নিজে বাজার দর যাচাই করে বেচে আসে। বেচাবেচির বিষয়টি সব সময়ই নিজের হাতে রাখে। কারও ওপর ভরসা করে না। অনেক সময় বাড়ির উঠোন থেকেই বেচা হয়ে যায়। তাই যেখানেই যাক, বের হওয়ার আগে মাচার দিকে তীব্র দৃষ্টি বুলিয়ে নেওয়া তার অভ্যাস। প্রায় সব পুরুষেরই চোখ প্রথমে তার বুকের দিকে, পরে মুখের দিকে দেখে। যেন বুকের দিকে তাকানোই তাদের অভ্যাস! চোখ যাবেই। উপাসনার মতো! নিসার উপাসনা হলো যখন যা পারে মাটিতে পুঁতে দিয়ে মাচায় উঠিয়ে দেওয়া। লাউ, শিম, বরবটি, চালকুমড়ো যখন যা হয়। মাটি আর মাচা, এই দুটোই তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। অনেক সময় নিজেকেও মাচায় ঝুলে থাকা চালকুমড়ো, লাউ, বরবটির গাছ মনে হয় তার। অত ছোট মাচায় দুই পদের বেশি লাগানো যায় না বলে কখনো ফেলে রাখে না। মাচা সব সময়ের জন্য সবুজই থাকে। মাচা সবুজ থাকলে তার মনও সতেজ থাকে। যে সবজিই লাগাক না কেন, প্রচুর ফলন হয়। প্রথম প্রথম হতো না। বাবার বাসায় মরিচ মসলায় সামান্য লবণ মিশিয়ে বাটতে শিখলেও ফুলের পরাগায়ণ বা কীভাবে মাটির ফলন ভালো হয়, শেখার সুযোগ হয়নি। এখন সবই শিখেছে। পিঁপড়া বা কেঁচোর হাত থেকে, মুরগির খুটাখুটি থেকে কীভাবে গাছগুলো রক্ষা করতে হয় সবই শিখে নিয়েছে। এর জন্য কারও কাছে তাকে যেতে হয়নি, দিনের পর দিন মাটির কাছে লেপ্টে বসে থেকে শিখেছে। মাটি ঘেঁটে শিখেছে। শিখেছে বলেই এখন যা কিছু ফলন হয়, দু’একটি একে ওকে দিয়ে থুয়ে, একা মানুষ খেয়ে বাজারে বিক্রি করে তেল লবণ ইত্যাদির খরচ দিব্বি উঠে আসে।
খুব চেষ্টা করেছিল এই জায়গা থেকে তাকে উৎখাত করার। পারেনি।
আপনি কে, আমাকে চলে যেতে বলার? মুখের কথার কোনো দাম নাই জানেন না! কাগজ আর দখলই সব। বলেছিল সে।
প্রচণ্ড মনোবল আর দৃঢ়চেতা মানুষ হিসেবে নিজেকে তৈরি করতে প্রকৃতি ও পরিস্থিতিই তাকে সাহায্য করেছে। চড়াই উতরাইয়ের এই পথ চলায় তাই কাউকেই সে এখন গোনে না। গ্রামের চেয়ারম্যান হোক কিংবা পাতিনেতা। ঐসব পাতিনেতা আর চেয়ারম্যানদের সাথে পাল্লা দিয়ে সেও কৌশল বদলাতে জানে এখন। কারণ সবগুলোর চোখের পাতা আর শরীর মোচড়ানোর ভাব ভাষা তার পড়া হয়ে গেছে। প্রাইমারি স্কুলে ‘আম পড়ে পাতা নড়ে’র চেয়েও ভালোভাবে চোখের পাতা নড়া পড়তে পারে। ভ্যাদভ্যাদ কান্দুনি আর অসহায় ভাব দেখানো নারী নয় সে। কাউকে পোছে না টাইপের নারী! গুলুগুলু টাইপের কোনো নারী দেখলে দুইটা সাটাম সাটাম চড় কষাতে ইচ্ছা করে তার। সমাজের চোখে সুবিধের নারী নয় সে, জানে। চোখে কিছু না দেখলেও, প্রমাণ সাক্ষী হাজির করতে না পারলেও, নানান রসের কাহিনি তৈরি হয়ে যায় তাকে নিয়ে। এসব আরও পোছে না নিসা। সামনাসামনি কাউকে মোকাবিলা করতে হলে ঝপাৎ করে ওড়না কিংবা শাড়ির আঁচল পেছন থেকে টেনে সামনে কষে বেঁধে সোজা হয়ে দাঁড়ানো নারী সে। গত কয়েক বছরে এরকম পরিস্থিতির সামনাসামনি হতে হতে কিছু কৌশল মাথায় ফুলের মতো গুঁজে নিয়েছে। যেমন, মুখের ভাঁজ আর গলার স্বর দুটোর সংমিশ্রণে এমন একটি ভাব ফুটিয়ে তোলা, যাতে প্রাথমিক স্তরেই তাকে ‘মুখরা’ ভাবতে পারে। আদতে সে ততটা মুখরা নয়! সাথে হাতের তামার চুড়ি দুটোকে টেনে ওপরের দিকে উঠিয়ে মুঠি করে ‘কেন ডাকছেন’ প্রশ্ন শুনে অনেকের চেহারা হয় লাল মরিচের মতো।
হোয়াই, বলেন, কেন ডাকা হয়েছে?
হোয়াই! শুনেই সালিশের অনেকের চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আবার ঢুকে যায়! প্রশ্ন করার তার এই স্টাইল দেখার জন্যও, সালিশের আয়োজন হলেই ছেলে-ছোকরারা চলতিপথে হল্লা ছেড়ে দু’পা ক্রস করে দাঁড়িয়ে যায়। দূর থেকেও ফ্রিতে মজা দেখতে আসে অনেকে। অপেক্ষা করে নিসার সাহসী আর ‘বেয়াদপী’ চেহারা দেখার জন্য! চোখ আর নাকের পাটার আগুন দেখার জন্য। বুড়োগুলো ‘বেয়াদপী’ই বলে। মুখের ওপরই বলে। আর ছেলেগুলোর চোখে মাঠের শেষ প্রান্ত থেকে বাতাস ঠেলে পাঁচশ বছর কী তারও আগের এসে দাঁড়ানো কোনো এক লড়াকু নারী সে! কোমর থেকে এক্ষুনি চকচকে তলোয়ার বের করে সামনে পেছনে পা রেখে হিসহিসিয়ে উঠে বলবে, হুঁশিয়ার! আঠারো থেকে পঁচিশ বৎসরের শুধু নয়, চল্লিশ বছরেরও অনেকেই সালিশে ভিড় করে। চল্লিশগুলোর কিছু বলার জন্য মুখ সুড়সুড় করলেও আঠারোরগুলোর জন্য মুখ বন্ধ রাখে।
না, নিসার সাথে আঠারো বা পঁচিশগুলোর এখনো কোনো বিরোধ তৈরি হয়নি। হতে পারতো। ছেলে মেয়েতে অযথাই যে একটা লুকোচুরির ব্যাপার থাকে সেটা প্রথম থেকেই নিসা চাটি মেরে উড়িয়ে দিয়েছে। প্রেম পিরীতি বা বেলাল্লাপনা করার লক্ষণও ফুরফুর করতে দেখেনি কেউ। তার বদলে আসতে যেতে দেখা হলে বেশ সমঝোতা টাইপের কিছু একটা আছে বলে মনে হবে, কিছুটা মায়াও হয়তো। গ্রামের সালিশ আয়োজকদের অহেতুক মাতবরীকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পাশ কাটানোতে তারা এখনো তেমন পটু হয়ে ওঠেনি, সেই বয়সও হয়নি তাদের। তাই নিসার আগুন চোখ তাদের ভিরু মনকে উসকে দিতে সাহায্য করে বলে প্রয়োজনে নিসার পাশাপাশি হাঁটতে অপছন্দ করে না তারা। কথার মাঝে নিসার ‘হোয়াই, বাট’ ইংরেজি বলাতেও কৌতূহলসহ শ্রদ্ধাও থাকে। এরকমটা এই গ্রামে অন্তত কেউ শোনেনি এখনো। সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করা নিসার আরও পড়ার ইচ্ছে থাকলেও সম্ভব হয়নি দরিদ্র বাবা-মার জন্য। জুয়ারু মালেকের সাথে বিয়ে হয়ে জীবন কাদার ভিতর আটকে গিয়েছিল। সেই কাদা পেরিয়ে এক বছরের শিশু সন্তানটিকে ফেলেই মালেকের ঘর ছেড়ে পালিয়ে এসেছিল। শুনেছে সবাই।
কী করতাম? পালায় না আসলে আরেকটা বাচ্চার জন্ম দিতাম? বাচ্চা জন্ম দিলেই হবে শুধু?
শিশুটিকে ফেলে আসায় নানারকম গঞ্জনার ভিতর যেতে হলেও শক্ত অবস্থান নিতে হয়েছিল। সন্তান ফেলে দরিদ্র পিতার বাড়িতে ফিরে এসে আনন্দে নাচানাচির জীবন ছিল না। চরম অবহেলা ও অযত্নের ছিল। ভ্রুকটি আর অবহেলার মারপ্যাঁচে থাকতে থাকতে এক সন্ধ্যায় এক বসাতেই আবার নিসার বিয়ে হয়ে গেল সমিরের বাবা সলিমুদ্দির সাথে।
সলিমুদ্দিকে দেখলে ভাব ভালোবাসা দূরের কথা, কথা বলাতেও আগ্রহ হতো না। শুধু ভাত ও একটি ঘরের নিশ্চয়তার জন্য মুখ বুজে সব মেনে নিয়েছিল সে। তেইশ চব্বিশ বছরের যুবক সমির তখন চৌদ্দ কী পনেরো বছরের। সলিমুদ্দির সাথে রসের সম্পর্ক তৈরি না হলেও সমিরের সাথে বেশ বন্ধুত্ব তৈরি করতে পেরেছিল নিসা, যা গ্রামের লোকজনের চোখে খুব আরামদায়ক ছিল না। চোখ খচখচ করত। পেট পাতলা হয়ে যাওয়ার সমস্যাতেও পড়ত অনেকে! শোনা কথা।
সলিমুদ্দি, তোমহার বেটার সাথে বউটার এত খাতির কেনে? শুনছি খুব হাসি হাসি কথা কহে।
হাঁপানির রোগসহ আরও কী কী সব সমস্যা নিয়ে নিসার সাথে বিয়ে হওয়ার দুই বছরের মাথায় সমিরের বাবার মৃত্যু হলে ভেঙে পড়েনি নিসা। বিয়ে বিষয়টি ততদিনে সারা দিন খুঁটে খুঁটে খেয়ে সন্ধ্যায় মুরগির খোঁয়াড়ে ঢোকার মতোই স্বাভাবিক মনে হয়েছিল। খাওয়া-পরা নিয়ে পুনরায় সংকটে পড়লেও নিজেকে অসহায় লাগেনি বরং এক ধরনের মুক্তি অনুভব করেছিল। ভেসে যাওয়া কচুরিপানার মতো মনে হলেও জলস্রোত আর খোলা আকাশের আলো আঁকড়ে ধরে নিঃশ্বাস নিতে পেরেছিল নিসা। আসলে সমিরকে সে ঠিক সৎ ছেলের মতো না দেখে প্রথম থেকেই মাতৃত্ব ও বোনের নরম চোখে দেখেছিল। বয়সে খুব বেশি ছোট নয় বলেই হয়তো তা সম্ভব হয়েছিল। এই দৃষ্টিভঙ্গিতেই বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছিল। সমির তার জীবনে দখিনা হাওয়ার মতো।
এ কারণেই সমিরের চাচা, যিনি পাশাপাশিই থাকেন, নানারকম চক্রান্ত করেছিল নিসাকে তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু লাভ হয়নি।
-ওর এইঠে কাম কী? ছাওয়াল পাওয়াল নাই, থাকিলে না হয় কথা ছিল। বাপের বাড়ি যাক, বিয়া বসুক আর একটা।
-না। ছোট মায়ের যতদিন থাকিবার মন চায় থাকিবে। বাবা কহি গেছে।
পাশাপাশি উঠোনে বেড়া দিয়ে একটা সীমারেখা আগে থেকেই করা থাকলেও সমিরের বাবাই মৃত্যুর আগে কিংবা বিয়ের সময়ই সম্ভবত নিসার থাকার বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন বলে রক্ষা। সমীরের নিরীহ বউটিও মৃদু স্বরে সমিরকে সমর্থন করেছিল। সেদিন খুব অবাক চোখে বউটির দিকে তাকিয়েছিল নিসা। দুই বছরের মতো হয়েছে মেয়েটির বিয়ে হয়ে এই বাড়িতে আসা, এর মাঝে একদিনও কোনো মনোমালিন্য হয়নি তার সাথে। খুব যে কথা বলাবলি হয় তাও নয়, চুপচাপই থাকে মেয়েটি। সেই মেয়েই যখন কথাগুলো মৃদুস্বরে বলল অদ্ভুত এক আলো এসে পড়েছিল উঠোনে।
বের হয়ে রাস্তায় নেমে চার কদম হাঁটার পরই আকাশের কালচে ভাবটা সরে ঝিম ধরা ভাব এলে মনে স্বস্তি পেল নিসা। বৃষ্টি যে শেষ পর্যন্ত আসবে না আগেই মনে হয়েছিল তার। আঁচল টেনে ধীর পায়ে এগোল সে। রাস্তার শেষ মাথায়, যেখান থেকে আর কোনো দিকে যাওয়া যায় না, গাছপালা ঘেরা, অনেকটা জঙ্গলের মতো জায়গাটিতেই ছোট্ট একতলা বাড়িটিই তার গন্তব্য।
-আমি ভেবেছিলাম এই ওয়েদারে তুমি আসতে পারবে না। বাহ, বেশ লাগছে তোমাকে। বস ওখানে। জিরিয়ে নাও। হাঁপাচ্ছ। গতকাল যেভাবে দাঁড়িয়েছিলে ঠিক ওভাবেই দাঁড়িয়ে থাকবে, নড়বে না। আঁচলটা কোমরে জড়িয়ে নাও। নড়ার প্রয়োজন হলে আমাকে বলবে। আমি কাজ বন্ধ রাখব।
অসমাপ্ত মাটির মূর্তিটির সামনে দাঁড়িয়ে খুব অবাক চোখে দেখল নিসা। কোমরে আঁচল জড়াচ্ছে। একেবারে নিখুঁত। সামান্য মাটি মাখানো হাতে মূর্তির বুকের ডান পাশের আঁচলে দাগ কাটতে কাটতে তিনি বললেন,
এরপরে তোমার চোখে ফিনিশিং টাচ। এটিই সবচেয়ে কঠিন কাজ, সবার শেষে রং হবে। সে আমি করে নেব। তোমাকে আসতে হবে না। তোমার পেমেন্ট আজই বুঝিয়ে দেব।
শেষের কথাগুলো আর তেমন শোনা হয় না নিসার। শরীরে বাতাসের ধাক্কায় সে মাটি ছেড়ে ওপরে উঠতে লাগল। শরীর তেমন হালকা মনে না হলেও ভেসে বেড়ালো ঘরের এ কোনায়, ও কোনায়। অনেকক্ষণ। ভাসতে ভাসতেই গভীর করে তাকালো মানুষটির দিকে। মানুষটির আঙুলের দিকে। খুব ইচ্ছে হলো মাটির মূর্তিতে নয়, সরাসরি তার বুকের আঁচল ঠিক করে দিক মানুষটি। তাকে ছুঁয়ে দিক। এই প্রথম এরকম তীব্র চাওয়া জেগে ওঠাতে বিব্রত বোধ করলেও মনে হলো, তার ক্লাসিক চোখেও যদি তিনি আলতো ঠোঁট ছোঁয়াতে চান, তাকে স্পর্শ করতে চান, সে না করবে না।