ফ্যাসিস্ট হটানোর অবদান শুধু অস্বীকার নয়, পরস্পরকে কদাকার ভাষায় আক্রমণের এক প্রতিযোগিতা চলছে ফ্যাসিস্টবিরোধীদের মধ্যেই। পরস্পরকে ছোট ও তাচ্ছিল্য করার এক দুর্নিবার চেষ্টা সেই আন্দোলনের শরিকজনদের মধ্যে। খাওয়া পাতে মুখ মুছে ফেলার প্রবণতা। অথচ জীবন বাজি রেখে ছাত্র, জনতা, সেনার রসায়নে ফ্যাসিস্ট হটানোর সেই ঘটনাগুলো এইতো সেদিনের কথা। স্বজন হারানো পরিবারগুলো কী বেদনা সইছে? আহত-পঙ্গুদের কী কাতরানি? তা মনে করিয়ে দেওয়ার বিষয় নয়। চোখ মেললেই দেখা যায়। নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় প্রতিযোগিতা হতে পারত ওই সংগ্রামে কার কত বেশি অবদান তা নিয়ে। কিন্তু তা হচ্ছে যত অবান্তর বিষয় নিয়ে। তাদের মাঝে কখনো ভাগাভাগি, কখনো রাগারাগি। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের বদলে ব্যাটল ফিল্ড তৈরির নমুনা।
অভিযোগের তীর সরকারের দিকেও। কারো অভিযোগ, সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা বিএনপির দিকে হেলে পড়েছেন। কারো অভিযোগ, তাঁরা জামায়াতের হয়ে কাজ করছেন। এনসিপির চাওয়া বাস্তবায়ন করছেন। সেনাবাহিনীর মর্জিমতো চলছেন। হরেক অভিযোগের মাঝে এনসিপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের দাবি, প্রশাসনের কর্মকর্তারা কাজ করছেন বিএনপি ও জামায়াতের হয়ে। প্রশাসনের বদলি, পদোন্নতি ও পদায়নের মতো বিষয়গুলো জামায়াতের রাজনৈতিক বিবেচনায় করা হচ্ছে। এ যেন এক আচানক, দুঃখজনক রিয়ালিটি শো।
এসব অভিযোগ নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার দরজায় লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন বিভিন্ন দলের নেতারা। যেন স্কুলে শিক্ষকের কাছে অভিযোগ করতে যাওয়া ছাত্র-ছাত্রীর দল। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সবাই অভিযোগ করছে, কিন্তু কেউ নাম বলছে না! বিএনপি প্রধান উপদেষ্টাকে নাকি নাম বলেছে, কিন্তু জনসমক্ষে বলছে না। জামায়াতের নায়েবে আমির বলেছেন, ‘কণ্ঠ রেকর্ড করা আছে।’ উপদেষ্টা মাহফুজ আলমও কয়েক দিন আগে কারো নাম উল্লেখ না করে বলেছিলেন, বিএনপি-জামায়াত কিভাবে সচিব, ডিসি, ভিসি ভাগাভাগি করে নিয়েছিল।
এবার তিনি ফাটালেন আরেক বিস্ফোরক বোমা। তথ্য উপদেষ্টা হিসেবে দিলেন মারাত্মক তথ্য। জানালেন, নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলো সংঘাতের জন্য মুখিয়ে আছে। সত্যিই ভয়ংকর দুঃসংবাদ। নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলো সংঘাতের জন্য মুখিয়ে রয়েছে মন্তব্য করে মাহফুজ আলম বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টার অবস্থানের কারণে এখন পর্যন্ত তারা সংঘাতে জড়াচ্ছে না। তাঁর ভাষায় : সবাই সংঘাতের জন্য মুখিয়ে আছে এবং আপনারা অবশ্যই এটা অল্প কয়েক মাসের মধ্যে দেখতে পাবেন এবং আশঙ্কা করছি, এটার সঙ্গে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ যুক্ত হলে বাংলাদেশের পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে। গোপনে বা ক্লোজ ডোরে নয়, শনিবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় বিএমএ ভবনে ‘মাজার সংস্কৃতি : সহিংসতা, সংকট ও ভবিষ্যৎ ভাবনা’ শীর্ষক জাতীয় সংলাপে এ কথা বলেন মাহফুজ আলম।
রাজনৈতিক বাস্তবতা, বিভিন্ন দলের অভিযোগ-পাল্টা-অভিযোগ, প্রশাসনের হাল এবং তথ্য উপদেষ্টার দেওয়া তথ্য অবশ্যই আমলে নিতে হয়। স্মরণ করতে হয় গত বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের সেই সতর্কতা ও আহবান। কাদা-ছোড়াছুড়ি বন্ধ না করলে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়তে পারে বলে সতর্ক করেছিলেন তিনি। সঙ্গে এও বলেছিলেন, ‘আমি আপনাদের সতর্ক করে দিচ্ছি, পরে বলবেন যে আমি সতর্ক করিনি, আমি আপনাদের সতর্ক করে দিচ্ছি, আপনারা যদি নিজেদের মধ্যে ভেদাভেদ ভুলে একসঙ্গে কাজ না করতে পারেন, নিজেরা যদি কাদা-ছোড়াছুড়ি করেন, মারামারি-কাটাকাটি করেন, এই দেশ ও জাতির স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে। আমি আজকে বলে দিলাম, নইলে আপনারা বলবেন যে আমি আপনাদের সতর্ক করিনি। আমার অন্য কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই, আমার একটাই আকাঙ্ক্ষা, দেশ ও জাতিটাকে একটা সুন্দর জায়গায় রেখে ছুটি করা। আই হ্যাড এনাফ লাস্ট সেভেন-এইট মান্থস, আই হ্যাড এনাফ। আমি চাই, দেশ ও জাতিকে একটা সুন্দর জায়গায় রেখে আমরা সেনানিবাসে ফেরত আসব।’
ওই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সেনাবাহিনী ও সেনাপ্রধানের অবস্থান পরিষ্কার। সামনে নির্বাচন। মানুষ ভোট দিতে উদ্গ্রীব। ব্যবসায়ী-বিনিয়োগকারীরা উম্মুখ হয়ে আছেন একটি নির্বাচিত, স্টেবল সরকারের জন্য। এ সময় ভাবনার বিষয় হওয়া উচিত কত সুন্দর চমৎকার একটি নির্বাচন করা যায়। সেনাবাহিনী আগামী নির্বাচনে গুরুত্বের সঙ্গে যুক্ত থাকবে, সেই আশাবাদও দেখা দিয়েছে। কিন্তু এমন একটি সময়ে বিষোদ্গার লিস্টে সেনাবাহিনীকেও টেনে নিয়ে আসা হয় এবং তা চলে থেমে থেমে নানা ছুতায়। একের পর এক নানা গুজব-গুঞ্জনের মধ্যেও সেনাবাহিনী মাঠে কাজ করছে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে। চব্বিশের জুলাই-আগস্টে সেনারা শুধু সেনা থাকেনি; তারাও হয়ে গেছে জনতা। ছাত্র-জনতার বিপ্লবের অংশীজন। এতে দ্রুত পতন ঘটে ফ্যাসিবাদের। এতে সেনা-জনতার শক্তির শক্ত সেতুবন্ধে আবার ফেরে বাংলাদেশ। সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের মানুষেরও বোধগম্য—সরকার, সেনা, জনতার বোঝাপড়া থাকলে আর পথ হারাবে না এই দেশ। ভোটবিহীন, নৈশ ও ডামি নির্বাচনে আপ্লুত হওয়ার রোগ থাকবে না। এমপিদের শুল্কমুক্ত গাড়ির সিসি, রাজউকের প্লটের সাইজ বাড়বে না। অবসর থেকে ডেকে এনে গাড়ি-বাড়ি-বেতন-ভাতা দিয়ে চুক্তিতে কাউকে নিতে হবে না। চোরের খনি খনন বন্ধ হবে। রসে-বশে তেলে-ঝোলে পুষ্পদর্শনে লালায়িতদের যবনিকা ঘটবে। মোটকথা, মানুষ যে কারণে অতিষ্ঠ হয়ে ছাত্রদের এক ডাকেই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছিল, সেই কারণগুলো দূর হবে। সেনাবাহিনী সব সময় একটি শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত। তার ওপর ভোটার তালিকা হালনাগাদ, নির্বাচনী সামগ্রী পরিবহন এবং ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা প্রমাণিত। জনগণের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলো একে সহযোগিতা করলে সেনাবাহিনীর ভূমিকা গণতন্ত্রের সহায়ক হয়, শাসক নয়—তা চব্বিশে বাংলাদেশে টাটকা উদাহরণের মতো দেখল বিশ্ববাসী। জেনারেল ওয়াকারের সেনাবাহিনীকে ক্ষমতামুখী না করে জনতামুখী করার এই দৃষ্টান্ত ইতিহাস হয়ে থাকবে। যেখানে পুলিশসহ ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডাররা ছাত্র-জনতাকে হতাহত করে, সেখানে সেনা সদস্যরা তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।
এখানে ভূ-রাজনীতি ও বিশ্ববাস্তবতাও একটা ফ্যাক্টর। এর বাইরে বাংলাদেশে ফ্যাসিস্ট শাসক নানা ক্রিয়াকর্মে নিজেও তার নিজের পতন দ্রুত নিশ্চিত করেছে, যা প্রকারান্তরে গণতন্ত্রসহ বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশকে এগিয়ে যাওয়ার সময় ও পথ রচনা করে দিয়েছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতে উগ্র হিন্দুত্ববাদের থাবা ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানকার শাসকগোষ্ঠী রাজনৈতিক কারণে এ অবস্থায় এনে ছেড়েছে দেশটিকে। তাদের লাগোয়া ও টার্গেটের বাংলাদেশ কখনো সেই পরিণতিতে যাবে না—এ আশা শান্তিকামী মানুষের। সেখানে একটা বিশেষ ভরসা-আস্থার জায়গা সেনাবাহিনী।
সেই উচ্চাশার মাঝে যেকোনোভাবে সেনাবাহিনীর প্রতি বিষোদ্গারের প্রবণতা কেন? টানা গুজব-উত্তেজনার অবসান ঘটিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের তিন মামলায় সাবেক-বর্তমান ১৫ সেনা কর্মকর্তাকে বিচারপ্রক্রিয়ায় সোপর্দ করার বিষয়টির প্রশংসা না করে এ নিয়েও চলছে মন্দ চর্চা। মামলা তিনটির মধ্যে দুটি হচ্ছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে গুম-নির্যাতনের মাধ্যমে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায়। অন্যটি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর রামপুরা ও বনশ্রী এলাকায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায়। আসামিদের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতাও দৃশ্যমান হলো। সেনাবাহিনীর দিক থেকে বিচারকাজে সহায়তার আশ্বাসের বাস্তবায়ন ঘটেছে। এর মধ্য দিয়ে গুজবের বাজার আবারও মার খেয়েছে। কিছুদিন ধরে কী গুজবকাণ্ডই না ঘটেছে! সঙ্গে নানা অবান্তর কথামালা। তা চব্বিশের জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পর ভর করলেও গুমে জড়িত অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তিনটি মামলায় ২৫ সেনা কর্মকর্তার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর এতে নতুন করে হিড়িক পড়ে। সেনাবাহিনী বিচার করতে দিতে চায় না, এ নিয়ে সরকারের সঙ্গে বা আদালতের সঙ্গে সেনাবাহিনীর চরম বিরোধ যাচ্ছে, যেকোনো সময় যেকোনো কিছু ঘটে যেতে পারে, ভেতরে অবস্থা বড় গরম ইত্যাদি গুজবে দেশ গরম করে তোলা হয়।
গুজবের জবাব গুজবে হয় না। সেনাবাহিনী সাফ কথায় জানিয়ে দিয়েছে, ‘নো কম্প্রোমাইজ উইথ ইনসাফ।’ গুমের শিকার পরিবারগুলোকে গভীর সমবেদনাও প্রকাশ করেছে। ট্রাইব্যুনাল আইন ও সেনা আইনকে মুখোমুখিও করেনি, বরং আইনকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে সহায়তা দিচ্ছে। গুমসংক্রান্ত অভিযোগ তদন্তের জন্য গঠিত জাতীয় কমিশনকে সেনাবাহিনী শুরু থেকেই সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়ে আসছে। কমিশনের চাহিদা অনুযায়ী তথ্য সংগ্রহে সহযোগিতা করেছে। নথি সরবরাহও করেছে। সাক্ষাৎকার নেওয়ার ব্যবস্থাও করেছে। বিচারপ্রক্রিয়া শুরুর পর অভিযুক্তদের পরিবার থেকে আলাদা করে সেনা হেফাজতে এনে সেনাবাহিনী এই বিচারে সহায়তা করছে। অথচ বিচার বা রায়ের আগেই মিডিয়া ট্রায়াল, পাবলিক ট্রায়াল—সব করে ফেলা হচ্ছে। ব্যক্তির অপরাধে গোটা বাহিনীকেই কাঠগড়ায় নিয়ে আসার কুপ্রবণতা চলে হরদম। প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এই ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল না। এটি কিছু ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ; প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নয়। আরো জানেন, ঘটনার সময় অভিযুক্তদের কেউই সেনাবাহিনীর সরাসরি কমান্ডের অধীনে কর্মরত ছিলেন না। ডিজিএফআই বা র্যাবে ছিলেন ডেপুটেশন বা প্রেষণে। এই বাহিনীগুলো সেনাবাহিনীর অধীনে নয়। বিশেষ করে ডিজিএফআই সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর অধীনে। সেনাবাহিনীর কমান্ড কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত নয়। অভিযুক্তদের কর্মকাণ্ড সেনাবাহিনীর প্রাতিষ্ঠানিক কমান্ডের বাইরে। তাদের সম্পর্কে সেনা সদরের পক্ষে অবগত হওয়া বা নজরদারি করার ব্যবস্থাই নেই। আর র্যাব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে। এ অবস্থায়ও গোটা সেনাবাহিনীকে মুখোমুখি করা, বিষোদ্গারে ফেলার হেন চেষ্টা নেই, যা না চলেছে। এই দুষ্ট চেষ্টা শেষতক হালে পানি পায়নি। আপাতত একটা অবসান ঘটেছে। সেনাবাহিনীকে নিয়ে বিষোদ্গার বা তাদের বিব্রত করার পুরনো নোংরামি আর নতুন ডালপালা না মেলুক। ঐক্যের বাতাবরণ, দেশে কাঙ্ক্ষিত নির্বাচনের অভিযাত্রাসহ আশপাশের সুবাতাসে চক্রবিশেষ বরাবর ভারাক্রান্ত থাকে। ভবিষ্যতেও থাকবে। এদের কামনাই হচ্ছে, এখানে অস্থিরতার কালো মেঘ জমে থাকুক। অনিশ্চয়তা স্থায়ী হোক। সভ্য চিস্তার শরিক কারো সেই কামনা থাকে না।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট, ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন।
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ