বাংলাদেশের লোকসংগীত হলো গ্রামবাংলার মানুষের জীবন, সুখ-দুঃখ ও আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিচ্ছবি। এটি মৌখিকভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রবাহিত এবং মূলত আঞ্চলিক ভাষা ও সহজ সুরে গাওয়া হয়। এ গানগুলো দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও মাটির গন্ধ ধারণ করে এবং এখনো গণমানুষের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয়। তেমনি কিছু বিখ্যাত গান, গায়ক, গীতিকার-সুরকার তথা গানের স্রষ্টাদের নিয়ে লিখেছেন- পান্থ আফজাল
আব্বাসউদ্দীন আহমদ
সংস্কৃতি জগতের এক কিংবদন্তির নাম আব্বাসউদ্দীন। আধুনিক গান, স্বদেশী গান, ইসলামি গান, পল্লীগীতি, উর্দু গান সবই তিনি গেয়েছেন। তবে পল্লীগীতি গানে মৌলিকতা ও সাফল্য সবচেয়ে বেশি তাঁর। আব্বাসউদ্দীনের রেকর্ড করা গানের সংখ্যা প্রায় সাত শ। তাঁর জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে ‘আমার হার কালা করলাম রে’, ‘আল্লাহ মেঘ দে’ (কথা জালালুদ্দিন), ‘নদীর কূল নাই’, ‘মাঝি বাইয়া যাও’, ‘নাও ছাড়িয়া দে’, ‘ফান্দে পড়িয়া বন্দে’ (কথা-সুর প্রচলিত), ‘ঐ শোন কদম্বতলে’, ‘আমার গলার হার’, ‘আমায় ভাসাইলি রে’, ‘আগে জানলে তোর ভাঙা’।
আবদুল আলীম
বাংলা লোকসংগীতের কিংবদন্তি শিল্পী, এক অবিস্মরণীয় নাম আবদুল আলীম। তাঁর বিখ্যাত ফোক গানের মধ্যে রয়েছে ‘পরের জায়গা পরের জমি’ (কথা-সুর আবদুল লতিফ)। তবে তাঁর লেখা ও সুর করা গানগুলোর মধ্যে রয়েছে- ‘নাইয়া রে নায়ের বাদাম তুইলা’, ‘সর্বনাশা পদ্মা নদী’, ‘হলুদিয়া পাখি’, ‘মেঘনার কূলে ঘর বাঁধিলাম’, ‘এই যে দুনিয়া’, ‘দোল দোল দুলনি’, ‘দুয়ারে আইসাছে পালকি’, ‘মনে বড় আশা ছিল যাবো মদিনায়’সহ অনেক জনপ্রিয় গান। তিনি প্রায় ৫০টি ছবিতে নেপথ্যে কণ্ঠশিল্পী ছিলেন। দেশের ও বাইরের বিভিন্ন শিল্পী তাঁর গান কভার করেছেন।
বাউল শাহ আবদুল করিম
বাউল শাহ আবদুল করিমের সংগীত কেবল সুর নয়, ছিল সমাজ, জীবন ও দর্শনের প্রতিচ্ছবি। পাঁচ শতাধিক গান রচনা ও সুরারোপ করে তিনি ‘বাউল সম্রাট’ উপাধিতে ভূষিত হন। তাঁর সৃষ্ট কালজয়ী গানগুলোর মধ্যে ‘বন্দে মায়া লাগাইছে’, ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’, ‘গাড়ি চলে না’, ‘কেন পিরিতি বাড়াইলারে বন্ধু’, ‘বসন্ত বাতাসে সইগো’, ‘রঙের দুনিয়া তরে চায় না’, ‘ঝিলমিল ঝিলমিল করেরে ময়ূরপঙ্খী নাও’, ‘তোমার কি দয়া লাগেনা’, ‘আমি কূলহারা কলঙ্কিনী’, ‘কেমনে ভুলিবো আমি বাঁচি না তারে ছাড়া’, ‘সখী তুরা প্রেম করিওনা’, ‘কাছে নেওনা, দেখা দেওনা’, ‘মন মজালে, ওরে বাউলা গান’, ‘নতুন প্রেমে মন মজাইয়া’, ‘আইলায় না আইলায় নারে বন্ধু’, ‘মহাজনে বানাইয়াছে ময়ূরপঙ্খী নাও’, ‘সখী কুঞ্জ সাজাও গো’, ‘গান গাই আমার মনরে বুঝাই’, ‘আসি বলে গেল বন্ধু আইলনা’ আজও দেশের সীমানা ছাড়িয়ে মানুষের হৃদয়ে দোলা দেয়। তাঁর গানের সঙ্গে মানুষের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার ক্রেডিট দিলে হাবিব ও কায়াকে (মায়া) দিতে হয়। এ ছাড়াও সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়-বাপ্পাসহ (গাড়ি চলে না, দলছুট) অনেক শিল্পীই তাঁর গান গেয়েছেন। তাঁর গাওয়া ‘কেন পিরিতি বাড়াইলা রে বন্ধু’ গানটি ‘পোড়ামন টু’ সিনেমায় গেয়েছেন হাবিব ওয়াহিদ।
বাউল সাধক রশিদ উদ্দিন
নেত্রকোনা জেলায় জন্ম নেওয়া বাউল সাধক রশিদ উদ্দিন। তাঁর সৃষ্টির মধ্যে রয়েছে ‘মা গো মা, ঝি গো ঝি’, ‘আমার সোয়া চাঁন পাখি,’ ‘মানুষ একটা কলের গাড়ি’, ‘শুন দাদা মহাশয়’, ‘হাতে নিয়া গুড্ডির নাটাই’। বাউল কবি রশিদ উদ্দিনের লেখা অসংখ্য গানের খুব কম অংশই সংগ্রহে আছে। হয়তো দুই শ থেকে আড়াই শ গান সংগ্রহে আছে। তাঁর লেখা একটি অতি জনপ্রিয় গান ‘এই যে দুনিয়া কীসের লাগিয়া’। অন্যদিকে হুমায়ূন আহমেদ তাঁর ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’-এ ‘মানুষ ধর, মানুষ ভজ’-নামক গানটি শ্রোতাদের সামনে তুলে না ধরলে এত সুন্দর একটি গান মানুষের কাছে অজানাই থেকে যেত। এ ছাড়াও সম্প্রতি কোক স্টুডিওতে খালেক দেওয়ানের নাতি আরিফ দেওয়ান ও সাগর দেওয়ানের গাওয়া ‘মালো মা’ এর গানের গীতিকার সাধক রশিদ উদ্দিন। যদিও ক্রেডিট দেওয়া হয়েছে খালেক দেওয়ানকে।
উকিল মুন্সি
হুমায়ূন আহমেদের ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ সিনেমায় বারী সিদ্দিকীর কণ্ঠে ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়’, ‘পূবালী বাতাসে’, ‘নিলুয়া বাতাসে প্রাণ না জুড়ায়’ গানগুলো দেশের সব শ্রেণির মানুষের কাছে তুমুল জনপ্রিয়। তা ছাড়া ‘বন্ধু আমার নির্ধরিয়ার ধন রে’, ‘সুজন বন্ধু রে আরে ও বন্ধু কোনবা দেশে থাকো’-এ গানগুলোও গ্রামাঞ্চলে মানুষের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। এ গানগুলোসহ অসংখ্য গানের রচিয়তা-সুরকার তথা স্রষ্টা বাউল উকিল মুন্সি, যে তথ্য সামনে আনেন প্রয়াত গায়ক ও বংশীবাদক বারী সিদ্দিকী।
কফিলউদ্দিন সরকার
সালমার কণ্ঠে ‘আমি চাইলাম যারে, ভবে পাইলাম না তারে’ (সিনেমা সাগরিকা), মায়া অ্যালবামের কায়ার কণ্ঠে ‘আমার বন্ধুয়া বিহনে গো, বাঁচি না পরানে গো’, ‘আতর গোলাপ সোয়া চন্দন’- এরকম হাজারো গানের রচয়িতা মরমি সাধক গীতিকার ও সুরকার বাউল কফিলউদ্দিন সরকার। তিনি দীর্ঘ সময় বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিম ও দুর্বিন শাহর সঙ্গে থেকে মাঠে-ঘাটে, শহরে-বন্দরে ঘুরে ঘুরে গেয়েছেন দেশ, মাটি ও প্রেমের গান। তার হাত ধরে তৈরি হয়েছেন কালা মিয়া ও সাজ্জাদ নূরসহ অসংখ্য বাউল।
হাসান আলী চিশতী নিজামী
বহুল প্রচলিত গাওয়া একটি গান ‘দিল্লিতে নিজামুদ্দিন আউলিয়া’। এই আধ্যাত্মিক গানের লেখক ও সুরকার হাসান আলী চিশতী। গানটি সর্বপ্রথম গেয়েছিলেন লাল মিয়া বয়াতি। পরবর্তীতে গেয়েছেন ঐশী ফাতেমা তুজ জোহরা, ওপারের অর্ক মুখার্জি, বিন্দুকণা, মুর্শিদাবাদী, ফকিরা ব্যান্ড, আরমান ফকির, গোলাম ফকির, পৌষালী, পারভেজ সাজ্জাদ, রাজু মণ্ডল, আশিকসহ অনেকেই।
সাধক রাধারমন দত্ত
‘ভ্রমর কইও গিয়া’ বিখ্যাত গানটির গীতিকার ও সুরকার হলেন মরমি কবি ও সাধক রাধারমণ দত্ত (পুরকায়স্থ)। সিলেটের এই প্রভাবশালী লোকসংগীত শিল্পী, গীতিকার ও সুরকার ৩ হাজারেরও বেশি গান রচনা করেছেন। তাঁর লেখা ও সুর করা বিখ্যাত গান হচ্ছে ‘কারে দেখাবো মনের দুঃখ গো’, ‘শ্যাম কালিয়া সোনা বন্ধু রে’, ‘আমার বন্ধু দয়াময়’, ‘প্রাণ সখী রে ওই শোন কদম্বতলে’, ‘জলে গিয়াছিলাম সই’, ‘জলের ঘাটে দেইখ্যা আইলাম’, ‘পিরিতি বিষম জ্বালা’, আজ কোনরে প্রাণে সুবজি রাই এলো না’, ‘আমি কৃষ্ণ কোথায় পাই’।
অন্যান্য আরও গান ও গানের স্রষ্টা...
‘মন আমার দেহঘড়ি’ গানটির স্রষ্টা আবদুর রহমান বয়াতি, ‘বুড়ি হইলাম তোর কারণে’ গানটির স্রষ্টা রাজবাড়ীতে জন্ম নেওয়া বাউলসম্রাজ্ঞী কাঙালিনী সুফিয়া, শিল্পী ফিরোজ সাঁইয়ের ‘এক সেকেন্ডের নাই ভরসা’ কিংবা ‘ইস্কুল খুইলাছে রে মওলা, আজও শ্রোতাদের হৃদয়ে অনুরণন ছড়ায়। আরও রয়েছেন ‘সর্বত মঙ্গল রাধে, ‘বকুল ফুল’, মানুষ বড়ই স্বার্থপর’, ‘বলবোনা গো’ (সুকুমার বাউল), যদি আরেক জনম’, সেলিম চৌধুরী কণ্ঠে দীনহীনের লেখা ও সুরে ‘আইজ পাশা খেলবরে শ্যাম’সহ বাউল কালা মিয়া, শাহ আলম সরকারের অসংখ্য জনপ্রিয় সব গান।