অনেকটা বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো ঘটনা ঘটেছে নেপালে। জেন-জির বিক্ষোভের মুখে মাত্র ২৭ ঘণ্টায় সরকারের পতন ঘটেছে। এ ঘটনা সারা দুনিয়ায় তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। এই ঘটনাকে অনেকে শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের ছাত্র বিক্ষোভের সঙ্গে তুলনা করছে। কিন্তু বিষয়টি আসলে তা নয়। শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের বিষয়টি ছিল স্বৈরতন্ত্র হটানোর, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি ঠেকানোর। বিষয়টি ছিল বিরোধীদের প্রতি ব্যাপক দমন-পীড়ন, নির্যাতনের প্রতিবাদ আর গুম-হত্যার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ। কিন্তু নেপালে বিষয়টি একেবারে ভিন্ন।
সে দেশে সিন্দাবাদের দৈত্যের মতো জনগণের ঘাড়ে ফ্যাসিবাদ জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেনি। সে দেশে অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচনেই সরকার গঠিত হয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, নির্বাচনের মাধ্যমে নিয়মিত সরকার পরিবর্তনের সংস্কৃতিও চালু ছিল। এমনকি কোনো নির্বাচনেই পরাজিত পক্ষ কারচুপির অভিযোগ করেছে, তা-ও শোনা যায়নি। তবে যা হয়েছে, তা হলো রাজনৈতিক অস্থিরতা, ঘন ঘন সরকার বদল। ফলে উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। বেকারত্ব বেড়েছে। এই পরিস্থিতির মধ্যে সরকার হঠাৎ করে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউবসহ ২৬টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করে দেওয়ায় তরুণ প্রজন্ম রাস্তায় নেমে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। সরকারের উদ্দেশ্য ছিল অরাজকতা, গুজব ও সামাজিক বিভাজন ঠেকানো।
সরকারের সেই উদ্দেশ্যটি প্রত্যাখ্যান করে তরুণ প্রজন্ম অভিযোগ করে বসল, সরকার নিজেদের দুর্নীতি, ব্যর্থতা ঠেকাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করেছে। তাই তারা সরকারের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে সরকারের পদত্যাগের দাবিতে দেশব্যাপী বিক্ষোভের ডাক দেয়। মনে রাখতে হবে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যুবসমাজের কাছে শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়, এটি এখন তাদের আয়-রোজগারেরও মাধ্যম। এই মাধ্যম ব্যবহার করে চাকরির সন্ধান, শিক্ষা কার্যক্রমসহ নানা রকম বিষয়ে সুবিধা গ্রহণ করে যুবসমাজ। সেই সঙ্গে আছে পরস্পর যোগাযোগ। তাই এই নিষেধাজ্ঞাকে যুবসমাজ তাদের কণ্ঠরোধ বলে মনে করে। তাই হাজার হাজার তরুণ রাজধানী কাঠমাণ্ডুসহ দেশের বিভিন্ন শহরের রাস্তায় নেমে পড়ে।
তারা নেমে পড়ে সামাজিক মাধ্যমে নেপো কিডস ও নেপো বেবি হ্যাশ ট্যাগ করে। এই নেপো কিডস ও নেপো বেবি হচ্ছে স্বজনপ্রীতি। যেসব যুবক-যুবতি নিজেদের যোগ্যতা নয়, মা-বাবা, আত্মীয়র পরিচয়ে তাদের প্রভাবের সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করে প্রতিষ্ঠা পায়, তাদের বোঝায়। এটি অনস্বীকার্য যে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো নেপালেও রাজনীতিক ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সন্তান ও আত্মীয়রা বিশেষ সুবিধাভোগী। তাদের অনেকেই সম্পদশালী ও বিলাসবহুল জীবন যাপন করে, যা তরুণসমাজকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে।
অন্যদিকে হামি নেপাল, যার অর্থ আমরা নেপাল নামের একটি মার্কিন স্বার্থসংশ্লিষ্ট এনজিও বিক্ষোভের আগুনে ঘি ঢালে। ফলে আগুন দাউদাউ করে জ্বালে ওঠে। এমনিতে নেপাল একটি গরিব দেশ। ল্যান্ডলক এই দেশটির অর্থনীতি ও বাণিজ্যের বড় অংশ ভারতের ওপর নির্ভরশীল। রাজনীতিতেও ভারতের প্রভাব দীর্ঘদিনের, সেই রাজার আমল থেকে। সাম্প্রতিক সময়ে, বিশেষ করে রাজতন্ত্রের অবসান ও নেপালে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে ভারতের কর্তৃত্ব বা দাদাগিরি অনেকটাই কমে আসে।
২০০৮ সালের পর থেকে নেপালে কোনো না কোনো কমিউনিস্ট পার্টি সরকার গঠন করেছে। কখনো যৌথভাবে, কখনো এককভাবে। সেই সরকারগুলো প্রতিবেশী চীনের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের পদক্ষেপ নেয়, শুরু হয় চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বা বিআরআই। ফলে চীন নেপালে সড়ক, রেলপথ ও জলবিদ্যুৎসহ বিভিন্ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করে। অন্যদিকে নেপাল চীনের সঙ্গে একাধিক সড়ক নির্মাণ করে দুই দেশের যোগাযোগ সহজ ও দ্রুত করে। এতে ক্ষুব্ধ ভারত বিভিন্ন সময় ভারত-নেপাল সীমান্ত বন্ধ করে নেপালের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য ব্যাহত করে। দুই দফায় কয়েক মাস ভারত নেপালের সীমান্ত বাণিজ্য পথ অবরোধ করে রাখে। এতে পরিস্থিতি এমন হয় যে নেপালের সব জ্বালানি তেল শেষ হয়ে যায়। এর অবশ্যম্ভাবী ফল হিসেবে নেপালের ভেতর বাস, ট্রাকসহ সব যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পায়। কারণ সব পণ্য আকাশপথে আমদানি করা হলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলে সময়মতো পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়নি। এর ওপর গোদের ওপর বিষফোড়া হিসেবে নেপালের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সাম্প্রদায়িকতা আমদানি করা হয়। বলা হয়, নেপাল ঐতিহাসিকভাবে হিন্দু রাষ্ট্র, একে হিন্দু রাষ্ট্রই রাখতে হবে।
উল্লেখ্য, রাজতন্ত্রের পতনের পর নেপালের নতুন সংবিধানে নেপালকে হিন্দু রাষ্ট্রের পরিবর্তে ধর্মনিরেপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেওয়া হয়। এ সময় ভারতের পক্ষ থেকে তীব্র আপত্তি তোলা হয়। ভারতের হিন্দুত্ববাদী বিভিন্ন দল ও সংগঠন এর নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায়। এর পাশাপাশি ভারতের মধ্যে নেপালে রাজতন্ত্রের পক্ষে ব্যাপক প্রচার অভিযান শুরু হয়। এমনকি রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনার পক্ষে ব্যাপক বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। এখানে একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে শিক্ষাদীক্ষায় পিছিয়ে থাকা অনগ্রসর সামন্ততান্ত্রিক ভূস্বামী প্রভাবিত দেশের এক শ্রেণির মানুষের মধ্যে রাজভক্তি আছে। এই রাজভক্তির পেছনেও রয়েছে ধর্ম। নেপালের জনগণের বিশ্বাস যে নেপালের রাজা হলেন ভগবান বিষ্ণুর অবতার। তাই তারা রাজাকে ভগবানরূপে মান্য করে। এই বিষয়টিও উসকে দেওয়া হয় কয়েক বছর ধরে।
ভারত যা বলে, নেপাল তা-ই করে। ১৯৬২ সালে চীনের সঙ্গে যুদ্ধে ভারতের শোচনীয় হারের পর ভারত তার সেনাবাহিনীর মাউন্টেন ব্রিগেডের প্রশিক্ষণের জন্য নেপালের কালাপানিতে বিশেষ প্রশিক্ষণ ক্যাম্প করে। এটি তৎকালীন রাজা মহেন্দ্র বীর বিক্রম শাহর অনুমতি নিয়েই করে। কিন্তু এটি নেপালের জনগণের কাছে গোপন রাখা হয়। এই ঘটনার দীর্ঘ সময় পর ২০০০ সালে প্রধানমন্ত্রী গিরিজা প্রসাদ কৈরালার শাসনামলে পার্লামেন্টে এই বিষয়টি প্রথম ফাঁস করেন নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি সিপিএনের নেতা সিপি মাইনালি। সেই সঙ্গে তিনি এ বিষয়ে সরকারের বিবৃতি দাবি করেন। কিন্তু সরকার এ বিষয়ে কোনো বিবৃতি প্রদানে অস্বীকৃতি জানায়।
নেপালের ক্ষমতায় পালাবদলের পর, বিশেষ করে কমিউনিস্টরা সরকার গঠনের পর এ বিষয়ে ভারতের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করা হয়। কিন্তু ভারত ওই অঞ্চলকে নিজেদের দাবি করে। এ নিয়ে নেপালে ব্যাপক তোলপাড় হয়। এক পর্যায়ে নেপাল সরকার তার দেশের নতুন মানচিত্র প্রকাশ করে ভারতের দখলকৃত অঞ্চল নেপালের ভেতর দেখিয়ে। শুধু তা-ই নয়, ওই মানচিত্র অনুমোদনের জন্য জাতিসংঘেও প্রেরণ করে। আর তাইতো সরকার পতনের পর পদচ্যুত প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি বলেছেন, ভারতবিরোধিতার কারণেই ক্ষমতা হারাতে হয়েছে।
এ থেকে এটি স্পষ্ট যে নেপালে জেন-জির বিক্ষোভে নয়, নেপালে সরকার পতন এক দীর্ঘ চক্রান্তের ফল। এই পতনের পেছনে জেন-জির বিক্ষোভ নিমিত্ত মাত্র। তাই এই সরকার পতনে কোনোমতেই দুর্নীতি, বেকারত্বকে দায়ী করা যাবে না। এই সরকার পতনের পেছনে রয়েছে এক ভূ-রাজনীতি। আর এই ভূ-রাজনীতিতে ইন্ধন দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কারণ নেপাল যে ধীরে ধীরে চীনের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে, এটি ভারতের মতো যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষেও মেনে নেওয়া কঠিন।
যা হোক, নেপালে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। সরকারের প্রধানমন্ত্রী সুশীলা কার্কি আগামী বছরের মার্চে নতুন নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, তিনি দুর্নীতির তদন্ত করবেন। এটি নেপালের জনজীবনের জন্য অত্যন্ত জরুরি ও আবশ্যক। তিনি বিক্ষোভের সময় সম্পদ ধ্বংসের জন্য দায়ী ব্যক্তিদেরও বিচারের আওতায় আনার ঘোষণা দিয়েছেন। এক প্রাথমিক হিসাবে বলা হয়েছে, বিক্ষোভ-সহিংতায় ক্ষতির পরিমাণ আড়াই হাজার কোটি রুপি। ক্ষতির মধ্যে রয়েছে নেপালের লাইফলাইন পর্যটন খাত। হিলটনের মতো পাঁচতারা হোটেলসহ অনেক হোটেল আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এককথায় এক কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী। শেষ পর্যন্ত কী হয়, তা দেখার জন্য অপেক্ষার কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
বিডি প্রতিদিন/নাজিম