রাজধানীর মহাখালী ডেঙ্গু ডেডিকেটেড হাসপাতালের বিছানায় দুই বছরের ছেলেকে নিয়ে বসেছিলেন খাদিজা বেগম। তিনি বলেন, পাঁচ দিন আগে ছেলের জ্বর আসে। সঙ্গে প্রচণ্ড বমি আর পাতলা পায়খানা। সাভারের বেসরকারি একটি হাসপাতালে ভর্তি করেছিলাম। টেস্টে ডেঙ্গু পজিটিভ আসে। ছেলের শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে এ হাসপাতালে নিয়ে আসি। ভয়ে ভয়ে প্রতিটা দিন পার করছি। ক্যানুলার সুঁচের আঘাতে ছোট্ট হাত নীল হয়ে গেছে।’
রাজধানীসহ সারা দেশের হাসপাতালে বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। এর বাইরে অসংখ্য ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এ পরিসংখ্যান নেই সরকারের কাছে। গত মঙ্গলবার সকাল ৮টা থেকে গতকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১০ জন। এনিয়ে চলতি বছরে ডেঙ্গুতে প্রাণ হারিয়েছেন ৩০২ জন, আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৭৪ হাজার ৯৯২ জন। ছোট্ট শিশু থেকে বয়স্ক মানুষ কেউ রেহায় পাচ্ছে না ডেঙ্গুর কবল থেকে।
মহাখালী ডেঙ্গু ডেডিকেটেড হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, বর্তমানে ২০১ জন রোগী ভর্তি আছেন। এর মধ্যে বড় অংশ শিশু। হাসপাতালে ভর্তি অধিকাংশ রোগীর প্লাটিলেট কমে গেছে। এ ছাড়া শিশু ও বয়স্ক রোগীদের বেশ কিছু জটিলতা রয়েছে।
জ্বর আসলে করণীয় সম্পর্কে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. তুষার মাহমুদ বলেন, ‘এখন ঘরে ঘরে জ্বর হচ্ছে। হাসপাতালেও রোগীর ভীষণ চাপ। জ্বরের সঙ্গে শরীরে ব্যথা, পাতলা পায়খানা, গায়ে র্যাশ ওঠা বিভিন্ন রকমের উপসর্গ দেখা যাচ্ছে। তাই জ্বর আসলে প্রথমে ডেঙ্গু কি না তা শনাক্তে টেস্ট করতে হবে। জ্বর কমাতে নিজে থেকে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া যাবে না। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খেতে হবে। ভেজা তোয়ালে দিয়ে শরীর মুছে দিতে এবং বেশি তরল পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। তাজা ফলের রস, স্যুপ, পানি খাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বরে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ১৫ হাজার ৮৬৬ রোগী। অক্টোবরে সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২২ হাজার ৫২০ জনে। নভেম্বরের পাঁচ দিনেই আক্রান্ত হয়েছেন ৫ হাজার ১৩০ জন। সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুতে প্রাণ হারিয়েছিলেন ৭৬ জন, অক্টোবরে ৮০ জন, চলতি মাসের পাঁচ দিনেই মারা গেছেন ২৪ জন। এতে ডেঙ্গু নিয়ে দেশজুড়ে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। সবচেয়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি)। চলতি বছরে ৩০২ জন মারা গেছেন, এর মধ্যে ১৪৫ জনই ডিএসসিসি এলাকার বাসিন্দা। গত ২৪ ঘণ্টায় ১০ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে পাঁচজনই ডিএসসিসির বাসিন্দা। বাকিদের তিনজন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের, একজন বরিশাল বিভাগের এবং একজন খুলনা বিভাগের বাসিন্দা। গত ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত হয়েছেন এক হাজার ৬৯ জন। বর্তমানে সারা দেশের হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি আছেন ১ হাজার ১৪০ জন। এর মধ্যে ১৯০ জন রোগী ভর্তি মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
সরেজমিন মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দেখা যায়, ডেঙ্গু ওয়ার্ডে ঠাঁই ধারণের জায়গা নেই। কেরানীগঞ্জ, সোনারগাঁও, মুন্সিগঞ্জ এমনকি কুমিল্লা থেকেও রোগী এসেছেন। নারায়ণগঞ্জ থেকে বয়স্ক মাকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছিলেন সোহাগ আলী। তিনি বলেন, ‘চার দিন আগে মা জ্বরে আক্রান্ত হলে টেস্ট করে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। মায়ের কিডনির সমস্যাসহ বেশ কিছু জটিলতা আছে। এজন্য বাড়িতে রেখে ঝুঁকি নিতে চাইনি। হাসপাতালে ভীষণ ভিড়। কাগজপত্র পূরণ করেছি, কিছুক্ষণ পরে ভর্তি করা হবে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার বলেন, ‘২০-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা এডিস মশার বেঁচে থাকার জন্য উপযুক্ত। ফলে বৃষ্টির সঙ্গে তাপমাত্রা মিলিয়ে এক আদর্শ পরিবেশ তৈরি হয়েছে ডেঙ্গু বিস্তারের জন্য।’
তিনি আরও বলেন, ‘ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ প্রশাসনিক অদক্ষতা, অভিজ্ঞ ও দক্ষ কীটতত্ত্ববিদ নিয়োগ না করা এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ধীরগতি। সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোর মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম শক্তিশালী নয়। ফগার মেশিনের কার্যকারিতা সীমিত এবং অনেক সময় এটি ভুল জায়গায় বা ভুল সময়ে ব্যবহার করা হয়। ডেঙ্গু মোকাবিলায় নাগরিকদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এডিস মশার ৮০ শতাংশ প্রজনন স্থানই মানুষের বাসাবাড়ি কিংবা কর্মস্থল।’