পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এক বছর মেয়াদি ছাত্র সংসদের কার্যক্রম পরিচালনা এবং পাঁচ বছর মেয়াদি জাতীয় সংসদ ও সরকার পরিচালনা সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার। সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষে আসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম। শিক্ষামানে অনেক পিছিয়ে থাকা সত্ত্বেও ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে দেশের সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ‘সূতিকাগার’ খ্যাত এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। একাত্তরের স্বাধীনতাসংগ্রাম থেকে চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থান পর্যন্ত বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে বিজয় ছিনিয়ে আনার ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অনস্বীকার্য- সবই সত্য। কিন্তু বিশাল একটি অর্জনের পর বিশৃঙ্খলা যা যা হওয়ার সবই শুরু হয়েছে। যেমনটি ঘটেছিল স্বাধীনতাসংগ্রামে বিজয়ের পর।
শেখ মুজিবের মতো দাপুটে একচ্ছত্র নেতাকেও হার মানতে হয়েছিল নানামুখী চাপে। ‘লাল ঘোড়া দাবড়িয়ে,’ ‘রক্ষীবাহিনী লেলিয়ে’ দিয়েও তিনি তাঁর দলের লোকদের লুটপাট, দখল ও চুরিচামারি থামাতে পারেননি। জীবদ্দশায় ১৯৭৪ সালের এপ্রিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটেছিল তাঁর গড়া ছাত্রলীগের অন্তঃকোন্দলে সাত খুনের ঘটনা। নানা জালে তিনি এমনভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন যে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে, এক লাথিতে গণতন্ত্রকে কবরে নিক্ষেপ করে তাঁকে একদলীয় বাকশালী শাসন কায়েম করতে হয়েছিল। তাতেও কী তিনি রক্ষা পেয়েছিলেন? পাননি। রাজনীতিতে তিনি যে অরাজকতা সৃষ্টি করেছিলেন, দেশবাসীকে এখনো সে ভুলের চরম খেসারত দিতে হচ্ছে।
ৃবৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, যাঁরা বিপ্লবের মশাল জ্বালিয়ে সমগ্র দেশে সে আলো ছড়িয়ে শেখ হাসিনার দানবীয় শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে মাত্র দুই সপ্তাহের ব্যবধানে তাঁকে ক্ষমতা ছেড়ে পালাতে বাধ্য করেছিল, সেই আন্দোলনের সমন্বয়কদের কর্মকাণ্ড নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠেছে। তাঁদের কারও কারও বিরুদ্ধে চাঁদাবাজিসহ ভয়ভীতি প্রদর্শন ও প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ উঠেছে। যদিও বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এগুলো তেমন গুরুতর কোনো অভিযোগ নয়। কিন্তু বিপদ হয়েছে একশ্রেণির রাজনীতিবিদ ও তাঁদের দলগুলোকে নিয়ে। শেখ হাসিনার কবল থেকে বাঁচতে ১৬ বছর ধরে যেসব দলের কার্যত রাজনৈতিক মৃত্যু ঘটেছিল, যেসব রাজনীতিবিদ রাজনীতি বর্জন করে ‘ধরণির এক কোণে রহিব আপন মনে’ ধরনের মুচলেকা দিয়ে শীতনিদ্রায় চলে গিয়েছিলেন, অন্ধকার গর্তে ঘুমিয়ে থাকা কচ্ছপের মতো খোলস থেকে যারা মাথা বের করতে সাহস করেননি, তারা সহসা খোলস থেকে বের হয়ে জুলাইয়ের অর্জনে তাদের বিশাল ভূমিকা রাখার দাবিতে বিশ্রম্ভালাপ শুরু করেন।
অন্ধকার থেকে হঠাৎ সূর্যের আলোতে বের হলে প্রথমে চোখে কিছুই দেখা যায় না, কিছু সময়ের জন্য মাথা ঘুরতে থাকে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিশেষ করে একটি বড় দলের নেতাদের ক্ষেত্রে তাই ঘটেছিল। সূর্যের তীব্র আলোকচ্ছটায় তাদের চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল। শেখ হাসিনার শূন্যস্থানে তারা নিজেদের না দেখে অনেকটা তালগোল হারিয়ে ফেলেছিলেন। যখন কিছুটা সামলে ওঠেন, ধাতস্থ হন, তখন বিপ্লবের ফসল হিসেবে ক্ষমতায় আসীন সরকারকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন, সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনার ঠ্যাঙাড়ে দলের ‘ভালো লোকদের’ দলে টানার ইঙ্গিত দিতে থাকেন। যারা দেড় যুগ ধরে একজন ফ্যাসিস্ট শাসক এবং তার অধীন দানবীয় সরকারের চেলাচামুণ্ডাদের সব অন্যায়-অবিচার, গুম-খুন, লুণ্ঠন, প্রতিষ্ঠান ধ্বংস, সংবিধান পাল্টে ফেলা, নির্বাচনব্যবস্থা ধ্বংস করা, দেশকে রাজনীতিশূন্য করে ফেলাসহ প্রতিটি কাজে সমর্থন ও সহায়তা করেছে, তাদের মধ্য থেকে ‘ভালো লোক’ খোঁজা যে কম্বলে হারিয়ে যাওয়া সুচ খুঁজে পাওয়ার মতো অসম্ভব একটি প্রচেষ্টা, এই সাধারণ বুদ্ধিটুকু যাদের নেই, তাদের রাজনৈতিক স্থিরতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা খুব স্বাভাবিক।
ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদের মিশ্রণে দেশীয় পদ্ধতিতে তৈরি আওয়ামী লীগের ‘ভালো লোকদের’ অন্বেষণকারী দলটি অপরিচিত কোনো দল নয়। বাংলাদেশের জনগণের প্রিয় দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), যে দলের প্রতিষ্ঠাতা একজন সৎ মানুষ, স্বাধীনতার ঘোষণাকারী জিয়াউর রহমান। পরবর্তী সময়ে দৃঢ়তার সঙ্গে যে দলের হাল ধরেন অন্যায়ের প্রতি আপসহীন বেগম খালেদা জিয়া। পরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তনে সেই দলটির নেতাদের মুখে আওয়ামী লীগের ভালো লোক খোঁজার ইঙ্গিতে কেউ যদি উপসংহারে পৌঁছে যে তারা হয় আওয়ামী লীগের ফাঁদে পা দিয়েছে, অথবা সরকারে গিয়ে আওয়ামী লীগের লালনকারী ও প্রশ্রয়দাতা দেশের প্রতি নতজানু থাকার ‘মৌরসি পাট্টা’ (অন্যায়ভাবে উত্তরাধিকার বজায় রাখার স্থায়ী প্রতিশ্রুতি) দিয়েছে। সেজন্য তারা প্রথম থেকেই অন্তর্বর্তী সরকারের পদে পদে ভুল ধরতে থাকেন। সরকারের প্রায় প্রতিটি সিদ্ধান্তে ‘এটা কেন’ ‘ওটা নয় কেন’ ইত্যাদি প্রশ্ন তুলতে শুরু করেন।
বিপ্লবী ও বিপ্লবের সমর্থক সবার একটাই দাবি ছিল জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে জুলাইয়ের চেতনা অনুযায়ী সংবিধান, প্রশাসন, সরকারব্যবস্থা, নির্বাচনব্যবস্থা ও বিচারব্যবস্থার সংস্কারসহ প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে সংস্কার সাধন এবং হাসিনার সরকারের আমলে সংঘটিত সব গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার সম্পন্ন হওয়ার পর। জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতির পথে উল্লিখিত সংস্কারের উদ্যোগে বিএনপি একের পর এক আপত্তি জানাতে থাকে, প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। তাদের আপত্তি এখনো অব্যাহত এবং তাদের সৃষ্ট প্রতিবন্ধকতা এখনো হটানো সম্ভব হয়নি। এক কথায় দেশে আরেকটি অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য যা করা প্রয়োজন, কোনো কিছু করতে বাকি রাখছে না বিএনপিসহ তাদের সহচর তথাকথিত দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দলগুলো। অথচ পুরোনো ও রাষ্ট্র পরিচালনার অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ দল হিসেবে বিএনপির পক্ষ থেকে এ ধরনের আচরণ কেউ কামনা করে না। বিএনপি নেতৃত্বের কী ন্যূনতম ধারণা নেই যে এ ধরনের একটি অস্থির পরিস্থিতি দেখার জন্যই তো ঘাপটি মেরে অপেক্ষা করছে বাংলাদেশের ৫৫ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে নিষ্ঠুর একনায়ক, শেখ হাসিনা এবং তাঁর নেতৃত্বাধীন ‘আওয়ামী লীগ; যে দলটি কার্যত ইতালির স্বৈরশাসক বেনিতো মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট পার্টি ও জার্মান একনায়ক অ্যাডলফ হিটলারের নাৎসি পার্টির বাংলাদেশি সংস্করণ ছাড়া আর কিছু নয়। এ বিষয়ে কারও কোনো সংশয় থাকলে তারা ফ্যাসিস্ট ও নাৎসি পার্টি এবং আওয়ামী লীগের জন্ম, কর্ম ও তাদের শাসনের ইতিহাস পাঠ করে এ সম্পর্কে মূল্যায়ন যাচাই করে নিতে পারেন।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর জুলাই বিপ্লবের কাক্সিক্ষত সংস্কার সম্পন্ন হওয়ার আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তাব দিয়েছিল। আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপার থেকে ইশারা-ইঙ্গিতে পরিচালিত বিএনপি দেশের মালিকানার অদৃশ্য সিংহাসনে আসীন হয়ে অরাজনৈতিক অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর ব্রিটিশ রাজতান্ত্রিক কায়দায় প্রচ্ছন্ন ছড়ি ঘোরানো শুরু করে। তারা নানা যুক্তিতে গোঁ ধরে যে জাতীয় নির্বাচনের আগে কোনোভাবেই স্থানীয় সরকার নির্বাচন গ্রহণযোগ্য নয় এবং স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনো এখতিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের নেই। যে যুক্তি তারা উহ্য রেখেছিল, বা মুখ খুলে বলেনি, সেটি হলো, মাঠের অবস্থা যেমনই হোক, তারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে যে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির বিজয় অবশ্যম্ভাবী এবং তারা সরকার গঠন করে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করবে। এর প্রচ্ছন্ন অর্থ হচ্ছে, যদি অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে বিএনপি প্রার্থী ছাড়াও অন্যান্য দলের প্রার্থীর নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা অধিক, যা জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির ওপর অনিবার্য বিরূপ প্রভাব ফেলবে। জাতীয় নির্বাচনে বিজয় অর্জনকে বিএনপি যেহেতু ‘ছেলের হাতের মোয়া’ ভাবছিল, অতএব তাদের মন থেকে এ ভাবনাও তাদের অধীনে স্থানীয় নির্বাচনের বৈতরণী তরতর করে পাড়ি দেওয়া তাদের জন্য কঠিন হবে না। তাদের হিসাব পরিষ্কার ‘মারি তো গন্ডার, লুটি তো ভান্ডার’।
অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে বিএনপি স্থানীয় সরকার নির্বাচন না মানলেও কী কারণে ‘ডাকসু’সহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে স্বাগত জানিয়েছিল, তাতে কোনো রহস্য নেই। বিশেষ করে ডাকসু নির্বাচনে বিএনপির ছাত্রসংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল তাদের সাফল্যের ব্যাপারে এতটাই নিশ্চিত ছিল যে বিজয় ‘ভাদ্রের পাকা তালের মতো’ তাদের কোলে পড়বে এবং তাদের বিজয় জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির পক্ষে নিশ্চিত বিরাট ভূমিকা রাখবে। কিন্তু তাদের মনস্কামনা পূর্ণ হয়নি। ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদল গো-হারা হেরেছে। এরপর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচন। সেখানেও ছাত্রদলের শোচনীয় পরাজয়। ইসলামী ছাত্রশিবির, যাদের কর্মীরা কয়েক দশক ধরেই ক্যাম্পাসগুলোতে কখনো ছাত্রলীগ, কখনো ছাত্রদলের হাতে চরম নিগৃহীত হয়েছে, জীবন দিয়েছে, পঙ্গুত্ববরণ করেছে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃতও হয়েছে। বিএনপির ১৯৯১-১৯৯৬ শাসনামলে ছাত্রদল যে দানব হয়ে উঠেছিল, তাদের দানবীয় থাবায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবির কর্মীদের ওপর নিপীড়ন চালানো ছাড়াও কয়েক ডজন শিবির সমর্থকের ছাত্রত্ব বাতিল করতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করেছিল। বিপ্লবোত্তর পরিস্থিতিতে ইসলামী ছাত্রশিবির ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’ নামে প্যানেল দিয়ে নিরঙ্কুশ বিজয় নিশ্চিত করেছে।
ছাত্রশিবিরের এই বিজয়ে মনে হয় বিএনপির মাথা ঘুরে গেছে। আবোলতাবোল বকতে শুরু করেছে। প্রথমে তারা ‘ছাত্রলীগের সঙ্গে শিবিরের বোঝাপড়ার কারণে ছাত্রলীগ শিবিরকে ভোট দিয়েছে’ ধরনের কথাবার্তা বলে নিজেদের অস্বস্তি কাটাতে চেষ্টা করেছে। তাদের কথায় কেউ আমল না দেওয়ায় তারা এখন কপাল চাপড়াতে শুরু করেছে যে কেন তারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে এতটা উতলা হয়েছিল, যেখানে তারা এই সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন কোনোভাবেই মানতে রাজি হয়নি। ছাত্র সংসদ নির্বাচনগুলোও তো এক ধরনের স্থানীয় সরকার নির্বাচন। পার্থক্য শুধু এটুকু যে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় স্থানীয় সরকার আইনে এবং নির্বাচন পরিচালনা করে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন। অন্যদিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৩ সালের পাবলিক ইউনিভার্সিটি অ্যাক্টের আওতায় সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের গঠিত নির্বাচন কমিশন কর্তৃক।
অন্তর্বর্তী সরকারই বা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে এত আগ্রহী হয়ে উঠেছিল কেন? বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তো নিয়মিত নির্বাচন অনুষ্ঠানের ইতিহাস নেই। স্বাধীনতার পর দীর্ঘ প্রায় সাড়ে পাঁচ দশকে ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে মাত্র আটবার। প্রতি বছর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পরিবর্তে ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে গড়ে প্রতি সাড়ে ছয় বছরে একবার। ইতিহাস সাক্ষী, অখণ্ড পাকিস্তানের ২৩ বছরে ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৮ বার। কিন্তু এ কথা বলা যায় না যে ডাকসু নির্বাচন মানেই গণতন্ত্র। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, দেশে যখন গণতন্ত্রের প্লাবন বয়ে যায়, তখন গণতন্ত্রের মাতা-পিতারা ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ধারেকাছে যান না। ১৯৯০ সালের পর ডাকসু-পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২৮ বছর পর ২০১৯ সালে। এই বিশাল মেয়াদের ১৫ বছরই ক্ষমতায় ছিলেন শেখ হাসিনা।
কেবল ডাকসু নয়, আমার অহং‹ারের দেশ ‘সকল দেশের রানী সে যে-আমার জন্মভূমি’র কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে সাড়ে তিন দশক পর্যন্ত কোনো ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। ছাত্র সংসদ নির্বাচন না দেওয়ার মুখ্য কারণ ক্ষমতাসীন দলগুলোর ছাত্রসংগঠন যখন ‘পাঁঠা কুঁদে খুঁটির জোরে’ ধরনের আচরণ শুরু করে, অন্য সংগঠনের সমর্থকদের পেটায়, হল ছাড়তে বাধ্য করে, বিশ্ববিদ্যালয়ের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করে; অতএব তারা তাদের গ্রহণযোগ্যতা হারায়। নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৪৮ সালে। স্বাধীনতার পর তারা মাত্র একবার ডাকসুতে নির্বাচিত হয়েছিল। তা-ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে। কিন্তু মাঝেমধ্যে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাণ্ডব চালানোর শীর্ষে বরাবর ছাত্রলীগই ছিল। ছাত্রদল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭৯ সালে। তারাও মাত্র একবার ডাকসুতে জয়ী হয়েছিল। ক্যাম্পাসে এই ছাত্রসংগঠন দুটির অপকর্ম, টেন্ডারবাজি ও তাণ্ডবে সাধারণ শিক্ষার্থীরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল বলে পরিবর্তন চেয়েছে এবং কাক্সিক্ষত পরিবর্তনে তারা সন্তুষ্ট।
ছাত্র সংসদের নির্বাচনে কোনো ছাত্রসংগঠনের বিজয় জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী তাদের মূল সংগঠনের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেওয়ার চেয়ে খুব বেশি প্রভাব রাখে না। ডাকসু, জাকসু নির্বাচনে ছাত্রশিবিরের বিজয়ে জামায়াতে ইসলামীর মনোবল চাঙা হয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু তাতে এমন ধারণা করার সংগত কোনো কারণ নেই যে দেশের প্রতিটি সংসদীয় আসনে প্রার্থী মনোনয়ন দিলে তারা সরকার গঠন করার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করবে। ১৯৯৬ সালে জামায়াত সংসদের ৩০০ আসনে প্রার্থী দিয়ে নিজেদের বিপর্যয়কে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল এবং ২১ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসার সুযোগ করে দিয়েছিল। আশা করি তারা নিজেদের ইতিহাস থেকেই শিক্ষা নেবে।
ডাকসু ও জাকসুতে বিজয়ের পর ‘রাকসু’, ‘চাকসু’ নির্বাচনেও ছাত্রশিবিরের প্যানেল জয়ী হবে, তা মোটামুটি ধরেই নেওয়া যায়। কিন্তু বিএনপির উচিত হবে না, এটাকে তাদের বিপর্যয় হিসেবে নেওয়ার। বরং এতটা ভেঙে না পড়ে তাদের আত্মজিজ্ঞাসার সময় এসেছে, অতীতে খুঁটির জোরে ছাত্রদল শিক্ষাঙ্গনে কী কী অপকর্ম ও বাড়াবাড়ি করেছিল এবং জুলাই বিপ্লবের সাফল্যের পর এক বছর ধরে তারা কী করেছে এবং এখনো করছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কয়েক দিন আগেও বলেছেন, বিভিন্ন অভিযোগে গত এক বছরে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের সাড়ে সাত হাজার নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবু কি দেশে চাঁদাবাজি বন্ধ হয়েছে অথবা চাঁদাবাজির ক্ষেত্রগুলোর নিয়ন্ত্রণ বিএনপি ছাড়া অন্য কোনো দলের হাতে গেছে? মুখ দেখে ব্যবস্থা গ্রহণ না করে, যারা আসলেই এসব অপকর্মে অভিযুক্ত তাদের বিরুদ্ধে ঢালাও ব্যবস্থা কখনোই কোনো বড় দল নেয় না। কারণ তাতে একদিকে চাঁদার বখরায় ঘাটতি পড়বে, অন্যদিকে ‘লোম বাছতে কম্বল উজাড়’ হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেবে। তাই তারা লোকদেখানো ব্যবস্থা নেয়।
লেখক : যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী সিনিয়র সাংবাদিক ও অনুবাদক