আধুনিক মতবাদ এই যে আপাতদৃষ্টিতে প্রতীয়মান পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও মানুষকে একেবারে সমানভাবে বিবেচনা করতে হবে। আমরা সবাই মানবজাতির অংশ, আর তাই অবশ্যই সমবিবেচনার অধিকারী। এই প্রতিপাদ্যের বিপরীতে অবস্থান নিলে কী পরিণতি হতে পারে, তা বিশদভাবে পর্যালোচনার দাবি রাখে। প্রত্যেক মানুষকে সমানভাবে বিবেচনা না করার মধ্যে শুধু যে নৈতিক তাৎপর্য নিহিত থাকে তা কিন্তু নয়, এর অর্থনৈতিক পরিণতি বেশ গভীর।
এই অসমতার বেশির ভাগ বিভিন্ন উপায়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে বিধায় কেবল ন্যায়বিচারের প্রসঙ্গ জরুরি হয়ে পড়ে। এর মধ্যে সম্পদের বিতরণ সম্পর্কিত ন্যায়বিচার উন্নয়নকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করে।
বিশেষ করে জনগণের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পদের অন্যায্য বিতরণের দিকটা দেখা যেতে পারে। সম্পদ বলতে সাধারণত উৎপাদনে ব্যবহৃত ভৌত, আর্থিক এবং মানবসম্পদ; যেমন—স্বাস্থ্য, পুষ্টি, দক্ষতা ও শিক্ষা বোঝায়।
সোজা কথায়, সমাজের বেশিরভাগ সম্পদ যদি মুষ্টিমেয় কজনের নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং খুব কম থাকে বেশির ভাগের কাছে, যেমন বর্তমান বাংলাদেশে, তাহলেই বলা যাবে ওটা এক অন্যায্য বিতরণ ব্যবস্থা। এ ধরনের অন্যায্য ব্যবস্থা কেবল যে নীতিহীনতার নিরিখে খারাপ তা নয়, অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যও তা ভালো ফল বয়ে আনে না। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়, কী কী পথে একটি অন্যায্য বিতরণ ব্যবস্থা অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি রোধ করে?
দুই
প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ এস আর ওসমানী মনে করেন, তিনটি পথে অন্যায্য ব্যবস্থা উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে। প্রথমত, ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে সমান সুযোগের অনুপস্থিতিতে একটি সমাজ সম্ভাবনাময় উৎপাদনশীল বিনিয়োগ থেকে বিচ্যুত হতে পারে। আমরা জীবনের যেকোনো স্তরে মঙ্গল সাধনের নিমিত্ত যা-ই করতে চাই না কেন, তার জন্য কোনো কিছুতে বিনিয়োগ সুবিধা দরকার। যেমন—উৎপাদনশীল হয়ে অধিকতর কৃতিত্ব প্রদর্শনে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ কিংবা অর্থনৈতিক ইউনিটের দক্ষতা বৃদ্ধিতে ভৌত পুঁজিতে বিনিয়োগ। তবে আমাদের নিজস্ব সম্পদ দিয়ে এসব বিনিয়োগ সম্ভব হয় না বলেই সঞ্চয়-বিনিয়োগ দূরত্ব দূর করতে ঋণের বাজার থেকে ঋণ গ্রহণ করতে হয়। এখানেই সম্পদের অত্যন্ত অসম বিতরণ পথের কাঁটা হয়ে দেখা দেয়। ঋণের বাজারে গরিবের প্রতি সুবিচার করা হয় না।
এতে শুধু যে গরিব ক্ষতিগ্রস্ত হয় তা নয়, বরং এ ধরনের পরিস্থিতি সার্বিক অর্থনীতির বিপক্ষে অবস্থান নেয়। যেমন—অপ্রতিসম (এসেমেট্রিক) পরিস্থিতি মানে ধনীরা মুক্তভাবে ঋণ নিয়ে পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ করে যাবে, অন্যদিকে ঋণবঞ্চিত হয়ে গরিব নিজের এবং অর্থনীতির উন্নয়নে অবদান রাখতে পারবে না। ধনীর জন্য বাইরের অর্থ না-ও লাগতে পারে, তবু তারা অতি সহজে ঋণের বাজারে সুযোগপ্রাপ্ত, অথচ যাদের যথেষ্ট প্রয়োজনীয় সম্পদ নেই, সেই গরিবকে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের বাজারের বাইরে অপেক্ষার প্রহর গুনতে হয়। ভৌত ও মানব পুঁজিতে বিনিয়োগের এই প্রতিবন্ধকতা শ্রমশক্তির উৎপাদনশীলতাকে পূর্ণ সম্ভাব্য বিন্দুতে পৌঁছতে দেয় না, যার পরিণতিতে অর্থনীতি মার খায় অর্থাৎ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও তার পূর্ণ সম্ভাব্য বিন্দুতে যেতে পারে না।
তিন
অন্যায্য বিচারের দ্বিতীয় পথটি হচ্ছে পরিব্যাপক এবং অনড় লিঙ্গ অসমতা। অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় এবং অন্যান্য কারণে বেশির ভাগ দেশে এবং প্রায়ই পুরুষের বিপরীতে নারী অসুবিধাজনক অবস্থানে থাকে। এর অর্থনৈতিক পরিণতি ব্যাপক। অন্যায্যতার একটি প্রকাশ হচ্ছে এই যে উপার্জনক্ষম কর্মসংস্থানে পুরুষের তুলনায় নারী অনেক কম সুযোগ পায়। এর ফলে যে মাত্রায় শ্রমশক্তিতে ঢোকার কথা, সেভাবে তারা ঢুকতে পারছে না। তার মানে সম্ভাব্য শ্রমশক্তির একটি বড় অংশ নিষ্ক্রিয় থাকছে এবং সেহেতু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সর্বোচ্চ হতে পারছে না। অবশ্য ইতিবাচক পরিবর্তনের পথ ধরে নারী কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছে, কিন্তু পুরুষের মতো মুক্তভাবে প্রবেশ করতে এখনো দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে।
তার চেয়েও তাৎপর্যপূর্ণ, নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ শুধু আজকের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ঠেকায় না, বিভিন্ন আন্ত প্রজন্ম প্রভাবের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধিকেও ব্যাহত করে। প্রকৃতি প্রদত্ত পুনরুৎপাদন এবং প্রতিপালন ভূমিকার জন্য বহুমুখী অসুবিধায় পতিত নারীর ভবিষ্যৎ বংশধরদের সক্ষমতায় বিরূপ প্রভাব রাখে, যা প্রকারান্তরে ভবিষ্যতের অর্থনীতির জন্য ভালো কিছু বয়ে আনে না। উদাহরণস্বরূপ, যখন মায়েদের লেখাপড়ায় ঘাটতি থাকে, প্রায় দেখা যায়, তাঁদের সন্তানরাও যথেষ্ট শিক্ষা পায় না; মায়ের অপুষ্টি মানে শিশুর অপুষ্টি; কম শিক্ষিত এবং কম পুষ্ট মা জন্ম দেন কম শিক্ষিত এবং কম পুষ্ট শিশু। অসমতার এই আন্ত প্রজন্ম চক্র পুনঃপুনঃ সংঘটিত হতে থাকে।
আন্ত প্রজন্মগত পুষ্টির প্রভাব শুধু যে ভবিষ্যৎ শিশুদের ওপর বর্তায় তা নয়, এই প্রভাবে আক্রান্ত হতে পারে এমনকি ভবিষ্যতের বয়স্করাও। জানা কথা যে অপুষ্ট মা কম ওজনের অপুষ্ট শিশু জন্ম দেন, যারা বড় হয় পুষ্টিহীনতা নিয়ে। ইদানীং দেখা যাচ্ছে, একটু বয়স হলে অনেকেই বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়; যেমন—হাইপার টেনশন, ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ সমস্যা। একসময় ধনীদের রোগ বলে বিবেচিত এসব রোগ এখন দ্রুতবেগে গরিবের ঘরেও প্রবেশ করছে। মোটকথা, অন্যায্য লিঙ্গ সম্পর্কের একটি প্রভাব থাকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অকার্যকর (ডিসফাংশনাল) শ্রমশক্তির ক্ষেত্রে।
চার
সর্বশেষ পথটি হচ্ছে প্রচুর মাত্রায় বাড়ন্ত অর্থনৈতিক অসমতা থেকে ব্যাপক রাজনৈতিক অসমতার দিকে যাত্রা। ব্যাপক রাজনৈতিক অসমতা বিভিন্ন উপায়ে আবার অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অসমতা ঘনিষ্ঠভাবে গ্রথিত এবং একটি অপরটিকে শক্তি জোগায়। অর্থনৈতিক অসমতা থেকে জন্ম নেওয়া রাজনৈতিক আধিপত্য এমনিতেই খারাপ, তার ওপর অর্থনৈতিক উন্নয়নে এ ধরনের আধিপত্য ক্ষতিকর।
বিশেষত পুঁজি ও শ্রমের সম্পর্কে এর একটি অশুভ পরিণতি পরিলক্ষিত হয় শ্রমবাজারে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য মিলে প্রতিযোগিতামূলক বাজারের ভিত্তি দুর্বল করতে শ্রমিককে নামমাত্র মজুরি দিয়ে অনানুপাতিক হারে উৎপাদনের উদ্বৃত্ত উপড়ে নিজ পকেটে ঢোকায়; পথহারা শ্রমিক যা পায়, তা নিয়েই তুষ্ট থাকে। এই অন্যায্য মজুরি শ্রমিকের মনোবল ও আনুগত্য দুর্বল করে। একটি মনোবলহীন এবং অবাধ্য শ্রমশক্তি কখনো অব্যাহত অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভিত্তি হতে পারে না।
অপর এক ক্ষতিকর পরিণতি হচ্ছে, এটি সামাজিক স্থিতিশীলতার প্রতি হুমকি। যখন কিছুসংখ্যক সব দিক থেকে সবার ওপর ছড়ি ঘোরায় এবং তা অনড় ও ভয়ংকর রূপ ধারণ করে, সমাজের বৃহৎ বঞ্চিত অংশ ফুঁসতে থাকে। তা ছাইচাপা আগুনের মতো থাকলেও একসময় না একসময়, সুযোগ মুহূর্তে, বিস্ফোরিত হয়ে পুরো সমাজকে গ্রাস করে ফেলে। যেমন—ঘটেছিল অষ্টাদশ শতকে ফরাসি বিপ্লব এবং অপেক্ষাকৃত অধুনা আরব বসন্তের বেলায়।
পাঁচ
আমরা লক্ষ করব যে উপরোক্ত পর্যবেক্ষণগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের নিকট অতীতের চিত্র প্রায় একই রকম, ঋণের ক্ষেত্রে গরিবের প্রতি বঞ্চনা, নারীর প্রতি প্রকট বৈষম্য, তীব্র অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বৈষম্যের মিশ্রণের পরিণতিতে বিকৃত নীতিমালা এবং পরিণতিতে একটি জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থান। মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে যে পুরনো ধারায়ই চলছে দেশ, আর তাই পথগুলো পরিষ্কার না করতে পারলে কাঙ্ক্ষিত সম্ভাব্য প্রবৃদ্ধি বা উন্নয়ন ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। জুলাই স্পিরিট বলে যদি কিছু থেকে থাকে, তা হলো একটি ন্যায্য সমাজ প্রতিষ্ঠা, কিন্তু বাস্তবে মনে হয় উল্টো পথে চলছে দেশ। নারী মিছিলে থাকে প্রথম সারিতে, কিন্তু মুক্তির বেলায় সব শেষে, গরিব নিয়মিত কিস্তি দিয়েও ঋণ পায় না, ধনীর কাছে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ পাঁচ লাখ কোটি টাকা। পুরনো বন্দোবস্তে নতুন বাংলাদেশের নমুনা!
লেখক : অর্থনীতিবিদ, সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
বিডি প্রতিদিন/নাজিম