বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের গ্রুপে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বরে। ৫০ বছর পর নভেম্বর ২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তীর্ণ হবে। যেহেতু ভুটান ২০২৩ সালে উত্তীর্ণ হয়েছে, এবং বাংলাদেশের সঙ্গে নেপালও একই সময়ে এই গ্রুপ থেকে উত্তীর্ণ হবে, দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র আফগানিস্তানই তখনো স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে থেকে যাবে। যেকোনো বিচারে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
এ মাইলফলক একদিকে যেমন বাংলাদেশ ও তার জনগণের ইতিবাচক আর্থ-সামাজিক অর্জনের পরিচয় বহন করে, অন্যদিকে এ উত্তরণের সঙ্গে অনেক চ্যালেঞ্জও বাংলাদেশকে মোকাবেলা করতে হবে।
স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিগত সময়ে এসব দেশের জন্য প্রযোজ্য অনেক সুবিধা ভোগ করেছে। যেমন—বিশ্বের ৪০টিরও বেশি দেশে শুল্কমুক্ত, কোটামুক্ত বাজার সুবিধা (যা থেকে দেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৭০ শতাংশ লাভবান হয়ে থাকে), বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার মেধাস্বত্ব চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ছাড়, বাণিজ্য শক্তি বৃদ্ধিতে আর্থিক-কারিগরি সহায়তা, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বিভিন্ন অ্যাগ্রিমেন্ট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিশেষ ও পার্থক্যমূলক সুবিধাপ্রাপ্তি ইত্যাদি। বাংলাদেশের বিভিন্ন খাত, বিশেষ করে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক খাতসহ বিভিন্ন রপ্তানি পণ্য ও দেশীয় ওষুধশিল্প এসব সুবিধা ব্যবহার করে প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা বৃদ্ধির সুযোগ পেয়েছে এবং দেশি ও বিদেশি বাজারে নিজ নিজ অবস্থান শক্তিশালী করেছে।
তৈরি পোশাক খাতে বিশ্বের দ্বিতীয় প্রধান রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে শুল্কমুক্ত বাজারে প্রবেশাধিকারের বড় ইতিবাচক ভূমিকা রয়েছে। শুধু উন্নত দেশ নয়, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, জাপানের সঙ্গে ভারত, চীনসহ বেশ কিছু উন্নয়নশীল দেশও বাংলাদেশকে প্রায় সব পণ্যের ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা দিয়েছে। এসবই বাংলাদেশের রপ্তানি, কর্মসংস্থান, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে।
উৎপাদন, বিনিয়োগ, প্রণোদনা, ভর্তুকি ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিভিন্ন শর্ত প্রতিপালনের ক্ষেত্রেও স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে শৈথিল্য দেখানো হয়, যার সুযোগও বাংলাদেশ পেয়েছে।
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের পর এসব দেশের জন্য প্রত্যক্ষভাবে প্রযোজ্য বিভিন্ন সুবিধা আর থাকবে না। যদিও ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, কানাডা, চীনসহ বেশ কিছু দেশ শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার কিছু সময়ের জন্য (দু-তিন বছর) সম্প্রসারিত করে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর উত্তরণকে টেকসই করতে সহায়তা করার কথা বলেছে। এ সুবিধা যে সীমিত ও সাময়িক, তা বিবেচনায় রাখতে হবে। মেধাস্বত্ব আইনের ক্ষেত্রে শৈথিল্য ২০২৬-এর পরে আর থাকবে না। পেটেন্ট/লাইসেন্স মানতে হবে, বিশেষত পেটেন্ট আওতাধীন ওষুধের ক্ষেত্রে।
বাজার প্রবেশাধিকার, বাণিজ্য সহজীকরণ, মান নিয়ন্ত্রণ, বাণিজ্য উৎপাদন সহায়তা এসবের ক্ষেত্রে উত্তরণ-পূর্ব দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। এ ধরনের একটি নিকট ভবিষ্যতের কথা বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশকে যথাযথ প্রস্তুতি নিতে হবে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ স্মুথ গ্র্যাজুয়েশন স্ট্র্যাটেজি (মসৃণ উত্তরণ কৌশল) প্রণয়ন করেছে। যার মাধ্যমে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণকে টেকসই করার জন্য সুনির্দিষ্ট বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে; সময়াবদ্ধভাবে বিভিন্ন অংশীজনের মধ্যে দায়িত্ব বণ্টনও করা হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এ কৌশলের বাস্তবায়ন নিরীক্ষণের জন্য একটি উচ্চ পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করেছে, সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে উত্তরণ প্রস্তুতি কর্মকাণ্ডকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। বাংলাদেশকে বাজার সুবিধানির্ভর প্রতিযোগিতা সক্ষমতা থেকে দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতানির্ভর প্রতিযোগিতা সক্ষমতার রূপান্তর নিশ্চিত করতে হবে। উৎপাদন পর্যায়ে শ্রম অধিকার, জেন্ডার অধিকার, পরিবেশ সংরক্ষণ এসব বিষয় নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশকে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয়-বহুপক্ষীয় মুক্তবাণিজ্য অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী ও অগ্রণী হতে হবে। এ প্রচেষ্টা চলমান আছে, একে আরো বেগবান করতে হবে। মান নিয়ন্ত্রণ, মেধাস্বত্ব আইনের প্রয়োগ, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্কিত পরিবেশ উন্নয়নে বিশেষভাবে যত্নবান হতে হবে। এসব ক্ষেত্রে যেসব উদ্যোগ গৃহীত হচ্ছে, তার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াকে দ্রুততর করতে হবে। এসবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রয়োজনীয় ক্ষমতা, অর্থায়ন ও জনবল দিয়ে শক্তিশালী করতে হবে। সব ক্ষেত্রেই সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
এর আগে যে আটটি দেশ স্বল্পোন্নত থেকে উত্তরণ করেছে তাদের তুলনায় বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার, জনসংখ্যা, আমদানি রপ্তানিসহ বিভিন্ন সূচকে ব্যতিক্রমী ও বৃহৎ। বস্তুতপক্ষে এই প্রথম একটি বৃহৎ স্বল্পোন্নত দেশ উত্তরণ করতে যাচ্ছে। যেকোনো বিচারে, বাংলাদেশের জন্য এটি একটি বড় অর্জন ও গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এ উত্তরণ অর্জিত সক্ষমতার ওপর নির্ভর করে বিশ্ববাজারে ও বিশ্ব অর্থনীতিতে বৃহৎ পরিসরে অংশগ্রহণের একটি সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। ক্রেডিট রেটিং, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ঋণ সুদহার ইত্যাদির ক্ষেত্রে তা ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধি করে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় শক্তিশালী অবস্থান নিশ্চিত করার তাগিদ সৃষ্টি করবে। অন্যদিকে এ উত্তরণের পর বাংলাদেশকে বহুবিধ নতুন চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে হবে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বর্তমান পরিস্থিতিতে বহুপক্ষীয় বাণিজ্য ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দিচ্ছে। মার্কিন পাল্টাপাল্টি শুল্ক বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যকে বিপৎসংকুল করার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ এমন একটা সময়ে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ করতে যাচ্ছে, যখন একটা প্রতিকূল বিশ্ব পরিস্থিতি ক্রমে দৃশ্যমান হচ্ছে।
এসব কিছু বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশকে তার পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও নতুন ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। এ ক্ষেত্রে উল্লেখিত মসৃণ উত্তরণ কৌশলের বাস্তবায়নকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। নিকট ভবিষ্যতের এ গুরুত্বপূর্ণ বাঁক অতিক্রম করার সামর্থ্য অর্জনের বিকল্প বাংলাদেশের সামনে নেই। তাই যথাযথ প্রস্তুতিরও বিকল্প নেই।
লেখক : সম্মাননীয় ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)