ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে ফসলি ও সরকারি জমির উর্বর টপসয়েল কেটে ইটভাটা, বাড়িঘর ও বিভিন্ন নির্মাণাধীন কারখানায় বিক্রি করছে একটি সংঘবদ্ধ প্রভাবশালী মাটি চোরচক্র। এর সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে কোন্ডা ইউনিয়নের কাটুয়াইল ও কাজিরগাঁও মঠবাড়ি এলাকায়। এতে করে নষ্ট হচ্ছে আশপাশের ফসলি জমি, নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ ও পিচঢালা সড়ক, হুমকিতে রয়েছে পদ্মা সেতুর রেললাইন। পদ্মা সেতুকে ঘিরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে গড়ে ওঠা ঢাকা-যশোর রেলপথ। রেললাইনটির একটি অংশ বয়ে গেছে কেরানীগঞ্জের কোন্ডা ইউনিয়নের ওপর দিয়ে। কেরানীগঞ্জের কিছু দুর্বৃত্তের লোভের কারণে ঝুঁকিতে পড়তে যাচ্ছে সরকারের অতি গুরুত্বপূর্ণ পদ্মা সেতুর এ রেলসংযোগ লাইনটি। মাটি চোরচক্রের সদস্যরা প্রতিদিন প্রায় অর্ধশতাধিক সন্ত্রাসী পাহারায় শ্রমিক দিয়ে ভেকুর সাহায্যে উর্বর টপঢ়ড়সয়েল কেটে ট্রাক ও মাহেন্দ্রা ভরে নিয়ে যায়। এ মাটি যায় আশপাশের ইটভাটা, নিচু বাড়িঘর এবং নির্মাণাধীন কলকারখানায়।
কোন্ডা ইউনিয়নের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় এক দশক ধরে দিনরাত সমানতালে মাটি লুট করেছিল ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে তৎকালীন স্থানীয় এমপির ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠান প্রিয় প্রাঙ্গণের ম্যানেজার ও ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ নেতা জসিম মাহমুদের নেতৃত্বে একটি সংঘবদ্ধ মাটিচোর চক্র। এখন ৫ আগস্টের পর স্থানীয় বিএনপির ঊর্ধ্বতন নেতার নির্দেশে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা বিএনপির দপ্তর সম্পাদক হারুন অর রশীদ, যুবদল নেতা জাকের দেওয়ান, শ্রমিক দল নেতা সোবাহান, যুবদল নেতা আবু সাইদ, যুবদল নেতা শামিম ও স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা মো. হান্নান প্রকাশ্য দিবালোকে মাটি চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। চক্রটি রেললাইনের ৫০ গজ সামনে থেকে ২০ থেকে ৩০ ফুট গভীর করে মাটি কেটে ছোট ছোট পুকুরের সৃষ্টি করছে।
ব্রাহ্মণপাড়া সরকারি প্রাথমিক ও উচ্চবিদ্যালয়ের ভবনের খুব কাছাকাছি থেকে মাটি কাটায় ভবন দুটিও রয়েছে ঝুঁকিতে। এসব মাটিচোর চক্রের কারণে এ এলাকায় অধিকাংশ স্থানে কৃষি আবাদ বন্ধ হয়েছে। তাদের হুমকি-ধমকিতে অনেক মানুষ এলাকা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। এ পরিস্থিতিতেও গত কয়েক বছরে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় প্রায় ২৫ থেকে ৩০টির মতো জিডি ও কয়েকটি মামলা করেছেন ভুক্তভোগীরা। স্থানীয়রা বলেছেন, সব জেনেও নির্লিপ্ত স্থানীয় প্রশাসন।
সরেজমিন দেখা যায়, বুড়িগঙ্গা নদী পেরিয়ে ঢাকা-মাওয়া রেলপথটি পড়েছে কেরানীগঞ্জের কান্দাপাড়া গ্রামে। নদীর কোলঘেঁষা এলাকাটি নিচু হওয়ায় রেলপথ বানানো হয়েছে পিলার দিয়ে মাটি থেকে কিছুটা ওপরে। কান্দাপাড়ার অদূরেই ব্রাহ্মণপাড়া গ্রাম। ব্রাহ্মণপাড়া স্কুল পেরিয়ে মসজিদের ঢাল হয়ে একটু এগোলেই বড় বড় খাদ। খাদগুলো ২০ থেকে ৩০ ফুট গভীর। মাটিদস্যুদের ভেকু পৌঁছে গেছে রেলপথের ৩০-৫০ গজের মধ্যে। রেলপথের অন্য প্রান্তেও দেখা গেছে একই চিত্র।
অভিযোগের ব্যাপারে বিএনপি নেতাদের মোবাইলে ফোন দিলেও কেউ ফোন ধরেননি। এ বিষয়ে কথা হয় দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সৈয়দ মোহাম্মদ আক্তার হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, জমিসংক্রান্ত বিষয়গুলো দেখভাল করেন ভূমি কর্মকর্তা ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। আমরা দেখি আইনশৃঙ্খলা। মাটি কাটার বিষয়ে থানায় কোনো অভিযোগ এলে আমরা অভিযোগ গ্রহণ করে তা তদন্ত করে দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে থাকি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রিনাত ফৌজিয়া বলেন, আমার অফিসে ওই এলাকার কিছু লোক অনেক দিন আগে এসে তাদের বাড়িতে কাজ করার জন্য কিছু মাটির প্রয়োজন বলে জানায়। তখন তারা নিজ জমি থেকে মাটি কাটার আবেদন করেন। আমার অফিস থেকে সেটা তদন্তসাপেক্ষে জেলা প্রশাসক স্যারের পরামর্শে তাদের অনুমতি দেওয়া হয় কিন্তু বিক্রির জন্য নয়। যদি তারা সেখানে মাটি কেটে থাকে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।