হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার চোরাইপণ্য আনা-নেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে যাচ্ছে কম দামি সিগারেট আর ভারত থেকে চোরাকারবারিরা নিয়ে আসছে মদ ও ফেনসিডিল। সীমান্তবর্তী এসব জেলা দিয়ে নিয়মিত সিগারেট পাচারের অভিযোগ উঠেছে নীলফামারী-২ আসনের আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ও মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নুরের ডিস্ট্রিবিউশনস কোম্পানির বিরুদ্ধে। তবে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর হঠাৎ করেই এ পাচার কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। পাচার বন্ধের ফলে স্থানীয় বাজারেও দৃশ্যমান প্রভাব ফেলেছে, সিগারেট বিক্রি কমেছে প্রায় ৪০ শতাংশ।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সিগারেট পাচারের নিরাপদ রুট হিসেবে বেছে নেওয়া হয় কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও হবিগঞ্জ জেলার সীমান্তবর্তী এলাকা। ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো (বিএটি) দীর্ঘদিনের পুরোনো ব্যবসায়ীদের ডিলারশিপ বাতিল করে চারটি জেলায় বিক্রেতা পর্যায়ে সিগারেট সরবরাহের দায়িত্ব দেওয়া হয় আওয়ামী লীগের সাবেক এই মন্ত্রীর কোম্পানিকে। গত বছরের শুরুর দিকে হবিগঞ্জের ডিলারকে বাদ দিয়ে সরবরাহের কাজ নেয় ওই কোম্পানি। তার আগে ২০২২ সালের শুরুর দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ২০২১ সালে লালমনিরহাট এবং ২০২০ সালের শুরুতে কুড়িগ্রামের পুরোনো ডিলারকে বাদ দিয়ে সিগারেট বিতরণের কাজ পায় নুরের কোম্পানি। এসব জেলার ব্যবসায়ী ও সরবরাহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় পরিচালিত চোরাকারবার বন্ধ হওয়ায় এখন স্থানীয় বাজারে বিক্রি হওয়া সিগারেটের ওপর সরাসরি প্রভাব পড়েছে। বিশেষ করে বহুল প্রচলিত ‘লাকি স্ট্রাইক’ ব্র্যান্ডের সিগারেট বিক্রি উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ডিলার অভিযোগ করেন, বহুজাতিক তামাকজাত পণ্য উৎপাদন ও বিপণনকারী ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো (বিএটি) বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় কিছু ডিলারের মাধ্যমে সিগারেট সরবরাহ করে আসছে। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের কয়েক বছর আগে আসাদুজ্জামান নুরের মালিকানাধীন কোম্পানিকে এই চার জেলার একচেটিয়া ডিলারশিপ দেওয়া হয়। এতে পুরোনো, বহুদিনের স্থায়ী ডিলাররা কার্যত ব্যবসা হারিয়ে ফেললে শুরু হয় সিগারেট পাচার। তাদের অনেকেই মনে করেন, এই ডিলারশিপ পরিবর্তনের পেছনে রাজনৈতিক প্রভাব ও করপোরেট স্বার্থ জড়িত ছিল। এ বিষয়ে বক্তব্য নেওয়ার জন্য যোগাযোগ করা হলে বিএটি বাংলাদেশের করপোরেট অ্যাফেয়ার্স ম্যানেজার আবু সালমান মোহাম্মদ আবদুল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, উল্লিখিত বিষয়ে কোনো তথ্য বা বক্তব্যের জন্য আমাদের কোম্পানির ইমেইলে যোগাযোগ করতে হবে। পাচার বন্ধ হওয়া মানেই বাজারে বৈধ পণ্যের বিক্রি বাড়ার কথা। কিন্তু বাস্তবতা হয়েছে তার উল্টো। সংশ্লিদের মতে, পাচার হওয়া সিগারেট মূলত কর ফাঁকি দিয়ে কম দামে বিক্রি হতো। এ সস্তা সিগারেটই সীমান্তবর্তী এলাকার বড় অংশের চাহিদা পূরণ করত। ভারত থেকে আসত ফেনসিডিল ও মদ।
পুরোনো ডিলারদের একজন বলেন, আমরা ২০ বছর ধরে ব্যবসা করছি। হঠাৎ করেই আমাদের লাইসেন্স বাতিল করে অন্য কোম্পানিকে সুযোগ দেওয়া হলো। আমরা কোনো কারণও জানি না।
স্থানীয় ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, নতুন ডিলার মূলত রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে মনোপলি তৈরি করেছে। সিগারেট পাচার বন্ধ হওয়া নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। তবে রাজনৈতিক বিবেচনায় ডিলারশিপ প্রদান প্রক্রিয়া এবং পাচারের বিষয়টি নিয়ে স্বচ্ছভাবে তদন্ত ও দায়িত্বশীল পদক্ষেপ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।