একজন মুমিনের কাছে ইমানই সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। ইমান লাভ করা একটি অতুলনীয় সৌভাগ্যের বিষয়। রসুলুুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলবে আর এর ওপর তার মৃত্যু হবে, সে জান্নাতে যাবে’ (সহিহ বুখারি)।
ইমানের প্রথম অংশ হলো, ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। তিনি এক ও অদ্বিতীয়। তিনি একক, তাঁর কোনো অংশীদার নেই। ইমানের দ্বিতীয় অংশ মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ। মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রসুল। তিনি সর্বশেষ নবী। মানবজাতির হেদায়েতের জন্য তাঁকে প্রেরণ করা হয়েছে। তাঁর আনীত বিধিবিধান সবাইকে মানতে হবে। এ কথা স্বীকার করা, মনেপ্রাণে বিশ্বাস করা ও এ অনুসারে আমল করা হলো বাস্তব ইমান। ইমানের ওপরই মানুষের ইহ ও পরকালীন জীবনের ব্যর্থতা ও সফলতা নির্ভর করে। ইমানহীন আমলের কোনো মূল্য নেই। আল্লাহ ঘোষণা করেন, ‘শপথ সময়ের, নিশ্চয়ই মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। কিন্তু তারা নয়, যারা ইমান আনে ও সৎকর্ম করে। পরস্পর সত্য ও ধৈর্যের উপদেশ দেয় (সুরা আসর)।
যারা ইমান আনার পাশাপাশি নেক আমল করে তাদের প্রতি অনেক সুসংবাদ রয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই যারা ইমান আনে ও সৎকর্ম করে, তাদের অভ্যর্থনার জন্য আছে জান্নাতুল ফেরদাউস। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে’ (সুরা কাহাফ : ১০৭-১০৮)।
ইমানের মূল বিষয় হলো, আল্লাহর একত্ববাদের ওপর অটল ও অবিচল থাকা, দৃঢ় বিশ্বাস রাখা এবং আল্লাহর প্রেরিত রসুল ও তাঁর প্রদত্ত দীনের সঠিক আনুগত্য করা। ইমানের শিখর খুবই মজবুত ও সুদৃঢ়। ইমানের পরিধি অনেক ব্যাপক ও বিস্তৃত। ইমানের শাখাপ্রশাখা অন্তহীন। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘ইমানের সত্তরোর্ধ্ব শাখাপ্রশাখা রয়েছে। প্রধান হলো, ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ। এর সবচেয়ে ছোট শাখা রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে ফেলা। আর লজ্জাশীলতা ইমানের একটি বিশেষ শাখা’ (সহিহ বুখারি, মুসলিম)।
রসুলুল্লাহ (সা.) ইমানের অসংখ্য শাখাপ্রশাখা থেকে তিনটি বস্তু আমাদের জন্য উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ইমানের যাবতীয় শাখাপ্রশাখা কোরআন-হাদিসে বিস্তারিত উল্লেখ আছে। যাদের সাধ্য আছে তারা কোরআন-হাদিস অথবা বিজ্ঞ ওলামায়ে কেরামের কাছ থেকে ভালোভাবে জেনে নেওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজন তা নিজের জীবনে বাস্তবায়নের চেষ্টা করা। ইহ ও পরকালে ইমানের সুফল লাভের জন্য ইমানের প্রতিটি শাখা জীবনে বাস্তবায়নের চেষ্টা করতে হবে। সৎ আমলের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি, সৎকর্মের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ তৃপ্তি লাভ এবং ইমানের স্বাদ অনুভবের জন্য ইমান সুদৃঢ় করার বিকল্প নেই।
রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, তিনটি গুণ যার মধ্যে রয়েছে সে ইমানের স্বাদ আস্বাদন করেছে। এক. আল্লাহ ও তাঁর রসুল যার কাছে সর্বাপেক্ষা অধিক প্রিয়। দুই. একমাত্র আল্লাহর জন্যই যে ব্যক্তি কাউকে ভালোবাসে ও আল্লাহর জন্যই ঘৃণা করে। তিন. ইমান থেকে প্রত্যাবর্তন করা। যার কাছে আগুনে নিক্ষেপিত হওয়ার মতো অনীহা হয় (সহিহ বুখারি, মুসলিম)।
একজন প্রকৃত ইমানদারের জীবনে ইমানের প্রভাব পড়বে। ইমানের ফলে আল্লাহ ও তাঁর রসুল (সা.)-এর আনুগত্যের প্রতি তার স্পৃহা বেড়ে যাবে। আল্লাহ ও তাঁর রসুল (সা.)-এর প্রতি তার ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে। ইমানদার অপর মুমিনের প্রতি সহনশীল ও কল্যাণকামী হবে। তাদের মধ্যে পরস্পর আন্তরিকতার বন্ধন সৃষ্টি হবে। ইমানের যাবতীয় শাখাপ্রশাখা নিজের জীবনে বাস্তবায়নের জন্য আগ্রহ সৃষ্টি হবে। তারাই ইমানের প্রকৃত স্বাদ গ্রহণ করবে। অর্জন করবে ইহ ও পরকালে অফুরন্ত শান্তি।
ইমানের বিশেষ দাবি হলো শিরকমুক্ত ইবাদত। নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত ও যাবতীয় সৎকর্ম একমাত্র আল্লাহর জন্য করা। একজন ইমানদারের কোনো কাজে শিরকের ছোঁয়া থাকতে পারে না। যেখানে দিনের আলো আসে সেখান থেকে রাতের অন্ধকার বিদায় নেয়। শিরক হলো ইমানের সম্পূর্ণ বিপরীত। যেখানে ইমানের আলো থাকবে সেখানে শিরকের ছায়াও বিরাজ করতে পারে না। ইমানের প্রথম দাবি নির্ভেজাল তাওহিদ-একত্ববাদ। আর তাওহিদের বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহ হলো শিরক। আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর ইবাদত ও পূজা করা শিরকের প্রধান স্তর। তাই আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর ইবাদত হলো সরাসরি আল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধের নামান্তর। যেখানে এসব আয়োজন হয় তা হলো শিরকের কেন্দ্র, ইমানবিধ্বংসী আস্তানা।
হজরত ইবরাহিম (আ.) তদানীন্তন মূর্তি-প্রতীমা ও ভাস্কর্য পূজারিদের সঙ্গে আপসহীন প্রতিবাদের ফলে তিনি আগুনে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। রসুলুল্লাহ (সা.)-এর আগমনের আগে কাবাঘরে ১৬০টি মূর্তি ছিল। তিনি সব কটি মূর্তি অপসারণ করে কাবাঘরকে পবিত্র করেছিলেন। মহান প্রভু ওই মুহূর্তে অবতরণ করেন, ‘সত্য এসেছে, আর মিথ্যা বিলীন হয়েছে, নিশ্চয়ই মিথ্যা সর্বদা বিলীন হওয়ার যোগ্য’ (সুরা আল ইসরা-৮১)।
লেখক : গবেষক, ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার, বসুন্ধরা, ঢাকা